মুসলমানের ভাললাগা ও ভালবাসা এবং ইসলামের হুকুম – “আল-ওয়ালা ওয়া আল-বারা”-মুল: ডঃ সালেহ আল ফাওযান
আমরা, বাংলাদেশের মুসলিমরা হয়তো জানিই না যে, কুর’আনে এমন একটি আয়াত রয়েছে!
لَا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَوْ كَانُوا آَبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ أُولَئِكَ كَتَبَ فِي قُلُوبِهِمُ الْإِيمَانَ وَأَيَّدَهُمْ بِرُوحٍ مِنْهُ وَيُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ أُولَئِكَ حِزْبُ اللَّهِ أَلَا إِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান আনে এমন কোন সম্প্রদায়কে তুমি পাবে না এমন লোকদেরকে ভালোবাসতে, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধীতা করে – যদি সেই বিরুদ্ধচারীরা এমন কি তাদের পিতা, পুত্র, ভাই অথবা জ্ঞাতি-গোষ্ঠী হয় তবুও। এদের অন্তরে আল্লাহ ঈমান লিখে দিয়েছেন এবং তাঁর পক্ষ থেকে রূহ দ্বারা তাদের শক্তিশালী করেছেন। তিনি তাদের প্রবেশ করাবেন এমন জান্নাতসমূহে যার নিচে দিয়ে ঝর্ণাধারাসমূহ প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। এরা হল আল্লাহর দল। জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহর দলই সফল কাম। (সূরা মুজাদালা, ৫৮:২২)
এখানে তিনটা জিনিসের প্রতি লহ্ম রাখা দরকার:
প্রথমত, কারো ঈমানের ব্যাপারে আমরা যদি গুরুতর সন্দেহে থাকি, যেমন ধরুন প্রয়াত আহমেদ শরীফ বা হুমায়ূন আযাদ – তাহলে তার জন্য তার মৃত্যুর পরে, দোয়া করার আগে আমরা সাবধান হবো এবং জেনে নিতে চেষ্টা করবো যে, “গুরুতর সন্দেহের” কারণ ঘটার পর, অন্তত তিনি নিজে কখনো নিজেকে মুসলিম বলে দাবী করেছেন কি না। আর যদি আমরা নিশ্চিত হই যে, তারা ইসলামের বাইরেই ছিলেন, তবে তাদের জন্য কিছুতেই দোয়া করা জায়েয না – তারা যত বড় ব্যক্তিত্বই হোন না কেন! (বাংলাদেশের মানুষ অবশ্য খুব generous – এদেশে হুমায়ূন আযাদের জানাজা হয়েছে)
সে রকম কারো মৃত্যুতে আমরা উল্লসিত হবো হবো এমন কোন কথা নেই – তবে “গুরুতর সন্দেহ” থাকলে আমরা safe side-এ থাকতে চুপ থাকতে পারি, যেমনটা একজন ‘আলেম ব্লগার বলেছেন। আবারও বলছি এটা কেবল যাদের ব্যাপারে “গুরুতর সন্দেহ” রয়েছে, তাদের বেলায় প্রযোজ্য। একজন সাধারণ মুসলিম, যিনি নিজেকে মুসলিম বলে দাবী করতেন, আমরা সব সময় তার জন্য মাগফেরাত কামনা করবো।
দ্বিতীয়ত, যারা আল্লাহ্, আল্লাহর রাসূল(সা.) বা ইসলামের বিরোধীতা করে থাকেন, তাদেরকে কিছুতেই বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না, ভালোবাসা যাবে না – এমন কি যদি তারা আমাদের বাবা, ভাই বা নিকটাত্মীয়ও হয়ে থাকেন। আমাদের বন্ধুত্ব বা ভালোবাসা কে পাবে অথবা আমরা কাকে ভালোবাসবো এবং কাকে ভালোবাসবো না – এটা আল্লাহ্ নির্ধারণ করে দিয়েছেন একটা মূলনীতির মাধ্যমে, যেটাকে বলা হয়: “আল-ওয়ালা ওয়া আল-বারা” । আমরা গত পর্বে যেমন বলেছি, এই মূলনীতি মেনে চলাটা হচ্ছে ঈমানের শর্ত – এই ব্যাপারটাই হচ্ছে আমাদের এই সিরিজের “সার কথা”।
তৃতীয়ত, যারা পাপকর্মের জন্য বা দ্বীন ইসলামের নিয়মনীতি বিরুদ্ধ কাজের জন্য বিখ্যাত (সিনেমা, নাচ, গান, অশ্লীল সাহিত্য ইত্যাদি ইত্যাদি), তাদের মৃত্যুর পরে (এবং এমন কি তাদের জীবদ্দশায়ও) তাদের ঐ সমস্ত কাজ – তা দেশের জন্য বা তাদের জন্য যত বড় সম্মানই বয়ে আনুক না কেন – আমরা সেগুলোকে appreciate করে তাদের, আমাদের জন্য আদর্শ করে তুলবো না – ইসলামের দৃষ্টিতে যে খলনায়ক, তাকে মহানায়ক বানাবো না। বরং তাদেরকে মুসলিম জানলে তাদের জন্য দোয়া করবো যে, আল্লাহ্ যেন তাদের ঐ পাপ-কর্মগুলোকে ক্ষমা করে দেন। প্রচার-প্রচারণা বা স্তব-স্তুতির মাধ্যমে খলনায়কও মহা নায়ক হয়ে যায় এবং না জেনেই মানুষ তাদের অনুসরণ করতে শুরু করে। কালই আরেকজনের ব্লগে কামাল আতাতুর্ক-এর উপর একটা লেখায় আমি এরকম মন্তব্য করলাম:
“গত ২ শতাব্দীতে যে তিনজন মুসলিম নামধারী ইসলামের সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করেছেন, তাদের একজন হচ্ছেন কামাল আতাতুর্ক – বাকী দুজন হচ্ছেন মুহাম্মদ আব্দুহ্ ও স্যার সৈয়দ আহমেদ। অথচ, অজ্ঞতার বশবর্তী হয়ে সাধারণ মুসলিমরা এই তিনজনকে নিয়েই বেশ গর্ব করে থাকেন – ঠিক যেমন প্রয়াত তারেক মাসুদকে নিয়ে কথিত ইসলামপন্থীদের একটা অংশের “আহ্-উহু”-র অন্ত নেই! আমরা বলছি না যে, ইসলামবিদ্বেষী কারো মৃত্যুতে আমাদের উল্লাস করতে হবে! কিন্তু তাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে মহাপুরুষ বানানো মারাত্মক ভুল – কেননা তাতে অজ্ঞ সাধারণ মুসলিমরা তাকে role-model মনে করতেই পারেন!!”
যাহোক আজ আমরা “আল-ওয়ালা ওয়া আল-বারা”-র বহিপ্রকাশ বা আলামত সম্বন্ধে আলাপ করবো ইনশা’আল্লাহ! তার আগে বলে নিই “আল-ওয়ালা ওয়া আল-বারা”-এর বিভাজন রেখাটা প্রাথমিকভাবে ঈমানের বিভাজন রেখা – কাফির-মুশরিক কখনোই আমাদের ভালোবাসা বা বন্ধুত্ব পাবার যোগ্য নয়, আমাদের ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের দাবীদার হচ্ছেন আমাদের মুসলিম ভাই-বোনেরা। এদিক থেকে দেখলে পৃথিবীর জনসংখ্যাকে, “আল-ওয়ালা ওয়া আল-বারা”-র ভিত্তিতে ২ টি শ্রেণীতে ভাগ করার কথা – কিন্তু আমরা যে বইয়ের সূত্র থেকে বাকী আলোচনাটুকু করবো সেই বইয়ের লেখক – বর্তমান পৃথিবীর জীবিত আলেমদের মাঝে সবচেয়ে সম্মানিতদের একজন ড.সালিহ্ আল ফাওযান সহ বড় ‘আলেমরা “আল-ওয়ালা ওয়া আল-বারা”-র ভিত্তিতে পৃথিবীর মানুষকে ৩টি শ্রেণীতে ভাগ করেন:
১) যাদেরকে আমরা সব সময় ভালোবাসবো – কখনোই ঘৃণা করবো না। যেমন: নবীগণ, সিদ্দিকগণ, শহীদগণ ও সৎকর্মশীলগণ।
২)যাদেরকে পরিপূর্ণরূপে ঘৃণা করবো – কোন ভালোবাসা ছাড়া। যেমন; কাফির-মুশরিকগণ।
এখানে একটু ছোট্ট ব্যাখ্যার অবকাশ রয়েছে – ভালোবাসা আর দয়া/করুণা কিন্তু এক ব্যাপার নয়। ধরুন আপনার গাড়ীর ধাক্কায় একটা লোক আহত হলো – আপনি তাকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার আগে নাম জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়ার প্রয়োজন নেই যে সে মুসলিম না কাফির – এটা দয়া বা করুণা থেকেই আপনি যে কারো জন্য করবেন। “ওয়ালা” – শব্দটিতে একটা belonging-এর বা “নিজেদের একজন মনে করার” একটা sense আছে। মুসলিমদের জন্য একজন কাফির/মুশরিককে নিজেদের একজন বা বন্ধু মনে করার কোন অবকাশ নেই।
৩)যাদের ভালোসার কারণ যেমন রয়েছে, তেমনি ঘৃণা করার কারণও রয়েছে। -এরা হচ্ছেন মূলত মুসলিম – কিন্তু তারা কবীরা গুনাহে লিপ্ত হয়েছেন। তাদের ঈমানের জন্য বা সৎকাজের জন্য তাদের আমরা তাদের ভালোবাসবো এবং তাদের পাপাচারের জন্য আমরা তাদের ঘৃণা করবো।
[দেখুন: Page#30-34, Al-Walaa wa al-Baraa fil Islam – Dr. Saleh al-Fawzan]
যাহোক “আল-ওয়ালা ওয়া আল-বারা” – যা কিনা ঈমানের শর্ত বলে আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি তা এবং “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্” ঘোষণার (অর্থাৎ তা কবুল হবার) শর্তগুলোর* অন্যতম একটা আমাদের কাছে যা ultimately দাবী করে তা হচ্ছে, “আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্য ঘৃণা করা” – আপনি যা কিছু ভালোবাসবেন তা আল্লাহর জন্যই ভালোবাসবেন, আবার যা কিছু ঘৃণা করবেন, তাও আল্লাহর জন্য ঘৃণা করবেন – যা হচ্ছে ঈমানের একটা ultimate বা চূড়ান্ত ধাপ – যা অর্জন করা সাধনার ব্যাপার – তবে আমরা সবাই সাধ্যমত চেষ্টা করবো ইনশা’আল্লাহ্।
*************************************************
যাহোক আজকের পর্বে এগিয়ে যাবার আগে আরেকটা ব্যাপার একটু খোলাসা করে নেই: আপনারা এই আয়াতের “শানে নুযুল” বা “সাবাব আন-নুযুল” কি – সেটা জানেন? ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বীরদের একজন এবং নাম ধরে এক এক করে রাসূল (সা.) যে দশজন সাহাবীকে(রা.) তাদের জীবদ্দশায় জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছিলেন – সেই “আশারা মুবাশ্বারা”র একজন: আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ – বদর যুদ্ধে কাফির পক্ষে অংশগ্রহণকারী তাঁর পিতাকে হত্যা করে “আল-ওয়ালা ওয়া আল-বারা” চূড়ান্ত মূল্য দেন! এই আয়তটি নাযিল হয়েছিল সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
মাননীয় পাঠক, আর আমাদের “ওয়ালা” (বন্ধুত্ব বা ভালোবাসা) কোথায়? যারা ইসলামকে ব্যঙ্গ করে বা কটাক্ষ করে সিনেমা বানায়, গান লেখে, কবিতা লেখে, নাটক লেখে বা গল্প লেখে তারাই আমাদের কাছে প্রিয়, শ্রদ্ধেয় ও “মূল্যবান ব্যক্তিত্ব” – তাদের মৃত্যুতে বা বিপদে আমরা স্বজন হারানোর মাতম করি, দেশের সুশীল মহিলারা যেন সবাই বিধবা হয়ে যান। আমি আবারো বলছি কারো মৃত্যুতে উল্লাস করার কিছু হয়তো নেই, কিন্তু ভাবার অনেক কিছু আছে – আমরা কাদেরকে ভালোবাসি, আমাদের হৃদয়টা কোথায় বাঁধা, আমাদের আনুগত্য কোথায় – “আমরা পৃথিবীতে যাদের ভালোবাসবো, ক্বিয়ামতে তাদের সাথে পুনরুত্থিত হবো” – সহীহ হাদীসের আলোকে এই সম্ভাবনার কথা কি আমরা ভেবে দেখি? দেখি নি! চলুন আমি প্রমাণ করে দিচ্ছি:
নীচের লিংকে একটা খবর ছাপা হয়ে ছিল – প্রথমত কয়জন এই খবরটা জানেন?
জেনে থাকলে আপনার তা আপনার হৃদয়ে কেমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে??
খবরটা ক্বারী মুহাম্মদ ওবায়দুল্লাহকে নিয়ে – জাতীয় পর্যায়ের ইসলামী ব্যক্তিত্ব – সারাটা জীবন ইসলামের খেদমতে ছিলেন! কিন্তু গত পাঁচ বছর ধরে তিনি বাকরুদ্ধ। তার কণ্ঠে সেই কুর’আনের সুমধুর তেলাওয়াত আর শোনা যায় না। তাঁর ডান হাতটিও পক্ষাঘাতে আক্রান্ত। আপনি কি জানতেন যে, মূলত অর্থের অভাবে এমন একজন ব্যক্তির চিকিৎসা হচ্ছে না??!! না, আমাদের বেশীর ভাগই হয়তো জানি না – কিন্তু “কান” উৎসবে পুরস্কারপ্রাপ্ত, ইসলামকে কটাক্ষ করে বানানো বাংলা চলচ্চিত্রটা কে বানিয়েছিলেন জিজ্ঞেস করা হলে অথবা জাফর ইকবালের সর্ব-সাম্প্রতিক বইয়ের নাম কি জিজ্ঞেস করা হলে আমাদের এই ব্লগের ১০০% সদস্যই হয়তো উত্তর দানে কামিয়াব হবেন – তাই না?? এবার আপনিই বিচার করুন আপনার “ওয়ালা” (বন্ধুত্ব বা ভালোবাসা) কোথায়? আর আপনি যদি বিশ্বাসী মুসলিম হয়ে থাকেন, তবে আপনি কি ভয়াবহ পরিণতির সম্ভাবনার সম্মুখীন (নাউযুবিল্লাহ্!)!!
আপনার কাছে ইসলাম যে “আল-ওয়ালা ওয়া আল-বারা” দাবী করে, সেই অনুযায়ী আপনি সঠিক অবস্থানে আছেন কি না – তা আপনি নিজেই নিজের খুব ছোট ছোট ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকে বিচার করতে পারবেন বা বুঝতে পারবেন (অবশ্য আপনি যদি জেগেও ঘুমিয়ে থাকবেন বলে প্রতিজ্ঞা করে থাকেন – তবে ভিন্ন কথা)। একটা উদাহরণ তো উপরে দিলাম। আরেকটা উদাহরণ দেই – বাজারে সবজী কিনতে গিয়েছেন – ধরুন বেগুন। দেখলেন একজন সবজী বিক্রতা দাড়ি-টুপি পরে বসে রয়েছেন বেগুণ নিয়ে – আরেকজনকে দেখলেন দাড়ি-টুপি বিহীন, বিড়ি ফুকছেন আর mp3 সম্বলিত মোবাইলে “জাম্বুরা মার্কা” গান শুনছেন। ইসলামের “আল-ওয়ালা আল-বারা”-র মূলনীতি আপনাকে বলবে প্রথম ব্যক্তিটির প্রতি দয়াদ্র হতে এবং তা হলে – দু’জনের বেগুনের গুন যদি সমান হয়, তবে আপনি সেই স্নেহ বশত প্রথম জনের কাছ থেকেই বেগুন কিনবেন!
এবার আসুন, গত পর্বে, বর্তমান সময়ের একজন বিশ্বমানের স্কলারের কথা বলেছিলাম: Dr. Saleh al-Fawzan – তার বই Al-Walaa wa al-Baraa fil Islam থেকে “আল-ওয়ালা ওয়া আল-বারা”-র নিরিখে আপনার/আমার অবস্থান কি, সেটা জানবার উপায় হিসেবে যে সব “আলামত দেয়া আছে সেগুলো একটু বিবেচনা করা যাক।
আপনার আনুগত্য, বন্ধুত্ব যে অবিশ্বাসীদের কাছে বাঁধা পড়ে আছে তা বোঝার জন্য নিম্নলিখিত “আলামত”গুলো বিচার্য্য (আমরা এখন শুধু পয়েন্টগুলো বলবো) প্রয়োজনে পরে সেগুলো দলিলসহ ব্যাখ্যা করবো ইনশা’আল্লাহ্!):
১) বেশ-ভূষায় এব কথাবার্তায় অবিশ্বাসী বা কাফিরদের অনুকরণ করা।
২) কাফিরদের দেশে বসবাস করা।
৩)ছুটি বা অবকাশ কাটাতে অবিশ্বাসীদের বা কাফিরদের দেশে যাওয়া।
৪)মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফিরদের সাহায্য করা এবং তাদের প্রতিরক্ষা করা।
৫)তাদের সাহায্য চাওয়া, তাদেরকে উপদেষ্টা হিসাবে গ্রহণ করা বা নিয়োগ দেয়া, তাদের উপর ভরসা করা, এমন উচ্চ পদে তাদের নিয়োগ দেয়া যাতে মুসলিমদের গোপন বিষয়সমূহ তাদের কাছে প্রকাশিত হয়ে যায়।
৬)তাদের ক্যালেন্ডার বা দিনপন্জিকা ব্যবহার করা।
৭)তাদের উৎসব ইত্যাদিতে যোগ দেয়া এবং সেগুলোর সময় তাদের শুভেচ্ছা জানানো।
৮)তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস ও অপকর্ম সম্বন্ধে না জেনেই, তাদের সভ্যতার বা নৈতিকতার প্রশংসা করা।
৯)মুসলিম সমাজে প্রচলিত মুসলিম নাম ত্যাগ করে, তাদের নামে মুসলিম সন্তানদের নামকরণ করা।
১০)তাদের জন্য আল্লাহর ক্ষমা ও করুণা প্রার্থনা করা।
**********************************************************
এবার আসুন, Dr. Saleh al-Fawzan – এর বই Al-Walaa wa al-Baraa fil Islam থেকে “আল-ওয়ালা ওয়া আল-বারা”-র নিরিখে আপনার/আমার অবস্থান কি, সেটা জানবার উপায় হিসেবে যে সব “আলামত দেয়া আছে, সেগুলোর দ্বিতীয় অংশের বা দ্বিতীয় শ্রেণীর আলামতগুলো আমরা একটু বিবেচনা করে দেখি।
আপনার আনুগত্য যে সঠিকভাবেই মুসলিমদের প্রতি ন্যাস্ত, আপনার বন্ধুত্ব যে বিশ্বাসী মুসলিমদের জন্য নির্ধারিত তা বোঝার জন্য নিম্নলিখিত “আলামত”গুলো বিচার্য্য (আমরা এখন শুধু পয়েন্টগুলো বলবো, প্রয়োজনে পরে সেগুলো দলিলসহ ব্যাখ্যা করবো ইনশা’আল্লাহ্!):
১) অবিশ্বাসী বা কাফিরদের দেশ থেকে বিশ্বাসীদের দেশ বা মুসলিম ভূমিতে হিজরত করা।
২) বিশ্বাসী মুসলিমদের – সম্পদ, জীবন বা কথা দিয়ে – তাদের জীবনের ও দ্বীনের যে কোন প্রয়োজনে সাহায্য করা।
৩)বিশ্বাসী মুসলিমরা যদি কষ্টে থাকে তবে আপনারও কষ্ট লাগা, এবং তারা আনন্দে থাকলে আপনারও আনন্দ লাগা।
৪)মুসলিমদের যত্ন নেয়া, তাদের যাতে মঙ্গল হয় সেই চেষ্টা করা এবং কখনোই তাদের না ঠকানো বা প্রতারণা না করা।
৫)তাদেরকে সম্মান করা এবং কখনো তাদের খাটো করে না দেখা বা অসম্মান না করা।
৬)সুখের দিনে যেমন তাদের সাথে থাকা, তেমনি তাদের (বিশ্বাসীদের) দুঃখ-কষ্টের দিনেও তাদের সাথে থাকা – মুনাফিকদের মত না হওয়া, যারা সুখের সময় সুবিধা পেতে মুসলিমদের পাশে থাকে, কিন্তু মুসলিমদের কষ্টের সময় তাদের আর দেখা যায় না।
৭)তাদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করা এবং তাদের সাথে সাক্ষাৎ করা ও তাদের সাথে সময় কাটানোকে পছন্দ করা।
৮)বিশ্বাসী মুসলিমদের উপর অন্য বিশ্বাসী মুসলিমদের অধিকারকে সম্মান করা। কোন বিক্রেতা যদি তার মুসলিম ভাইয়ের সাথে কোন একটা পণ্য বিক্রয়ের ব্যাপারে একমত হয়ে থাকেন, তবে সেই একমত হওয়াকে বাতিল করে অন্যের কাছে পণ্য বিক্রী না করা। একইভাবে কোন ক্রেতার উচিত নয়, কোন বিক্রতাকে এই ব্যাপারে চাপ দেয়া যে, তিনি যেন অন্য মুসলিম ভাইয়ের সাথে দাম-দর ঠিক করা কোন পণ্য তাদের পূর্বে উপনিত “সমঝোতা” ভঙ্গ করে তার কাছে বিক্রী করেন।
৯)মুসলিমদের ভিতর যারা গরীব ও দুর্বল তাদের প্রতি সদয় হওয়া।
১০)বিশ্বাসী মুসলিমদের জন্য প্রার্থনা করা – তাদের জন্য আল্লাহর ক্ষমা ও করুণা প্রার্থনা করা ।
(দেখুন: পৃষ্ঠা ১৭~২৪, Al-Walaa wa al-Baraa fil Islam – Dr. Saleh al-Fawzan)
*****************************************
যাহোক “আল-ওয়ালা ওয়া আল-বারা” সম্বন্ধে বলতে গিয়ে Dr. Saleh al-Fawzan তার পুস্তিকার শুরতেই কুর’আনের কয়েকটি আয়াত উদ্ধৃত করেছেন:
قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَآَءُ مِنْكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَدًا حَتَّى تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ
“ইবরাহীম ও তার সাথে যারা ছিল তাদের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ। তারা যখন স্বীয় সম্প্রদায়কে বলছিল, ‘তোমাদের সাথে এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যা কিছুর উপাসনা কর তা হতে আমরা সম্পর্কমুক্ত। আমরা তোমাদেরকে অস্বীকার করি; এবং উদ্রেক হল আমাদের- তোমাদের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ চিরকালের জন্য; যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আন। …………” (কুর’আন, ৬০:৪)
উপরের আয়াতটি উদ্ধৃত করতে গিয়ে শুরুতেই তিনি বরেছেন যে, ইসলামী আক্বীদাহ্ বা বিশ্বাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এই যে, প্রতিটি মুসলিমেরই অপর সকল মুসলিমের প্রতি ভালোবাসা ও অনুগত্য বা বিশ্বস্ততা থাকতে হবে; আর প্রতিটি অবিশ্বাসীর প্রতি তার মনে অপছন্দ বা ঘৃণাবোধ থাকতে হবে। ইব্রাহীম (আ.) এবং তাঁর অনুসারীদের “দ্বীন” ছিল এমনই এবং উপরের আয়াতে, আমাদের জন্য তাদেরকে এই ব্যাপারে আদর্শ বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে!
এর পর উদ্ধৃত হয়েছে:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ
হে মুমিনগণ, ইয়াহূদী ও নাসারাদেরকে তোমরা বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। আর তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে নিশ্চয় তাদেরই একজন। নিশ্চয় আল্লাহ যালিম কওমকে হিদায়াত দেন না। (কুর’আন, ৫:৫১)
এই আয়াতে আল্লাহ্ আমাদের “আহল আল-কিতাবদের” (ইহুদী/খৃষ্টানদের) বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করতে নিষেধ করেন – আর নীচের আয়াতে, আল্লাহ্ সকল অবিশ্বাসীদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করতে নিষেধ করেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا عَدُوِّي وَعَدُوَّكُمْ أَوْلِيَاءَ
হে ঈমানদারগণ, তোমরা আমার ও তোমাদের শত্রুদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না…” (কুর’আন, ৬০:১)
***********************************
আমাদের এই আলোচনা থেকে, ব্লগের কিছু ভালো মুসলিম ভাইবোনও হয়তো কিছুটা অস্বস্তি বোধ করে থাকবেন। কিছু কথাকে হয়তো কারো কারো কাছে একেবারেই নতুন মনে হতে পারে। আবার দৈনন্দিন জীবনে, breathing-এর মত natural বা বলা যায় কাফিরদের সাথে মিশতে মিশতে naturalized হওয়া ব্যাপারগুলোকে “অস্বাভাবিক” বা “ভুল” বলা হলে, তখন কারো মনটা খারাপ হয়ে যেতেই পারে। একসময় আমার নিজেরও হয়তো হতো – আর হওয়াটাই স্বাভাবিক – যদি তাই না হবে, তবে এত লক্ষ-কোটি ডলার খরচ করে আমাদের মেধাবীদের বাইরে নিয়ে গিয়ে PhD সহ বড় বড় “তমঘা” দিয়ে তারা যে “ruling class” বানালো – তার স্বার্থকতা রইলো কোথায়? এত সিনেমা, এত কার্টুন, এত সাহিত্য, এত এন.জি.ও., এত পুরষ্কার: জোলিও কুরী কিংবা “কা’ন চলচ্চিত্র” উৎসব, এত অনুদান, মানবাধিকারের বা নারী-অধিকারের এত মায়াকান্না এসবের স্বার্থকতা কোথায়?? একটা সময় ছিল, যখন সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথম টয়লেটে যাওয়া থেকে শুরু করে, রাতে আবার ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি কাজই আমরা – মুসলিমরা – রাসূলের(সা.) শিখিয়ে দেয়া পদ্ধতিতে করতাম! আর আজ এই আমাদের দেশের নাগরিক মুসলিমদের প্রায় সবাই দৈনন্দিন কর্মকান্ডগুলো করে থাকি কাফিরদের অনুকরণে। সেখানে আমি যদি গ্রামীণ ফোনে চাকুরী করা একজন ইন্জিনিয়ারকে বলি যে, “ভাই আপনি যে ডান হাতে ভাত খেতে খেতে, বাঁ হাতে গ্লাস ধরে পানিটা খাচ্ছেন – এটা কিন্তু একটা গুনাহর কাজ – রাসূল (সা.) অত্যন্ত অপছন্দ করতেন”, তবে স্বভাবতই তিনি হয়তো বিরক্ত হবেন। কাফিরের জীবনযাত্রার ধরন আমাদের রক্তে মাংসে এমনভাবে ingrained হয়ে আছে যে, তা থেকে মুসলিম সত্ত্বাকে পৃথক করা আজ বড়ই কষ্টসাধ্য ব্যাপার! এজন্যই এই সিরিজের একটা পর্বে, মন্তব্যে, ব্লগার “মনপবন” বলেছেন: “আল্লাহ এই লেখাটা মানুষকে বোঝার সুযোগ এবং মেনে নেবার ক্ষমতা দিন।” তার সাথে সুর মিলিয়ে আমিও দোয়া করছি: “হে আমাদের রব, দয়া করে আমাদের মুসলিম ভাই-বোনদের ‘আল-ওয়ালা ওয়া আল-বারা’-র ব্যাপারগুলো বোঝার তৌফিক্ব দিন!”
যাহোক “আল-ওয়ালা ওয়া আল-বারা” সম্বন্ধে বলতে গিয়ে Dr. Saleh al-Fawzan তাঁর পুস্তিকার শুরতেই কুর’আনের কয়েকটি আয়াত উদ্ধৃত করেছেন। গত পর্বে আমরা কয়েকটি দেখেছিলাম, এখন বাকীগুলো দেখবো ইনশা’আল্লাহ। পরবর্তী আয়াতটি হচ্ছে:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا آَبَاءَكُمْ وَإِخْوَانَكُمْ أَوْلِيَاءَ إِنِ اسْتَحَبُّوا الْكُفْرَ عَلَى الْإِيمَانِ وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজদের পিতা ও ভাইদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরীকে প্রিয় মনে করে। তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তারাই যালিম।” (কুর’আন, ৯:২৩)
খুব সোজা-সাপটা কথা। এখানে কোন “যেন”, “নহে”, “এই”, “সেই” বা “ifs” অথবা “buts” লাগিয়ে ambiguous করার বা “পানি ঘোলা করার” অবকাশ নেই! এরপর তিনি উদ্ধৃত করেন সূরা মুজাদালার ২২ নম্বর আয়াত – যা এই পাতার শীর্ষে প্রদর্শিত রয়েছে বলে, আমরা আবার তা তুলে দিচ্ছি না। তবে এই পর্যায়ে তিনি বলেন যে, অনেক মানুষই ইসলামের এই major concept সম্বন্ধে অবগত নন বা সচেতন নন – সেজন্য অনেককে, এমনকি “দায়ী ইলাল্লাহ্”দেরও, দেখা যায় কাফিরদের ভাই বলে সম্বোধন করতে (যেমন: “আমাদের ইহুদী-খৃষ্টান ভাইয়েরা, যারা এই সভায় উপস্থিত আছেন” ইত্যাদি)। ড. সালিহ আল-ফাওযান বলেন যে, এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক একটা অভিব্যক্তি! তারপর এসেছে:
إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آَمَنُوا الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ (55) وَمَنْ يَتَوَلَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالَّذِينَ آَمَنُوا فَإِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْغَالِبُونَ
“তোমাদের বন্ধু কেবল আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিনগণ, যারা সালাত কায়েম করে এবং যাকাত প্রদান করে বিনীত হয়ে। আর যে আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব করে, তবে নিশ্চয় আল্লাহর দলই বিজয়ী।” (কুর’আন, ৫:৫৫~৫৬)
উপরের এই এই আয়াত দু’টি উদ্ধৃত করতে গিয়ে ড. সালিহ আল-ফাওযান বলেন যে, আল্লাহ যেমন কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব করতে আমাদের নিষেধ করেছেন, তেমনি বিশ্বাসী মুসলিমদের ভালোবাসা ও তাদের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করাটা আমাদের জন্য “ওয়াজিব” করে দিয়েছেন।
এরপর এসেছে সূরা আল-ফাতহ্-এর ২৯ নম্বর আয়াত যেখানে আল্লাহ্ বলেন:
مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ
“মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল এবং তার সাথে যারা আছে তারা কাফিরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর; পরস্পরের প্রতি সদয়,……।” (কুর’আন, ৪৮:২৯)
এবং তারপর এসেছে ৪৯:১০ আয়াতটি যেখানে আল্লাহ্ বলেন:
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ
“নিশ্চয় মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই………।” (কুর’আন, ৪৯:১০)
এই পর্যায়ে ড. সালিহ আল-ফাওযান বলেন, বিশ্বাসীরা দ্বীন ইসলামে একে অপরের ভাই – এমন কি তারা যদি কোনভাবে পরিচিত নাও হন – ভিন্ন স্থান অথবা কালেও যদি তারা অবস্থিত হন, তবু তারা পরস্পরের ভাই। এই কথাটাই নীচের আয়াতে উঠে এসেছে যেখানে আল্লাহ্ বলেন:
وَالَّذِينَ جَاءُوا مِنْ بَعْدِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِلَّذِينَ آَمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ
“যারা তাদের পরে এসেছে তারা বলে: ‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে ও আমাদের ভাই যারা ঈমান নিয়ে আমাদের পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে তাদেরকে ক্ষমা করুন; এবং যারা ঈমান এনেছিল তাদের জন্য আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ রাখবেন না; হে আমাদের রব, নিশ্চয় আপনি দয়াবান, পরম দয়ালু।” (কুর’আন, ৫৯:১০)
সুতরাং, শুরু থেকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত যত বিশ্বাসী থাকবেন – তারা একে অপরের ভাই – তাদের মাঝে space অথবা time-এর দুরত্ব যাই হোক না কেন! তারা একে অপরকে ভালোবাসেন এবং পরবর্তী প্রজন্ম “দ্বীনে” পূর্ববর্তী প্রজন্মকে অনুসরণ করেন এবং তাদের জন্য আল্লাহর দয়া, করুণা ও ক্ষমা প্রার্থনা করে দোয়া করেন!
(দেখুন: পৃষ্ঠা ৪~৮, Al-Walaa wa al-Baraa fil Islam – Dr. Saleh al-Fawzan)
***************************************
আজ আমরা, ইনশাল্লাহ্, কেউ যে কাফিদের ভালোবাসে বা তাদের মত হতে চায় তার আলামতগুলো দলিল সহকারে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো। আলামতগুলোর প্রথমেই ছিল:
(১) বেশ-ভূষায় এব কথাবার্তায় অবিশ্বাসী বা কাফিরদের অনুকরণ করা।
কেউ কারো মত dress up করতে চাইলে বা বেশ-ভূষায় কারো মত হতে চাইলে – আমরা এমনিতেই বুঝি যে, তিনি প্রথমোক্ত ব্যক্তিকে পছন্দ করেন বলেই তার মত হতে চান বা তাকে অনুকরণ করতে চান। একই কথা, অন্য কারো মুখের কথা বা বুলি আওড়ানোর বেলায়ও প্রযোজ্য। আমাদের দেশের মানুষেরা (বিশেষত নাগরিক জনসংখ্যা) হিন্দুস্থানী ছলা-কলা সম্বলিত সিনেমা-গান পছন্দ করেন এবং সে সবে দেখানো নায়ক-নায়িকার মত হতে চান বলেই, ঈদের বাজারে হিন্দুস্থানী সিনেমার নামে “তেরে নাম” বা “কুচ কুচ হোতা হায়” নামের শাড়ী বা জামার জনপ্রিয়তা পরিলক্ষিত হয়! এ ছাড়াও পাঠক খেয়াল করলেই বুঝবেন যে, “সুবাহানাল্লাহ্!”, “আলহামদুলিল্লাহ্!” বা “আল্লাহু আকবার!”-এর পরিবর্তে – হলিউডি সিনেমা এবং আমাদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল তথা ইংলিশ প্রীতির বদৌলতে “Wow!”, “great!”, “holy ***t!”, “jeeeez!!” বা “my god!” – এসব অভিব্যক্তি আমাদের জীবনে মহামারীর মত ঢুকে পড়েছে। মাতৃভাষার পরেই আমরা আমাদের ছেলে-মেয়েদের Queen-এর ইংলিশ শেখাতে চাই – কারণ আমাদের “বিশ্বাস” যে, তাতে আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিতই আলোকিত হবে। অথচ, আমাদের মুসলিমদের উচিত ছিল, মায়ের মুখের ভাষার পরেই King of the kings আরবী ভাষা শেখা, কারণ তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’লা ঐ ভাষাকে নিজের “কথা”-র (কালামুল্লাহর) মাধ্যম হিসেবে নির্বাচিত করেছেন এবং এটা সকলের অনুধাবন করা উচিত যে, নিশ্চয়ই প্রতিটি দ্বীনেরই একটা নিজস্ব ভাষা আছে (দেখুন: http://www.khutbah.com/en/ed_know/faith_language.php )! যাহোক কুফফারের অনুকরণকে ইসলামে খুব গর্হিত জ্ঞান করা হয়। সেজন্য রাসূল(সা.) সহীহ হাদীসে বলে গেছেন যে, “কেউ কোন দলকে (বা জনগোষ্ঠিকে) যদি অনুকরণ করে, তবে সে তাদেরই একজন।” (আবু দাউদ)
(২)কাফিরদের দেশে বসবাস করা।
সামর্থে কুলালে, কাফিরের দেশ থেকে (মুসলিম ভূমিতে) হিজরত করা প্রত্যে মুসলিমের জন্য ওয়াজিব! আল্লাহ্ সুবাহানাহু ওয়া তা’লা কুর’আনে বলেন:
إِنَّ الَّذِينَ تَوَفَّاهُمُ الْمَلَائِكَةُ ظَالِمِي أَنْفُسِهِمْ قَالُوا فِيمَ كُنْتُمْ قَالُوا كُنَّا مُسْتَضْعَفِينَ فِي الْأَرْضِ قَالُوا أَلَمْ تَكُنْ أَرْضُ اللَّهِ وَاسِعَةً فَتُهَاجِرُوا فِيهَا فَأُولَئِكَ مَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَسَاءَتْ مَصِيرًا (97) إِلَّا الْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاءِ وَالْوِلْدَانِ لَا يَسْتَطِيعُونَ حِيلَةً وَلَا يَهْتَدُونَ سَبِيلًا
“নিশ্চয় যারা নিজদের প্রতি যুলমকারী(হিজরত ওয়াজিব হওয়া সত্ত্বেও যারা কাফিরদের মাঝে বসবাস করেছে), ফেরেশতারা তাদের জান কবজ করার সময় বলে, ‘তোমরা কী অবস্থায় ছিলে’? তারা বলে, ‘আমরা যমীনে দুর্বল ছিলাম’। ফেরেশতারা বলে, ‘আল্লাহর যমীন কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা তাতে হিজরত করতে’? সুতরাং ওরাই তারা যাদের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম। আর তা মন্দ প্রত্যাবর্তনস্থল। তবে যে দুর্বল পুরুষ, নারী ও শিশুরা কোন উপায় অবলম্বন করতে পারে না এবং কোন রাস্তা খুঁজে পায় না – তাদের কথা আলাদা।” (সূরা নিসা, ৪:৯৭~৯৮)
সুতরাং, আল্লাহ্ সুবহানাহুওয়া তা’লা কাফিরের দেশে ও কাফিরদের মাঝে বসবাস করার জন্য কাউকে ক্ষমা করেন না, কেবল তাদের ছাড়া যারা দুর্বল বিধায় সেখান থেকে হিজরত করতে অক্ষম, অথবা যারা আল্লাহর দিকে মানুষকে দাওয়াত দেবার জন্য সেখানে থাকেন।
এই ব্যাপারটা আমাদের দেশে বলতে গেলে অজানা – এমন কি ‘আলেমগণের অনেকেও হয়তো এ ব্যাপারে সচেতন নন। আমি নিজে এই দেশের রাস্ট্রীয় পর্যায়ের ইসলামপন্থীদের গর্ব করে বলতে শুনেছি যে তাদের সন্তানরা (সব দিকে চৌকষ বলে) যুক্তরাষ্ট্রে বা যুক্তরাজ্যে ভালো “position”-এ রয়েছে। আমি প্রথম ৯০-এর দশকের শেষের দিকে ব্যাপারটা শুনি বৃটিশ (ধর্মান্তরিত) মুসলিম, আবদুল হাকিম মুরাদের (T.J.Winter) একটা লেকচারে। তাঁকে লন্ডনের উপ-মহাদেশীয় জনগোষ্ঠির কেউ, তাদের সেখানে থাকার ধর্মীয় বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন করলে, তিনি বলেন যে, একটা মুসলিম দেশ থেকে গিয়ে (উন্নত জীবন-যাত্রার জন্য) বৃটেনের মত কাফিরের দেশে বসবাস করাটা হারাম। তারপর অবশ্য আলবানী(রহ.), মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল উসাইমিন (রহ.), ড. সালিহ আল-ফাওযানসহ আরো অনেকের লেখায় ব্যাপারটা সম্বন্ধে জানতে পেরেছি। আপনাদের কাছে যদি Dr. Muhammad Taqi-ud-Din Hilali ও Dr. Muhammad Muhsin Khan-এর অনুবাদ করা Translation of the meanings of The Noble Qur’an থেকে থাকে, তবে দয়া করে ৪:৯৭ আয়াতের ব্যাখ্যার ফুটনোট দেখুন এবং সেটা অনুসরণ করে ৩:১৪৯ আয়াতের ফুটনোটে যান। দেখবেন সেখানে ব্যাপারটা খুব স্পষ্ট করে লেখা আছে। সেখানে যে হাদীসটার উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে সেটা হচ্ছে:
“সামুরা বিন জুনদুব (রা.) বর্ণনা করেন যে, রাসুল (সা.) বলেন: “যে কেউ (মুসলিমদের মধ্য থেকে) কোন মুশরিকের (একাধিক ঈশ্বরে বিশ্বাসী অথবা এক আল্লাহয় বিশ্বাস করে না এমন) সাথে দেখা করে, সমাবেশে মিলিত হয়, একত্রে বাস করে অথবা তার পাশাপাশি স্থায়ীভাবে বসবাস করে এবং তার (কাফির/মুশরিকের) সাথে তার পন্থাসমূহের ব্যাপারে একমত হয় এবং তার (কাফির/মুশরিকের) সাথে নিজের বসবাসকে উপভোগ করে, তবে সে (ঐ মুসলিম) তারই (ঐ কাফির/মুশরিকের) মত একজন। (এই হাদিস এই শিক্ষাই দেয় যে, একজন মুসলমানের উচিত নয় অ-মুসলিম দেশে বাস করা, তার অবশ্যই কোন মুসলিম দেশে চলে যাওয়া উচিত, যেখানে ইসলাম চর্চা করা হয়)” [আবু দাউদের জিহাদের কিতাব থেকে]
অনেকেই নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করার অকল্পনীয় (কাল্পনিক) সম্ভাবনা এড়াতে fallacious তর্ক জুড়ে দেন এই বলে যে, এখনকার মুসলিম দেশগুলোই বা আর এমন কি ইসলামিক। কিন্তু তারা যে ব্যাপারটা miss করেন তা হচ্ছে: আপনাকে প্রাথমিকভাবে কাফির-মুশরিকের মাঝে থাকতে বা settle down করতে বারণ করা হচ্ছে এবং মুসলিমদের সাথ থাকতে বলা হচ্ছে – আপনার দেশটা কতটা ইসলামিক সেই প্রশ্নটা এখানে প্রাথমিকভাবে সংশ্লিষ্ট নয়! এই সংক্রান্ত উল্লেখযোগ্য অন্য হাদীসগুলো দেখুন:
“The Muslim and the polytheist, their fire is not to appear to one another.” [Abu Dawud, Tirmidhi]
এই হাদীসটার ব্যাখ্যায় এসেছে যে, তৎকালীন আরবে কোন গোত্র যখন মরুভূমিতে তাবু খাটিয়ে বা ঘর বানিয়ে বসতি স্থাপন করতো, তখন তারা তাদের বাসস্থানের সামনে রাতের বেলা মশালের মত আলো জ্বেলে রাখতো যাতে অনেক দূর থেকে তাদের বসতির অবস্থানটা বোঝা যায়। রাসূল (সা.) এই হাদীসে বলছেন যে, মুসলিমদের এবং কাফির-মুশরিকদের বসতি যেন পৃথক হয় এবং এমন দুরত্বে অবস্থিত হয় যাতে একটা থেকে অপরটার “আলো” দেখা না যায়!
সোজা কথায় কাফির-মুশরিকদের সাথে ওঠা-বসা, mixing/mingling করা যাবে না।
“I am free from every Muslim who resides amongst the polytheists.” [Abu Dawud, Tirmidhi]
এই হাদীসে রাসূল(সা.) বলছেন যে, কোন মুসলিম যখন কাফির-মুশরিকদের মাঝে বসবাস করে, তখন তার সাথে তাঁর (সা.) কোন সম্পর্ক নেই বা তার ব্যাপারে তাঁর (সা.) কোন দায়-দায়িত্ব নেই!
যে কোন মুসলিমের এই ব্যাপারে সচেতন হবার জন্য এটুকুই য়থেষ্ট হবার কথা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ভোগ-সুখ বা উন্নত lifestyle-এর মোহে আমরা এই কথা গুলো শুনেও না শোনা বা বুঝেও না বোঝার ভান করি – আমাদের শরীরটা মসজিদে যাতায়াত করলেও বা নামাজ পড়লেও, আমাদের “মগজ”টা কুফফারের কাছে বাঁধা পড়ে রয়। আমাদের চিন্তা-ভাবনার জগতটা কুফফারের দখলেই থেকে যায়!
(৩)ছুটি বা অবকাশ কাটাতে অবিশ্বাসীদের বা কাফিরদের দেশে যাওয়া।
বিশেষ প্রয়োজন (দারুরাত) ছাড়া কাফিরদের দেশে যাওয়াটা হারাম। ঐ বিশেষ প্রয়োজনের আওতায় চিকিৎসা, বানিজ্য, বা এমন বিষয়ে জ্ঞান-অর্জন পড়বে যে সব বিষয়ে কেবল ঐ সব দেশেই লেখা-পড়া করা যায়। সুতরাং এই সমস্ত প্রয়োজনে কাফিরের দেশে যাওয়া যেতে পারে, কিন্তু প্রয়োজন শেষ হবার সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সে দেশ ত্যাগ করতে হবে। তাছাড়া কেউ কারণবশতও কেবল তখনই যেতে পারবেন যখন মাথা উঁচু করে তিনি তার “ইসলামী করণীয়গুলো” সমাধা করতে পারবেন। তবে আল্লাহর দিকে মানুষকে দাওয়াত দেবার জন্য কাফিরের দেশে ভ্রমণ করাটা অনুমোদিত বা কখনো এমনকি ওয়াজিবও হতে পারে।
আমাদের নাগরিক জনগোষ্ঠীতে, অনেক মানুষের হাতে যে করেই হোক আজকাল বেশ “বাড়তি পয়সা” যে এসেছে – তা না বুঝে থাকার কোন উপায় নেই। ঢাকা শহরে প্রতিদিন নাকি গড়ে ৯৭টা করে নতুন প্রাইভেট কারের রেজিস্ট্রেশন হয়। সুদ, ঘুষ, শেয়ার বাজারে “পুকুর চুরি”, আর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে খাস জমি, লাইসেন্স পারমিট অর্জন সহ গণসাধারণের সম্পদের নানাবিধ লুটপাট ইত্যাদিই যে ঐ বাড়তি পয়সার যোগান দেয় – তা বলাই বাহুল্য! ঐ বাড়তি পয়সার একটা বড় অংশ যে, বিদেশে গিয়ে”মৌজ” আর শপিং করতে খরচ হয় – তা সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন – আর এটাও বলা বাহুল্য যে “মৌজ” করার জন্য কাফিরদের দেশগুলোই সবচেয়ে উর্বর চারণভূমি! যাদের সামর্থ কম, তারা নিদেন পক্ষে হিন্দুস্থানে গিয়ে তাদের R&R (মার্কিন সেনাবাহিনী অবসর বিনোদনের জন্য ব্যবহৃত একটা অভিব্যক্তি) সেরে আসেন – আর যাদের সামর্থ বেশী – তারা থাইল্যান্ড থেকে শুরু করে এমন কি সুইজারল্যান্ডেও বেড়াতে যান। তাতে একদিকে তারা যেমন কাফিরের হাতে মুসলিমদের সম্পদ তুলে দিয়ে আসেন, তেমনি অপরদিকে সেসব দেশ থেকে পাপাচারও ও বদভ্যাসসমূহ দেশে আমদানী করে নিয়ে আসেন। এসব কর্মকান্ড থেকে মুসলিমরা সবদিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হন।
(দেখুন: পৃষ্ঠা ৮~১০, Al-Walaa wa al-Baraa fil Islam – Dr. Saleh al-Fawzan)
***************************
(৪)মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফিরদের সাহায্য করা এবং তাদের প্রতিরক্ষা করা।
এই ব্যাপারটা ধোয়াশাচ্ছন্ন নয় বরং একদমই সোজা সাপটা – তাছাড়া, এই বিষয়টা একজন মুসলিমের জন্য ঈমান বিনষ্টকারী একটা বিষয়। সুতরাং এটা নিয়ে আলোচনা বা পর্যালোচনার কোন প্রয়োজন বা অবকাশ নেই! ড. সালিহ আল-ফাওযান তাই, তাঁর বইতে এই বিষয়টা এক লাইনেই শেষ করে দিয়েছেন। এই ব্যাপারটা যে ইমান বিনষ্টকারী বিষয় তার দলিল হচ্ছে আগে আলোচিত কুর’আনর নিম্নলিখিত আয়াতটি:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ
হে মুমিনগণ, ইয়াহূদী ও নাসারাদেরকে তোমরা বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। আর তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে নিশ্চয় তাদেরই একজন। নিশ্চয় আল্লাহ যালিম কওমকে হিদায়াত দেন না। (কুর’আন, ৫:৫১)
আমরা একটা মুসলিম প্রধান দেশে থাকি বলে অনেক সময়ই হয়তো “মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফিরদের সাহায্য করা” – বলতে কি বোঝায় তা হয়তো বুঝি না। একটা দ্বীনের মজলিসে একবার আমাদের সেনাবাহিনীর একজন প্রাক্তন একতারা জেনারেল প্রশ্ন করেছিলেন যে, হিন্দুস্থানী সেনাবাহিনীতে যে সব মুসলিম অফিসার রয়েছেন, যুদ্ধাবস্থায় কখনো যদি তারা কোন মুসলিম সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হন, তবে তাদের loyalty কোথায় থাকবে? তাকে বললাম, একজন মুসলিমের জন্য – মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফিরদের প্রতি loyal থাকার কোন অবকাশই নেই! সিঙ্গাপুরের সেনাবাহিনীতে বাহিনীতে মুসলিম মালয়দের (বা অন্যান্য কাফির দেশেও মুসলিমদের) কোন গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়া হয় না – কারণ, এটা আশা করা বোকামী যে, কখনো যদি প্রতিবেশী মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার সাথে যুদ্ধ বাঁধে তবে একজন মালয় মুসলিম নিজ ধর্মীয় কাউকে দেশের জন্য হত্যা করবে। এদিক থেকে চিন্তা করলে, ঘুমন্ত ঢাকাবাসী মুসলিমদের উপর মুসলিম হয়েও পাকিস্তানীরা কি করে ১৯৭১-এর ২৫শে মার্চের মধ্যরাতে নিধনযজ্ঞ শুরু করেছিল – তা ভাবতে অবাক লাগে। জাতি-সত্তার ও ভাষার ভিন্নতাভিত্তিক ঘৃণা তাদের নিশ্চয়ই অন্ধ করে দিয়ে থাকবে। এজন্যই ইসলামে “আসাবিয়া” ব্যাপারটা নিষিদ্ধ – জাতি, বর্ণ, ভাষা বা অন্য কোন পার্থক্যের জন্য একজন মুসলিম নিজেকে অন্য মুসলিম থেকে পৃথক করে দেখতে পারে না – তার loyalty সব সময় সর্ব প্রথম বা সর্বাগ্রে ইসলাম বা মুসলিমদের কাছে ন্যস্ত থাকবে!
আমাদের হৃদয়ে কাফিরদের প্রতি যে দুর্বলতা রয়েছে তার ৫ম আলামত হচ্ছে:
৫)তাদের সাহায্য চাওয়া, তাদেরকে উপদেষ্টা হিসাবে গ্রহণ করা বা নিয়োগ দেয়া, তাদের উপর ভরসা করা, এমন উচ্চ পদে তাদের নিয়োগ দেয়া যাতে মুসলিমদের গোপন বিষয়সমূহ তাদের কাছে প্রকাশিত হয়ে যায়।
এই ব্যাপারটা যে সরাসরি কুর’আন থেকে এসেছে – তাও হয়তো আমরা অনেকেই জানিনা। দেখুন আল্লাহ্ কি বলছেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا بِطَانَةً مِنْ دُونِكُمْ لَا يَأْلُونَكُمْ خَبَالًا وَدُّوا مَا عَنِتُّمْ قَدْ بَدَتِ الْبَغْضَاءُ مِنْ أَفْوَاهِهِمْ وَمَا تُخْفِي صُدُورُهُمْ أَكْبَرُ قَدْ بَيَّنَّا لَكُمُ الْآَيَاتِ إِنْ كُنْتُمْ تَعْقِلُونَ (118) هَا أَنْتُمْ أُولَاءِ تُحِبُّونَهُمْ وَلَا يُحِبُّونَكُمْ وَتُؤْمِنُونَ بِالْكِتَابِ كُلِّهِ وَإِذَا لَقُوكُمْ قَالُوا آَمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا عَضُّوا عَلَيْكُمُ الْأَنَامِلَ مِنَ الْغَيْظِ قُلْ مُوتُوا بِغَيْظِكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ (119) إِنْ تَمْسَسْكُمْ حَسَنَةٌ تَسُؤْهُمْ وَإِنْ تُصِبْكُمْ سَيِّئَةٌ يَفْرَحُوا بِهَا وَإِنْ تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا لَا يَضُرُّكُمْ كَيْدُهُمْ شَيْئًا إِنَّ اللَّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطٌ
“হে মুমিনগণ, তোমরা তোমাদের (মুসলিমদের) ছাড়া অন্য কাউকে তোমাদের অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে (এখানে কুর’আনে ব্যবহৃত শব্দটা হচ্ছে ‘বিতানাহ্’ – যারা অর্থ হচ্ছে: উপদেষ্টা, কনসাল্টেন্ট, সাহায্যকারী ইত্যাদি) গ্রহণ করো না। তারা তোমাদের সর্বনাশ করতে ত্রুটি করবে না। তারা তোমাদের মারাত্মক ক্ষতি কামনা করে। তাদের মুখ থেকে তো শত্রুতা প্রকাশ পেয়ে গিয়েছে। আর তাদের অন্তরসমূহ যা গোপন করে তা মারাত্মক। অবশ্যই আমি তোমাদের জন্য আয়াতসমূহ স্পষ্ট বর্ণনা করেছি। যদি তোমরা উপলব্ধি করতে। শোন, তোমরাই তো তাদেরকে ভালবাসো এবং তারা তোমাদেরকে ভালবাসে না। অথচ তোমরা সব কিতাবের প্রতি ঈমান রাখ। আর যখন তারা তোমাদের সাথে সাক্ষাৎ করে, তখন বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’। আর যখন তারা একান্তে মিলিত হয়, তোমাদের উপর রাগে আঙ্গুল কামড়ায়। বল, ‘তোমরা তোমাদের রাগ নিয়ে মর’! নিশ্চয় আল্লাহ অন্তরের গোপন বিষয় সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞাত। যদি তোমাদেরকে কোন কল্যাণ স্পর্শ করে, তখন তাদের কষ্ট হয়। আর যদি তোমাদেরকে মন্দ স্পর্শ করে, তখন তারা তাতে খুশি হয়……………। ” (সূরা আলে ইমরান, ৩:১১৮~১২০)
সাধারণভাবে প্রায় সকল মুসলিম দেশ, আর বিশেষভাবে আমাদের দেশের সাদা-চামড়া কাফির বিশেষজ্ঞ তথা উপদেষ্টা প্রীতি যে কি ভয়াবহ – তা সচেতন পাঠক মাত্রই জানেন। দাতা ও সেবা সংস্থা, এনজিও, জ্বালানী খাত, এমন কি শিক্ষাক্ষেত্রেও বিভিন্ন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে “বিশেষজ্ঞ” শিক্ষক নিয়োগের বদৌলতে দেশের গণ-সাধারণের নৈতিকতার বারোটা যেমন বাজতে বসেছে – তেমনি বিদেশীদের পরিকল্পিত কাফিরায়ণ প্রকল্পের আওতায়, “সেকেলে ইসলামে” প্রতিদিন বিশ্বাস হারাচ্ছে শত শত ডি-জুস উত্তর “ফেসবুক” প্রজন্মের মুসলিম সন্তানেরা; তাছাড়া পার্বত্য চট্রগ্রাম হারিয়ে দেশের মানচিত্র পরিবর্তিত হবার বাস্তব সম্ভাবনা তো রয়েছেই! অথচ আল্লাহ্ আপনাকে দেড় হাজার বছর আগেই বলে দিয়েছেন: অবিশ্বাসীদের উপদেষ্টা, কনসাল্টেন্ট, সাহায্যকারী হিসাবে গ্রহণ না করতে – কারণ মুসলিমদের ক্ষতি করার কোন সুযোগ তারা হাতছাড়া করবে না। অথচ, আমাদের দেশ সহ প্রায় সকল মুসলিম দেশের স্পর্শকাতর ও গোপন বিষয়গুলোতে অবিশ্বাসীদের “প্রবেশাধিকার” অবারিত বললেও ভুল হবে না বোধহয়।
এরপরের আলামত হচ্ছে:
৬)তাদের ক্যালেন্ডার বা দিনপন্জিকা ব্যবহার করা।
অবিশ্বাসীদের ক্যালেন্ডার বা দিন-পন্জিকা ব্যবহার করা এবং সেই অনুযায়ী নব-বর্ষ ইত্যাদি উদযাপন করা প্রমাণ করে যে, আমরা তাদের মতবাদ ও বিশ্বাসের প্রতি দুর্বল। আজ যদি এই ব্লগের ব্লগারদেই আমরা জিজ্ঞেস করি যে, আজ হিজরী সাল গণনার হিসাবে কত তারিখ – আমার তো মনে হয় না প্রতি দশ জনে একজনও, কোথাও না দেখে, সঠিক তারিখটা বলতে পারবেন।
(দেখুন: পৃষ্ঠা ১০~১৪, Al-Walaa wa al-Baraa fil Islam – Dr. Saleh al-Fawzan)
*************************************8
৭)তাদের উৎসব ইত্যাদিতে যোগ দেয়া এবং সেগুলোর সময় তাদের শুভেচ্ছা জানানো।
খুব সম্ভবত অজ্ঞতাবশতই, আমাদের দেশের বহু মানুষ বিধর্মীদের উৎসবসমূহে তাদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন, কেউ কেউ তাদের দাওয়াতে যান – তাদের পার্টি বা ভোজ ইত্যাদিতে অংশগ্রগণ করেন। এটা হচ্ছে তাদের প্রতি আপনার ভালবাসার পরিচায়ক এবং অনেক ক্ষেত্রই তাদের মত হবার সুপ্ত বাসনার প্রকাশ! এসম্বন্ধে দুইটা ruling-এর অংশ বিশেষ নীচে তুলে দিলাম:
পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, বিধর্মীদের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া, তাদের শুভেচ্ছো জানানো ইত্যাদি ইসলামের দৃষ্টিতে কত গর্হিত ও অপছন্দনীয় হারাম কাজ।
৮)তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস ও অপকর্ম সম্বন্ধে না জেনেই, তাদের সভ্যতার বা নৈতিকতার প্রশংসা করা।
এটাও হচ্ছে বিধর্মীদের প্রতি আপনার ভালোবাসা তথা তাদের কৃষ্টি-কালচারের প্রতি আপনার দুর্বলতার আলামত! আমরা অনেককেই বলতে শুনি যে, “(পশ্চিমা কাফির দেশগুলো) ওসব দেশের নিয়ম কানুন কতই না ইসলামিক, কেবল তারা মুসলিম নয় এই যা” অথবা “ওসব দেশে সব কিছু নিয়ম মেনে চলে এবং ওখানে আরো ভালোভাবে ইসলাম পালন করা যায়” ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ আমরা ভুলে যাই যে, পশ্চিমা দেশগুলোতে “কুফর” হচ্ছে norm, আর আমাদের দেশের মত মুসলিম দেশ গুলোতে এখনো, এত কিছুর পরেও, ইসলামই হচ্ছে norm। আরো একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতিও আমরা ভুলে যাই: ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে, “কুফর/শিরক” হচ্ছে এমন দোষ যা অন্য সকল গুণ বা অর্জন নষ্ট করে দেয় -আর- ঈমান হচ্ছে এমন একটা গুণ, যা অন্য অনেক দোষকে মুছে দেয় বা হালকা করে দেয়! অনেকে আবার তাদের বস্তুবাদী অর্জনকে তাদের “শুদ্ধতার” প্রতিফল মনে করে থাকেন – অথচ দেখুন আল্লাহ্ কুর’আনে কি বলেছেন:
وَلَا تَمُدَّنَّ عَيْنَيْكَ إِلَى مَا مَتَّعْنَا بِهِ أَزْوَاجًا مِنْهُمْ زَهْرَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا لِنَفْتِنَهُمْ فِيهِ وَرِزْقُ رَبِّكَ خَيْرٌ وَأَبْقَى
”আর তুমি কখনো তোমার দু’চোখ সে সবের প্রতি প্রসারিত করো না, যা আমি তাদের বিভিন্ন শ্রেণীকে দুনিয়ার জীবনের জাঁক-জমকস্বরূপ উপভোগের উপকরণ হিসেবে দিয়েছি। যাতে আমি সে বিষয়ে তাদেরকে পরীক্ষা করে নিতে পারি। আর তোমার রবের প্রদত্ত রিযিক সর্বোৎকৃষ্ট ও অধিকতর স্থায়ী।” (২০:১৩১)
কেউ যে বিধর্মীদের ভালোবাসে তার আরেকটি আলামত হচ্ছে:
৯)মুসলিম সমাজে প্রচলিত মুসলিম নাম ত্যাগ করে, তাদের নামে মুসলিম সন্তানদের নামকরণ করা।
এখানেও আমাদের “কাফির-প্রীতি” না দেখে থাকার কোন উপায় নেই – রজত, ধ্রুব, জন, জনি, অরুন, প্রবাল থেকে শুরু করে এমন অনেক নামই আমরা রাখি যেগুলো ঐতিহ্যগতভাবে বিধর্মীদের typical নাম ছিল! নিশ্চয় তাদের নামগুলো আমরা পছন্দ করি বলেই ওমন করে থাকি। অথচ, আল্লাহর রাসূল (সা.) বলে গেছেন: “আল্লাহর কাছে সবচেয়ে ভালো নাম সমূহ হচ্ছে আব্দুল্লাহ্ এবং আব্দুর রহমান।” (মুসলিম)
আগে কেবল নাম শুনেই একজন মানুষকে মুসলিম বলে অতি সহজে সনাক্ত করা যেত, আজ আর তা হবার উপায় নেই – অন্তত সুশীল নগরবাসীদের নাম শুনে অনেক ক্ষেত্রই বোঝা মুশকিল যে তারা কি!
সবশেষে যে আলামতটি আসছে তা হচ্ছে:
১০)তাদের জন্য আল্লাহর ক্ষমা ও করুণা প্রার্থনা করা।
এটা তাদের ভালোবাসা এবং তাদের (কাফিরদের) বিশ্বাসের সাথে একমত হবার সমতুল্য! নিম্নলিখিত আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের জন্য তা নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন:
مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آَمَنُوا أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوا أُولِي قُرْبَى مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ
”নবী ও মুমিনদের জন্য উচিত নয় যে, তারা মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে। যদিও তারা আত্মীয় হয় – তাদের নিকট এটা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর যে, নিশ্চয় তারা প্রজ্বলিত আগুনের অধিবাসী।” (৯:১১৩)
(দেখুন: পৃষ্ঠা ১৪~১৭, Al-Walaa wa al-Baraa fil Islam – Dr. Saleh al-Fawzan)
********************************** মুসলমানের-ভালবাসা
No comments:
Post a Comment