Sunday, February 11, 2018

আয়েশা রাদিআল্লাহু ‘আনহার ফজিলত

আয়েশা রাদিআল্লাহু ‘আনহার ফজিলত
ভূমিকা :
উম্মুল মুমেনিন আয়েশা রাদিআল্লাহু ‘আনহার মর্যাদা বলার অপেক্ষা রাখে না, ইসলাম ধর্মে তিনি এক অপরিহার্য ব্যক্তিত্ব, তার সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসের বাণী উল্লেখ করাই যথেষ্ট। বিশেষ করে যার ব্যাপারে কুরআন নাযিল হয়েছে, যার বিষয়টি কিয়ামত পর্যন্ত তিলাওয়াত করা হবে, তার বিষয়ে নতুন কিছু লেখার সাধ্য আমাদের লিখনির নেই। কারণ, আল্লাহর ফয়সালার পর কোন ফয়সালা নেই, আল্লাহর বাণীর পর কোন বাণী নেই। তবুও হতভাগা কিছু লোক তার ব্যাপারে অপবাদ আর কুৎসা রটনা করে নিজেদের আখেরাত বরবাদ করছে।
জন্ম :
সিদ্দিকা বিনতে সিদ্দিক, উম্মে আব্দুল্লাহ আয়েশা বিনতে আবু বকর ইব্ন আবু কুহাফা ইব্ন উসমান। মাতা : উম্মে রুমান ব্নিতে আমের ইব্ন ‘উআইমির আল-কিনানি। নবুওতের চতুর্থ অথবা পঞ্চম বছর ইসলামের মধ্যে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ফর্শা ও খুব সুন্দর, এ জন্য তাকে হুমায়রা বলা হতো।
বিয়ে ও হিজরত :
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে যখন তার পিতা মদিনায় হিজরত করেন, তখন পিতা আবু বকর আব্দুল্লাহ ইব্ন উরাইকিতকে তাকে নিয়ে আসার জন্য দুইটি অথবা তিনটি উটসহ প্রেরণ করেন, অতঃপর তিনি বোন আসমা, মা উম্মে রুমান ও ভাইসহ তার সাথে মদিনায় হিজরত করেন।
হিজরতের কয়েক মাস আগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে বিয়ের আক্দ সম্পন্ন করেন যখন তার ছয় বছর। হিজরতের দ্বিতীয় বছর তাকে উঠিয়ে নেন যখন তার নয় বছর। বিয়ের পূর্বে তার আকৃতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে দেখানো হয়েছে। জিবরিল আলাইহিস সালাম তার কাছে এসে আয়েশার ছবি পেশ করে বলেন :
“هذه زوجتك في الدنيا والآخرة” رواه الترمذي وأصله في الصحيحين .
“এ হচ্ছে তোমার দুনিয়া ও আখেরাতের স্ত্রী”। তিরমিযি হাদিসটি বর্ণনা করেছেন, তবে বুখারি ও মুসলিমে এর মূল বিষয় উল্লেখ রয়েছে।
তাকে ব্যতীত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন কুমারী নারী বিয়ে করেননি। এটা তার এক বিরল সম্মান, যা অন্য কোন স্ত্রীর ছিল না। এ কারণে তিনি জীবন ভর গর্ব করেছেন। তিনি একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন :
” يا رسول الله ، أرأيت لو نزلتَ وادياً وفيه شجرةٌ قد أُكِل منها ، ووجدتَ شجراً لم يُؤكل منها ، في أيها كنت ترتع بعيرك ؟ ” قال : ( في التي لم يرتع منها ) ، وهي تعني أنه لم يتزوج بكراً غيرها ، رواه البخاري ،
“হে আল্লাহর রাসূল, আপনি যদি কোন উপত্যকায় অবতরণ করেন, যাতে রয়েছে অনেক গাছ, যা থেকে উট খেয়েছে, আর একটি গাছ দেখেন যা কোন পশু ভক্ষণ করেনি, আপনার উট আপনি কোথায় চরাবেন, বলুন ? তিনি বললেন : “যে গাছে কোন পশু মুখ দেয়নি”। এর দ্বারা তার উদ্দেশ্য ছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ব্যতীত কোন কুমারী নারী বিয়ে করেননি। (বুখারি)
তিনি আরো বলেন :
“আমাকে নয়টি বৈশিষ্ট দেয়া হয়েছে, যা মারইয়াম বিনতে ইমরান ব্যতীত কোন নারীকে দেয়া হয়নি। আমার ছবি নিয়ে জিবরিল অবতরণ করেন, অতঃপর আমাকে বিয়ে করার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নির্দেশ দেন। তিনি শুধু আমাকেই কুমারী বিয়ে করেছেন, আমি ব্যতীত তিনি কোন কুমারী বিয়ে করেননি। যখন তার রূহ কব্জা করা হয়, তখন তার মাথা আমার কোলে ছিল। তাকে আমার ঘরেই কবর দিয়েছে। ফেরেশতারা আমার ঘর ঘিরে রেখেছিল। ফেরেশতারা যদি তার কাছে অহী নিয়ে আসত, আর তিনি তার স্ত্রীর সাথে থাকতেন তারা দূরে সরে যেত, যদিও ফেরেশতারা তখনও তার নিকট আসত, যখন আমি তার সাথে তার লেপের ভেতর থাকতাম। আমি তার খলীফা ও একনিষ্ঠ বন্ধুর মেয়ে। আমার পবিত্রতা আসমান থেকে নাযিল হয়েছে। আমি পবিত্র অবস্থায় পবিত্র ব্যক্তির নিকট জন্ম গ্রহণ করেছি। আমাকে আল্লাহর মাগফেরাত ও সম্মানিত রিযকের ওয়াদা করা হয়েছে”। {আবু ইয়ালা}
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বত :
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্তরে আয়েশা রাদিআল্লাহ আনহার যে মহত্ব ও মর্যাদা ছিল, তা অন্য কোন স্ত্রীর জন্য ছিল না। তার প্রতি এ মহব্বত তিনি কারো থেকে গোপন পর্যন্ত করতে পারেননি, তিনি তাকে এমন ভালবাসতেন যে, আয়েশা যেখান থেকে পানি পান করত, তিনিও সেখান থেকে পানি পান করতেন, আয়েশা যেখান থেকে খেত, তিনিও সেখান থেকে খেতেন। অষ্টম হিজরিতে ইসলাম গ্রহণকারী আমর ইব্নুল আস রাদিআল্লাহু আনহু তাকে জিজ্ঞাসা করেন :
” أي الناس أحب إليك يا رسول الله ؟ ” ، قال : (عائشة) قال : فمن الرجال ؟ قال : (أبوها) متفق عليه.
“হে আল্লাহর রাসূল, আপনার নিকট সবচেয়ে প্রিয় কে ?” তিনি বললেন : “আয়েশা”। সে বলল : পুরুষদের থেকে ? তিনি বললেন : “তার পিতা”। {বুখারি ও মুসলিম}
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে খেলা-ধুলা, হাসি-ঠাট্টা ইত্যাদিতে অংশ গ্রহণ করতেন। কোন এক সফরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে দৌড় প্রতিযোগিতায়ও অংশ নেন।
আয়েশা রাদিআল্লাহ আনহা আরো বর্ণনা করেন, যার দ্বারা তার সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্নেহ, মমতা ও আদর-সোহাগের প্রকাশ পায়, তিনি বলেন :
( والله لقد رأيت رسول الله – صلى الله عليه وسلم – يقوم على باب حجرتي ، والحبشة يلعبون بالحراب ، ورسول الله – صلى الله عليه وسلم – يسترني بردائه لأنظر إلى لعبهم من بين أذنه وعاتقه ، ثم يقوم من أجلي حتى أكون أنا التي أنصرف ) رواه أحمد .
“আল্লাহর শপথ, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি, তিনি আমার ঘরের দরজায় দাঁড়াতেন, হাবশিরা যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে খেলা-ধুলা করত, আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে তার চাদর দিয়ে ঢেকে নিতেন, যেন আমি তাদের খেলা উপভোগ করি তার কাঁধ ও কানের মধ্য দিয়ে। অতঃপর তিনি আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতেন, যতক্ষণ না আমিই প্রস্থান করতাম”। {আহমদ}
যেহেতু প্রসিদ্ধ ছিল আয়েশাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট অন্য স্ত্রীদের তুলনায় বেশী প্রিয়, তাই সবাই অপেক্ষা করত আয়েশার ঘরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবে আসবেন, সে দিন তারা তাকে হাদিয়া ও উপহার সামগ্রী পেশ করত। {সহিহ বুখারি ও মুসলিমে অনুরূপ বর্ণনা এসেছে।}
তার প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বতের আরেকটি আলামত হচ্ছে, মৃত্যু শয্যায় তিনি আয়েশার নিকট থাকার জন্য অন্যান্য স্ত্রীদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছেন, যেন আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা তাকে সেবা শুশ্রূষা প্রদান করেন।
আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহার আরো একটি প্রসিদ্ধি ছিল যে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে আত্মসম্মান বোধ করতেন, রাসূলের প্রতি যা তার অকৃত্রিম ও সত্যিকার মহব্বতের প্রমাণ ছিল। তিনি তা এভাবে ব্যক্ত করেন :
” وما لي لا يغار مثلي على مثلك ؟ ” رواه مسلم .
“কেন আমার মত একজন নারী, আপনার মত একজন পুরুষকে নিয়ে কেন আত্মসম্মান বোধ করবে না ?” {মুসলিম}
একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ঘরে অবস্থান করছিলেন, রাসূলের অপর স্ত্রী খানাসহ একটি পাত্র তার নিকট প্রেরণ করেন, আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা পাত্রটি হাতে নিয়ে ভেঙ্গে ফেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খানা জমা করতে করতে বলতে ছিলেন :
( غارت أمكم ) رواه البخاري .
“তোমাদের মা ঈর্ষা ও আত্মসম্মানে এসে গেছে”। {বুখারি}
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই কোন নারীকে বিয়ে করতেন, আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা তাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন, যদি কোন বিশেষত্ব বা বৈশিষ্টের কারণে সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুকুল্য লাভ করে থাকে, তাহলে তিনিও তা অর্জন করার জন্য প্রতিযোগিতা করবেন। এ ঈর্ষা ও আত্মসম্মানের বিরাট একটি অংশ লাভ করেছেন খাদিজা রাদিআল্লাহু আনহা, কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে খুব স্মরণ করতেন।
কোন এক রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জান্নাতুল বাকিতে (কবরস্থানে) গমন করেন, আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা ধারণা করেন, তিনি হয়তো কোন স্ত্রীর ঘরে যাবেন, তাকে ঈর্ষায় পেয়ে বসল, তিনি তার পিছনে রওয়ানা দিলেন গন্তব্য জানার জন্য, অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে তিরষ্কার করে বলেন :
( أظننت أن يحيف الله عليك ورسوله ؟ ) رواه مسلم .
“তুমি কি ধারণা করেছ যে, তোমার উপর আল্লাহ ও তার রাসূল অন্যায় আচরণ করবে ?” {মুসলিম}
ফজিলত :
তার ফজিলত সম্পর্কে আলোচনা শেষ হবে না, শেষ হবারও নয়, তিনি ছিলেন সিয়াম পালনকারী, রাত জাগরণকারী মহিষী নারী, তিনি অনেক ভাল কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন, প্রচুর দান-সদকা করেছেন। তার অধিক দান-সদকার কারণে তার নিকট খুব কম অর্থ-সম্পদই বিদ্যমান থাকত। এক সময় তিনি একলাখ দিরহাম সদকা করেন, এক দিরহামও অবশিষ্ট রাখেননি নিজের কাছে।
আবু মুসা রাদিআল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন :
(كمُل من الرِّجال كثير ولم يكمل من النساء إلا مَريم بنتُ عمران ، و آسية امرأةُ فرعون ، وفضلُ عائشة على النساء كفضل الثريد على سائر الطعام) متفق عليه.
“পুরুষদের থেকে অনেকেই পূর্ণতা লাভ করেছে, কিন্তু নারীদের থেকে কেউ পূর্ণতা লাভ করতে পারেনি, তবে মারইয়াম বিনতে ইমরান, ফিরআউনের স্ত্রী ব্যতীত, আর আয়েশার ফজিলত অন্য নারীদের উপর যেমন সারিদের (সারিদ : গোস্ত ও রুটের মিশেলে তৈরি আরবদের নিকট এক প্রকার প্রিয় খাদ্য) ফজিলত সকল খাদ্যের উপর”। {বুখারি ও মুসলিম}
তার ফজিলতের আরো একটি উদাহরণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেন :
( يا عائشة هذا جبريل يقرأ عليك السلام ، فقالت : وعليه السلام ورحمة الله ) متفق عليه .
“হে আয়েশা, এ হচ্ছে জিবরিল, তোমাকে সালাম দিচ্ছে, তিনি বলেন : ওআলাইহিস সালাম ও রাহমাতুল্লাহ”। {বুখারি ও মুসলিম}
বয়স কম সত্বেও তিনি ছিলেন বুদ্ধিমতি, ধীমান ও দ্রুত আত্মস্থকারী। এ জন্যই তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অধিক ইলম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন, নারীদের মধ্যে তিনিই সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী। উম্মতে মুহাম্মাদিতে কোন নারী নেই, যিনি তার চেয়ে ইসলাম সম্পর্কে অধিক জ্ঞানের অধিকারী।
তার জ্ঞানের পরিচয় এ থেকেই পাওয়া যায় যে, আবু মুসা রাদিআল্লাহু আনহু বলেন :
“ما أشكل علينا أصحاب محمد – صلى الله عليه وسلم – حديثٌ قط فسألنا عائشة ، إلا وجدنا عندها منه علماً ” رواه الترمذي .
“মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবি, আমাদের উপর কোন বিষয় অস্পষ্ট ও জটিল হলে, আমরা আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহাকে জিজ্ঞাসা করতাম, তার নিকট সে বিষয়ে কোন না কোন ইলম অবশ্যই পেতাম”। {তিরমিযি}
মাসরুক রহ.-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল : আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা কি ফারায়েজ (উত্তরাধিকার বিধান) সম্পর্কে ভাল জানেন ? তিনি বলেন :
إي والذي نفسي بيده، لقد رأيت مشيخة أصحاب محمد – صلى الله عليه وسلم – يسألونها عن الفرائض ” رواه الحاكم .
“নিশ্চয়- আল্লাহর কসম যার হাতে আমার জীবন, আমি মুহাম্মদের বড় বড় সাহাবিদের দেখেছি, ফারায়েজ সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করতে”। {হাকেম}
জুহরি রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন :
لو ُجمع علم نساء هذه الأمة ، فيهن أزواج النبي – صلى الله عليه وسلم – ، كان علم عائشة أكثر من علمهنّ ” رواه الطبراني .
“যদি এ উম্মতের সকল নারীদের একত্র করা হয়, যার শামিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যান্য স্ত্রীগণও, তবুও আয়েশার ইলম তাদের ইলমের চেয়ে অধিক হবে”। {তাবরানি}
ইলমে ফিকাহ ও ইলমে হাদিসের পাশাপাশি কবিতা, জিকিৎসা বিজ্ঞান, আরবদের বংশ পরম্পরা বিষয়েও তিনি অধিক পাণ্ডিত্বের অধিকারী ছিলেন। এসব ইলম তিনি স্বামী ও নিজ পিতা থেকে অর্জন করেন। তার নিকট আরো ইলম ছিল আরবদের বিভিন্ন দল ও প্রতিনিধির, যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আগমন করেছিল।
এ উম্মতের উপর তার বরকত অনেক, তিনি কুরআনের বেশ কিছু আয়াত নাযিলের পটভূমি ছিলেন, তার মধ্যে রয়েছে তায়াম্মুমের আয়াত। একদা তিনি বোন আসমা রাদিআল্লাহু আনহা থেকে একটি হার ঋণ নেন, পরে তার থেকে যা হারিয়ে যায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কতক সাহাবিকে হার খুঁজে আনার জন্য প্রেরণ করেন, হার অনুসন্ধানে তাদের সালাতের সময় হয়ে যায়, তাদের নিকট পানি ছিল না, তাই তারা ওযু ব্যতীত সালাত আদায় করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে তারা অভিযোগ করেন, অতঃপর তায়াম্মুমের আয়াত নাযিল হয়, তখন উসাইদ ইব্ন হুজাইর আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহাকে বলেন :
” جزاكِ الله خيراً ، فوالله ما نزل بك أمر قط إلا جعل الله لكِ منه مخرجاً ، وجعل للمسلمين فيه بركة ” متفق عليه .
“আল্লাহ তোমাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন, তুমি যখনই কোন সমস্যায় পতিত হয়েছ, তোমার জন্য আল্লাহ তা থেকে মুক্তির পথ করে দিয়েছেন এবং মুসলিমদের জন্য তাকে বরকত রেখেছেন”। {বুখারি ও মুসলিম}
যখন আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা মিথ্যা অপবাদের ঘটনার শিকার হোন, আল্লাহ তার পবিত্রতা ঘোষণা করে আসমান থেকে কুরআন নাযিল করেন, কিয়ামত পর্যন্ত যা তিলাওয়াত করা হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
“নিশ্চয় যারা এ অপবাদ[1] রটনা করেছে, তারা তোমাদেরই একটি দল। এটাকে তোমরা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর মনে করো না, বরং এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তাদের থেকে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য রয়েছে, যতটুকু পাপ সে অর্জন করেছে। আর তাদের থেকে যে ব্যক্তি এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে, তার জন্য রয়েছে মহাআযাব। যখন তোমরা এটা শুনলে, তখন কেন মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা তাদরে নিজেদের সম্পর্কে ভাল ধারণা পোষণ করল না এবং বলল না যে, ‘এটা তো সুস্পষ্ট অপবাদ?”। {সূরা নূর : ১১-১২}
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিসতাহ ইব্ন আসাসাহ, হাস্সান ইব্ন সাবেত ও হামনাহ বিনতে জাহশকে অপবাদের শাস্তি প্রদানের নির্দেশ প্রদান করেন, এরা অশ্লীলতার অপপ্রচার করেছিল, ফলে তাদেরকে শাস্তি প্রদান করা হয়।
আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা সাতান্ন হিজরিতে মুত্যু বরণ করেন, তখন তার বয়স হয়েছিল তেষট্টির চেয়ে কিছু বেশী। তার সালাতে জানা পড়ান আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু। অতঃপর জান্নাতুল বাকিতে তাকে দাফন করা হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশে তার ঘরে তাকে দাফন করা হয়নি। কারণ, তিনি নিজের উপর প্রাধান্য দিয়ে ওমর ইব্ন খাত্তাব রাদিআল্লাহু আনহুকে সে জায়গাটি প্রদান করেন। আল্লাহ তাদের উপর ও সকল উম্মাহুতুল মুমিনদের উপর সন্তুষ্ট, তারাও তার উপর সন্তুষ্ট।
উম্মুল মুমেনিন আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহার সম্পর্কে আরো কিছু হাদিস ফজিলত :
এক. আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
اُرِيتُك في المنام ثلاث ليال جاءني بك المَلَك في سَرَقَةٍ من حرير فيقول هذه امرأتك، فأكشف عن وجهك فإذا أنت هي فأقول إن يَكُ هذا من عند الله يُمْضه. (رواه مسلم في صحيحه كتاب فضائل الصحابة رضي الله تعالى عنهم – فضائل عائشة أم المؤمنين رضي الله تعالى عنها، المجلد الثامن، الجزء الخامس عشر، صفحة : (202) دار إحياء التراث العربي، بيروت، الطبعة الثانية : 1392هـ – 1972 م).
“আমাকে তিন দিন স্বপ্নে দেখানো হয়েছে তোমাকে, রেশমের একটি পাত্রে তোমাকে নিয়ে এসে মালাক বলে এ হচ্ছে তোমার স্ত্রী, আমি তার চেহারা খুলে দেখি তুমিই সে নারী। অতঃপর আমি বলি, এটা যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়, তবে অবশ্যই তা বাস্তবায়ন হবে”। {মুসলিম- অষ্টম খণ্ড, পনেরতম অংশ, পৃষ্ঠা : (২০২) দারু ইহইয়াউত তুরাসিল আরাবি, বইরুত, দ্বিতীয় মুদ্রণ, হি.১৩৯২, ই.১৯৭২}
ইমাম নববি রহিমাহুল্লাহ বলেন : سَرَقَة সীন ও রা-তে ফাত্হ (জবর) বিশিষ্ট سَرَقَة শব্দের অর্থ রেশমের সাদা টুকরো। আর إن يك من عند الله يمضه অর্থ : এটা যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়, তাহলে অবশ্যই তিনি তা সত্যে রূপ দেবেন ও বাস্তবায়ন করবেন।
দুই. আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেন : তুমি কখন আমার উপর সন্তুষ্ট থাক আর কখন গোস্বা কর আমি তা বুঝতে পারি। তিনি বলেন, আমি বললাম : কিভাবে আপনি তা বুঝেন ? তিনি বললেন : তুমি যখন আমার উপর সন্তুষ্ট থাক, তখন বল, এমন নয়- মুহাম্মদের রবের কসম, আর যখন আমার উপর গোস্বা কর, তখন বল, এমন নয়- ইবরাহিমের রবের কসম। তিনি বলেন, আমি বললাম : অবশ্যই হে আল্লাহর রাসূল, তবে আমি শুধু আপনার নামটাই ত্যাগ করি”। {মুসলিম, অষ্টম খণ্ড, পনেরতম অংশ, পৃষ্ঠা : (২০৩) দারু ইহইয়াউত তুরাসিল আরাবি, বইরুত, দ্বিতীয় মুদ্রণ, হি.১৩৯২, ই.১৯৭২}
তিন. আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত :
 أنها كانت تلعب بالبنات عند رسول الله صلى الله عليه وسلم قالت: وكانت تأتيني صواحبي فكن يَنْقَمِعْنَ من رسول الله صلى الله عليه وسلم قالت فكان رسول الله صلى الله عليه وسلم يُسَرِِّبُهُن إلي. (رواه مسلم في صحيحه كتاب فضائل الصحابة رضي الله تعالى عنهم – فضائل عائشة أم المؤمنين رضي الله تعالى عنها، المجلد الثامن، الجزء الخامس عشر، صفحة 204 دار إحياء التراث العربي، بيروت، الطبعة الثانية 1392 ه – 1972م).
তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট খেলনা দিয়ে খেলতেন। তিনি বলেন, আমার বান্ধবীরা আমার কাছে আসত, তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (-কে দেখে তার) থেকে আড়ালে চলে যেত, তিনি তাদেরকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিতেন”। {মুসলিম, অষ্টম খণ্ড, পনেরতম অংশ, পৃষ্ঠা : (২০৪) দারু ইহইয়াউত তুরাসিল আরাবি, বইরুত, দ্বিতীয় মুদ্রণ, হি.১৩৯২, ই.১৯৭২}
البنات অর্থ : ছোট পুতুল, যা দিয়ে মেয়েরা খেলাধুলা করে। ইমাম নববি তার ব্যাখ্যায় বলেন : কাযি ‘আয়ায বলেছেন এ হাদিসে পুতুল দ্বারা খেলার বৈধতা রয়েছে, যেসব পুতুলের আকৃতি নিষিদ্ধ।
فكن يَنْقَمِعْنَ من رسول الله صلى الله عليه وسلم অর্থ : ইমাম নববি এর ব্যাখ্যায় বলেন : তারা লজ্জা ও ভয়ে আড়ালে চলে যেতেন, কখনো ঘর বা অন্য কোথাও প্রবেশ করত- এ অর্থই অধিক সঠিক।
يُسَرِِّبُهُن إلي অর্থ : ইমাম নববি এর ব্যাখ্যায় বলেন : তাদেরকে তিনি আমার কাছে পাঠিয়ে দিতেন, এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দয়া ও দাম্পত্য জীবনের একটি সুন্দর আচরণ।
চার. আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত :
أن الناس كانوا يَتَحَرَّوْن بهداياهم يوم عائشة يبتغون بذلك مرضاة رسول الله صلى الله عليه وسلم. (رواه مسلم في صحيحه كتاب فضائل الصحابة رضي الله تعالى عنهم – فضائل عائشة أم المؤمنين رضي الله تعالى عنها، المجلد الثامن، الجزء الخامس عشر، صفحة 205 دار إحياء التراث العربي، بيروت، الطبعة الثانية 1392 ه – 1972م).
“মানুষ তাদের হাদিয়া পেশ করার জন্য আয়েশার পালার অপেক্ষায় থাকত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য”। {মুসলিম, অষ্টম খণ্ড, পনেরতম অংশ, পৃষ্ঠা : (২০৫) দারু ইহইয়াউত তুরাসিল আরাবি, বইরুত, দ্বিতীয় মুদ্রণ, হি.১৩৯২, ই.১৯৭২}
পাঁচ. হিশাম তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, লোকেরা তাদের হাদিয়া পেশ করার জন্য আয়েশার দিনের অপেক্ষা করত। আয়েশা বলেন :
আমার সতিনরা উম্মে সালামার নিকট একত্র হয়, তারা বলে : হে উম্মে সালামা, লোকেরা তাদের হাদিয়ার জন্য আয়েশার পালার অপেক্ষা করে, আয়েশা যেমন কল্যাণের আশা করে আমরাও তেমন আশা করি, তুমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বল, তিনি মানুষদের বলে দেবে, তিনি যেখানে থাকেন অথবা যে ঘরেই থাকেন, তারা যেন তার নিকট হাদিয়া পেশ করে। তিনি বলেন : উম্মে সালামা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা বলে শোনান। উম্মে সালামা বলেন : তিনি আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। তিনি পুনরায় যখন আমার কাছে আসেন, আমি তাকে তা স্মরণ করিয়ে দেই, তিনি আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। যখন তৃতীয়বার আমি তাকে স্মরণ করিয়ে দেই, তিনি বলেন : হে উম্মে সালামা তুমি আয়েশার ব্যাপারে আমাকে কষ্ট দিয়ো না। আল্লাহর শপথ, একমাত্র সে ব্যতীত আমি তোমাদের কারো লেপে থাকাবস্থায় অহী নাযিল হয়নি”। {বুখারি : ৩৫১৫}
ছয়. মুহাম্মদ ইব্ন আব্দুর রহমান ইব্ন হারেস ইব্ন হিশাম থেকে বর্ণিত : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা বলেছেন :
“রাসূলের অন্যান্য স্ত্রীগণ ফাতেমা ব্নিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট প্রেরণ করেন, তিনি ঘরে প্রবেশ করার অনুমতি চান, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার বিছানায় আমার সাথে শয়নাবস্থায় ছিলেন, তিনি তাকে অনুমতি দেন, অতঃপর সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল, আপনার স্ত্রীরা আমাকে আপনার কাছে প্রেরণ করেছেন, তারা আপনার কাছে ব্নিতে কুহাফার সাথে ইনসাফ চায়, আমি তখন চুপ। আয়েশা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন : হে আদরের মেয়ে, আমি যা পছন্দ করি, তুমি কি তা পছন্দ কর না ? সে বলল : অবশ্যই। তিনি বললেন : অতএব একে মহব্বত কর। আয়েশা বলেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ কথা শোনে ফাতেমা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যান্য স্ত্রীদের কাছে ফিরে গিয়ে তার কথা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উত্তর শোনাল, তারা তাকে বলল : তুমি আমাদের কোন কাজই করনি। তুমি আবার ফিরে গিয়ে বল : আপনার স্ত্রীরা আবু কুহাফার মেয়ের ব্যাপারে ইনসাফের কসম দিচ্ছে। ফাতেমা বলল : আল্লাহর কসম আমি তার ব্যাপারে কোন কথা বলব না। আয়েশা বলেন : অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীরা যয়নব বিনতে জাহশ রাসূলের স্ত্রীকে প্রেরণ করেন, তাদের তুলনায় তাকেই তারা রাসূলের নিকট আমার সমকক্ষ মনে করত, আমি যয়নাবের মত দীনদার কোন নারী দেখিনি, খুব মুত্তাকি, সত্যবাদী, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারী, প্রচুর সদকাকারী, তবে কঠোর মেজাজের কারণে তার মধ্যে গোস্বার প্রবণতা বেশী ছিল, কিন্তু যখন তা প্রকাশ পেত, খুব দ্রুত তিনি গোস্বা প্রশমিত করে নিতেন। আয়েশা বলেন : সে এসে রাসূলের নিকট অনুমতি চায়, তিনি তাকে অনুমতি দেন, তখনও তিনি আয়েশার বিছানায় তার সাথে সে অবস্থায়ই ছিলেন, ফাতেমা যে অবস্থায় দেখেছিল। সে বলল হে আল্লাহর রাসূল, আপনার স্ত্রীরা আমাকে আপনার নিকট প্রেরণ করেছে, তারা আপনার নিকট বিনতে আবু কুহাফার ব্যাপারে ইনসাফ তলব করে। আয়েশা বলেন : অতঃপর সে আমাকে ভৎর্সনা আরম্ভ করে আমার উপর চটে যায়, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখতে ছিলাম, পর্যবেক্ষণ করতে ছিলাম তার চোখের পলক, তিনি আমাকে এ ব্যাপারে অনুমতি দেন কি না, যয়নব আমার উপর চটেই যেতে ছিল, অবশেষে আমি লক্ষ্য করলাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার প্রতিশোধ গ্রহণ অপছন্দ করবেন না, অতঃপর আমি যখন তাকে প্রতি উত্তর আরম্ভ করি, তাকে কোন সুযোগ দেয়নি, আমি আমার প্রতিশোধ নিয়ে নেই। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসলেন আর বললেন : নিশ্চয় এ হচ্ছে আবু বকরের মেয়ে”। {মুসলিম, অষ্টম খণ্ড, পনেরতম অংশ, পৃষ্ঠা : (২০৫-২০৭) দারু ইহইয়াউত তুরাসিল আরাবি, বইরুত, দ্বিতীয় মুদ্রণ, হি.১৩৯২, ই.১৯৭২}
مرطي অর্থ : উল অথবা রেশমের কাপড়, সেলাই বিহীন প্রত্যেক কাপড়কেই এ নামে অবিহিত করা হয়।
يسألنك العدل في ابنة أبي قحافة অর্থ : ইমাম নববি এর ব্যাখ্যায় বলেন : তারা অন্তরের মহব্বতের ব্যাপারে পীড়াপীড়ি করছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের মাঝে কর্ম, রাত যাপন ইত্যাদিতে সমতা রক্ষা করতেন, কিন্তু অন্তরের মহব্বত হিসেবে আয়েশাকে তাদের সবার চাইতে বেশী ভালবাসতেন। সকল মুসলিম ঐক্যমত যে, অন্তরের উপর আল্লাহ তা‘আলা চাপিয়ে দেননি, এ ব্যাপারে সমতা রক্ষা করাও জরুরী নয়, কারণ এর উপর আল্লাহ ব্যতীত কারো কুদরত নেই, শুধু কর্মের ব্যাপারে ইনসাফের নির্দেশ রয়েছে।
فأحبي هذه অর্থ : আয়েশাকে মহব্বত কর।
ما نراك أغْنَيت عنا অর্থ : আমরা তোমরা দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যা আশা করেছিলাম, তুমি তার কিছুই করতে পারনি।
تساميني অর্থ : ইমাম নববি এর ব্যাখ্যায় বলেন : তারা তাকে সম্মান ও মর্যাদার ব্যাপারে আমার সমকক্ষ মনে করত।
ما عدا سَوْرَةً من حِدَّةٍ كانت فيها تُسْرِعُ منها الفيئة অর্থ : তিনি পরিপূর্ণ গুনের অধিকারী ছিলেন, কিন্তু তিনি কড়া মেজাজের ছিলেন, দ্রুত গোস্বা করতেন, তবে রাগান্বিত হলে সাথেই তা দমন করে নিতেন, তার উপর জেদ ধরতেন না।
ثم وقعَتْ بي فاستطالت علي অর্থ : অতঃপর সে আমার উপর আক্রমণ আরম্ভ করে, দীর্ঘক্ষণ আমাকে আক্রমণ করে।
فلما وقعْتُ بها لم أنْشَبْها حتى أنْحَيْتُ عليها অর্থ : আমি তাকে তিরষ্কার আরম্ভ করে তাকে কোন সুযোগ দেয়নি, অবশেষে আমি তার থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করি।
ইমাম নববি এর ব্যাখ্যায় বলেন, এখানে এর কোন প্রমাণ নেই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়েশাকে অনুমতি দিয়েছেন, না তাকে চোখে ইশারা করেছেন, না অন্য কোনভাবে। আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহার কথার অর্থ হচ্ছে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চোখ পর্যবেক্ষণ করছিলাম, কিন্তু যয়নব বিরতিহীন আমাকে বলে যাচ্ছে দেখে, আমি বুঝতে পারি যে, আমি প্রতিশোধ গ্রহণ করলে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা অপছন্দ করবেন না। অতঃপর ইমাম নববি বলেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চোখ দিয়ে ইশারা করবেন এটা বিশ্বাস করাও বৈধ নয়, কারণ তার উপর চোখের খিয়ানত হারাম ছিল, এখানে শুধু এতটুকু বিদ্যমান যে, আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা নিজের প্রতিশোধ নিয়েছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে নিষেধ করেননি।
إنها ابنة أبي بكر অর্থ : এর দ্বারা তার সমঝ ও বিতর্কে বিজয়ের দিকে ঈঙ্গিত করা হয়েছে।
সাত. আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :
إنْ كان رسول الله صلى الله عليه وسلم ليتفقد يقول أين أنا اليوم أين أنا غدا استبطاء ليوم عائشة قالت: فلما كان يومي قبضه الله بين سَحْري ونحري. (رواه مسلم في صحيحه كتاب فضائل الصحابة رضي الله تعالى عنهم – فضائل عائشة أم المؤمنين رضي الله تعالى عنها، المجلد الثامن، الجزء الخامس عشر، من صفحة : (208) دار إحياء التراث العربي، بيروت، الطبعة الثانية 1392 هـ – 1972 م).
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুসন্ধান করতেন, আর বলতেন আজ আমি কার ঘরে, আমি আগামি কাল কার ঘরে, যেন আয়েশার দিন খুব দেরিতে আসছে, তিনি বলেন : অতঃপর যখন আমার নাম্বার আসে, আল্লাহ তাকে আমার বুক ও গলার মাঝ থেকে কব্জা করে নেন”। {মুসলিম, অষ্টম খণ্ড, পনেরতম অংশ, পৃষ্ঠা : (২০৮) দারু ইহইয়াউত তুরাসিল আরাবি, বইরুত, দ্বিতীয় মুদ্রণ, হি.১৩৯২, ই.১৯৭২}
استبطاء ليوم عائشة অর্থ : আয়েশার প্রতি অধিক মহব্বতের কারণে, যেন তার সিরিয়াল আসতে খুব দেরি হচ্ছে মনে করতেন।
فلما كان يومي قبضه الله অর্থ : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগ্রহ দেখে সবাই তাকে আয়েশার ঘরে থাকার অনুমতি দেন, অন্তিম সময়ে তিনি তার সেবাই গ্রহণ করেন, যখন আয়েশার পালার দিনটি আসে, আল্লাহ তার রূহ কব্জা করেন। অর্থাৎ যদি মনে করা হয়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার স্ত্রীগণ অনুমতি দেননি, প্রত্যেকের ঘরেই পালাক্রমে থেকেছেন, তবুও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর দিনটি আয়েশার পালার দিন হতো।
قبضه الله بين سحري ونحري অর্থ : আল্লাহ তাকে আমার বুক ও গলার মাঝখান থেকে কব্জা করেছেন।
আট. আনাস ইব্ন মালেক রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :
“আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শোনেছি, তিনি বলতেন : সকল নারীদের উপর আয়েশার ফযিলত তেমনি, যেমন সারিদের ফযিলত সকল খাদ্যের উপর”। {মুসলিম, অষ্টম খণ্ড, পনেরতম অংশ, পৃষ্ঠা : (২১১) দারু ইহইয়াউত তুরাসিল আরাবি, বইরুত, দ্বিতীয় মুদ্রণ, হি.১৩৯২, ই.১৯৭২}
হাসান ইব্ন জায়েদ ইব্ন আলী ইব্ন হুসাইন ইব্ন আলী ইব্ন আবি তালিব রাদিআল্লাহু আনহুর দরবারে এক লোক উপস্থিত ছিল, সে আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহাকে অশ্লীলতাসহ উল্লেখ করে। হাসান বললেন :
فقال الحسن يا غلام، اضرب عنقه، فقال له العلويون هذا رجل من شيعتنا، فقال معاذ الله، هذا رجل طعن على النبي،
হে যুবক, তার গর্দান উড়িয়ে দাও। আলী পন্থী লোকেরা বলল, সে তো আমাদের শী‘আ পন্থী! তিনি বললেন : মা‘আ-যাল্লাহ (আল্লাহর কাছে পানাহ চাই), সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অপবাদ দিয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
ﭽﯛ  ﯜ  ﯝ  ﯞﯟ   ﯠ  ﯡ  ﯢ  ﯣﯤ ﭼ النور: ٢٦   فإن كانت عائشة خبيثة فالنبي خبيث، فهو كافر، فاضربوا عنقه، فضرب عنقه. (الصارم المسلول)
“দুশ্চরিত্রা নারীরা দুশ্চরিত্র পুরুষদের জন্য এবং দুশ্চরিত্র পুরুষরা দুশ্চরিত্রা নারীদের জন্য। আর সচ্চরিত্রা নারীরা সচ্চরিত্র পুরুষদের জন্য এবং সচ্চরিত্র পুরুষরা সচ্চরিত্রা নারীদের জন্য”। {সূরা নূর : ২৬} অতএব আয়েশা যদি দুশ্চরিত্রা হয়, তাহলে আমাদের নবীও দুশ্চরিত্র ! সে কাফের, তার গর্দান উড়িয়ে দাও। অতঃপর তার গর্দান উড়িয়ে দেয়া হয়”। {সারিমুল মাসলুল}
আবু মুহম্মাদ ইব্ন হাযম জাহেরি নিজ সনদে হিশাম ইব্ন আম্মার থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন : আমি মালেক ইব্ন আনাসকে বলতে শোনেছি, আবু বকর ও ওমরকে যে গালি দেবে, তাকে দোররা মারা হবে, আর আয়েশাকে যে গালি দেবে, তাকে হত্যা করা হবে। তাকে বলা হল : আয়েশার ব্যাপারে কেন হত্যা করা হবে ? তিনি বললেন : আল্লাহ তা‘আলা আয়েশার ব্যাপারে বলেছেন :
“আল্লাহ তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন যে, যদি তোমরা মুমিন হও, তাহলে আর কখনো এর পুনরাবৃত্তি করবে না”। {সূরা নূর : ১৭}
অতএব যে তাকে অপবাদ দিল, সে কুরআনের বিরোধিতা করল, আর কুরআনের বিরোধিতাকারী হত্যার উপযুক্ত।
আবু মুহাম্মদ রাহিমাহুল্লাহ বলেন : মালেকের কথা এখানে সঠিক, তাকে গালি দেয়া পরিপূর্ণ কুফরী এবং আল্লাহকে মিথ্যারোপ করা, কারণ তিনি তার পবিত্রতার ঘোষণা দিয়েছেন। {মুহাল্লা : ১৩/৫০৪}
আবুল হাসান সাকলি বর্ণনা করেন, কাজি আবু বকর তৈয়ব বলেছেন : আল্লাহ যখন কাফেরদের আরোপ করা অপবাদগুলো উল্লেখ করেন, তখন তিনি নিজেই নিজের পবিত্রতা ঘোষণা করেন, যেমন তিনি বলেছেন :
“তারা বলে, আল্লাহ সন্তন গ্রহণ করেছেন। তিনি পবিত্র মহান”। (সূরা ইউনুস : ৬৮)
অনুরূপ মুনাফিকরা আয়েশার উপর যে অপবাদ আরোপ করেছে, তা উল্লেখ করার সময়ও তিনি পবিত্রতার ঘোষণা দেন, যেমন তিনি বলেন :
“আর তোমরা যখন এটা শুনলে, তখন তোমরা কেন বললে না যে, এ নিয়ে কথা বলা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি অতি পব্রিত মহান”। (সূরা নূর : ১৬)
আল্লাহ আয়েশার পবিত্রতা ঘোষণার সময় অনুরূপ নিজের প্রশংসা করেছেন, যেমন তিনি পবিত্রতা ঘোষণা করার সময় করেছেন। এর মধ্যে মালেকের কথা “আয়েশাকে গাল-মন্দকারীকে হত্যা করা হবে” এর সমর্থন রয়েছে। এর অর্থ আয়েশার অপবাদ আল্লাহর নিকট এতটাই মারাত্বক, যতটা স্বয়ং তাকে গালি দেয়া মারাত্বক, কারণ আয়েশাকে গালি দেয়া মূলত তার নবীকে গালি দেয়া। আর আল্লাহ তা‘আলা তার নবীকে গালি ও কষ্ট দেয়া, নিজের কষ্টের সাথে তুলনা করেছেন, আর আল্লাহকে কষ্ট দানকারীর শাস্তি হল হত্যা, অতএব তার নবীকে কষ্ট দানকারীর শাস্তিও হত্যা। আল্লাহ ভাল জানেন”। {কাজি ‘আয়ায প্রণিত ‘আশ-শিফা’ : ২/২৬৭-২৬৮}
সমাপ্ত
[1] এটি উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহার প্রতি মিথ্যা অপবাদের ঘটনা। ৬ষ্ঠ হিজরীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু মুস্তালিক যুদ্ধ থেকে ফিরার পথে একস্থানে রাত্রিযাপনের জন্য অবস্থান করেন। রাতের শেষ ভাগে আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা প্রাকৃতিক প্রয়োজনে একটু দূরে যান। কিন্তু পথে তিনি তার গলার হারটি হারিয়ে ফেলেন। তিনি তার খুঁজতে থাকেন। এদিকে কাফেলা রওনা হয়ে যায়। তিনি হাওদার ভিতরেই আছেন মনে করে কেউ তার খোঁজ করেনি, কারণ তার শারীকি গড়ন ছিল হালকা। হার খুঁজে পেয়ে তিনি এসে দেখেন যে, কাফেলা চলে গেছে। তখন তিনি ছুটাছুটি না করে সেখানেই বসে পড়েন। এ আশায় যে কাফেলার রেখে যাওয়া মালামালের সন্ধানে নিয়োজিত কোন লোক আসবেন। অবশেষে এ কাজে নিয়োজিত সাফওয়ান রাদিআল্লাহু আনহা সকাল বেলায় আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহাকে দেখতে পেলেন এবং নিজের উটে তাকে আরোহণ করিয়ে নিজে পায়ে হেটে উটের রশি টেনে সসম্মানে তাকে নিয়ে কাফেলার সাথে মিলিত হন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ ইব্ন উবাই কয়েকজনকে সাথে নিয়ে আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহার ব্যাপারে মিথ্যা অপবাদ রটাতে থাকে। অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতগুলো নাযিল করে আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহাকে নির্দোষ ঘোষণা করেন এবং অপবাদ রটনাকারীদের কঠোর শাস্তির কথা জানিয়ে দেন। এই ঘটনাটি ‘ইফক’ এর ঘটনা হিসেবে প্রসিদ্ধ।
_________________________________________________________________________________
লেখক: সানাউল্লাহ নজির আহমদ
সম্পাদনা: ড. আবু বকর মো. যাকারিয়া
সূত্র: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব

No comments:

Post a Comment

সাম্প্রতিক পোষ্ট

"যারা facebook চালায় তারা কখনই ভাল মুসলিম হতে পারে না" "FB তো ইহুদীর আবিষ্কার"?

"যারা facebook চালায় তারা কখনই ভাল মুসলিম হতে পারে না" "FB তো ইহুদীর আবিষ্কার" . "আপনি এত ইসলাম মানেন তাহলে f...

জনপ্রিয় পোষ্ট সমুহ