আসহাবে ফিল(হাতী ওয়ালার ঘটনা)
রাসুল (সাঃ) এর দাদা আব্দুল মুত্তালিবের সময় এক বিরাট ঘটনা ঘটে যায় যাকে কুরআন চির স্মরনীও করে রেখেছে। সেটি হচ্ছে হাতি ও হাতি ওয়ালার ঘটনা। ‘আবরাহা আল-হাবশী’ যিনি তৎকালীন ইয়েমেনের শাসক ছিলেন। তিনি নিজের জন্য একটি গির্জা নির্মাণ করেন, যার নামকরণ “আল-কুল্লায়েস”। এটি তৈরি করার পেছনে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল যে, আরব হাজীগণ যেন কা’বার পরিবর্তে গির্জার পানে ফিরে যায়। যার কারণে আরবরা খুব রাগান্বিত হন এবং কেনানী গোত্রের জনৈক ব্যক্তি ঐ গির্জায় মল ত্যাগ করে দেয়। এই সংবাদ যখন
আবরাহা জানতে পারেন তখন অত্যন্ত রাগান্বিত হন এবং এই বলে কসম করেন যে তিনি অবশ্যই কা’বার কাছে এসে তা ধ্বংস করবেন। অতঃপর তিনি হাবশীদের আদেশ দেন যে, তারা যেন প্রস্তুতি নেয় এবং হাতি সঙ্গে নিয়ে রওয়ানা হয়। যখন তারা তায়েফের রাস্তায় (মুগাম্মাস নামক স্থানে) পৌঁছায় তখন আল-আসওয়াদ বিন মাকসুদ হাবশীকে ঘোড়ায় চাপিয়ে মক্কা পাঠান, সে তাহামা এলাকায় কুরাইশ ও অন্যান্য লোকদের মাল লুট করে। এমনকি আব্দুল মুত্তালিবের দু’শ উট ও নিয়ে যায়। তৎকালীন আব্দুল মুত্তালিব কুরাইশদের মধ্যে প্রবীণ ও নেতা ছিলেন। অতঃপর কুরাইশ, কেনানাহ এবং হুযায়েল গোত্রে তার মোকাবেলা করার ইচ্ছা করে; কিন্তু যখন তারা জানতে পারে তার মোকাবেলা করতে তারা অক্ষম তখন ঐ পরিকল্পনা বাতিল করে। এরপর ‘আবরাহা’ হুনাতা আল হিমইয়ারীকে মক্কায় প্রেরণ করেন এবং বলেনঃ তুমি এই শহরের নেতাদের সাথে সাক্ষাত কর এবং তাদেরকে বল (আবরাহা) তোমাদের সাথে যুদ্ধ করতে আসেনি। আমি এসেছি কেবল এই (আল্লাহর) ঘর ধ্বংস করতে। তোমরা যদি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না কর তাহলে রক্তপাতের কোন প্রয়োজন নেই। যদি যুদ্ধ করতে না চায় তাহলে তাদেরকে আমার নিকট হাজির কর। হুনাতা যখন মক্কায় প্রবেশ করে তখন সে কুরাইশদের নেতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। প্রত্যুত্তরে তাকে বলা হয় আব্দুল মুত্তালিব বিন হাশেম। অতঃপর সে তার কাছে আসে এবং আবরাহা হুনাতাকে যা বলতে বলেছিলেন তা আব্দুল মুত্তালিবকে বলে। প্রত্যুত্তরে আব্দুল মুত্তালিব তাকে বলেন, আল্লাহর কসম আমরা তার সাথে যুদ্ধ করার কোন ইচ্ছা রাখিনা এবং তার মোকাবেলা করারও কোন শক্তি রাখিনা। এটি আল্লাহর ও তার খলীফা ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) এর সম্মানিত ঘর। আল্লাহ যদি এই ঘরকে রক্ষা করতে চান তাহলে তা সুরক্ষিত হবে। এটি তাঁর ঘর ও হারাম। আর যদি তিনি তাকে বাধা না দেন, তাহলে আমরা তাঁর প্রতিরোধ করতে পারব না। এরপর হুনাতা তাকে বলে, তুমি আমার সঙ্গে ছল, কারণ আবরাহা তোমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে আদেশ করেছেন। আব্দুল মুত্তালিব সুন্দর সুঠাম এবং লম্বা মানুষ ছিলেন। আবরাহা তাঁর এই সুন্দর চেহারা দেখে তাকে নিচে বসানো অনুচিত মনে করেন। অন্য দিকে হাবশীরা তাদের বাদশাহের গদিতে তাকে বসতে দেখুক এটিও তিনি ভাল মনে করলেন না। সেই জন্য আবরাহা নিজ আসন থেকে নেমে এসে চটের উপর বসেন ও আব্দুল মুত্তালিবকে তাঁর পাশে বসান। অতঃপর অনুবাদককে বললেন, আব্দুল মুত্তালিবকে জিজ্ঞাসা কর এখন তুমি কি চাও? অনুবাদক তাঁকে তার কথা অনুবাদ করে শোনায়। প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন, বাদশাহ যেন আমার দু’শ উট ফেরত দিয়ে দেন। একথা যখন আবরাহাকে অনুবাদ করে শুনান হয় তখন তিনি অনুবাদককে বলেনঃ তুমি তাঁকে বল, আমি যখন তোমাকে দেখি তখন খুব বিচক্ষন ও জ্ঞানী ভাবি; কিন্তু তুমি আমাকে অতি তুচ্ছ কথা শুনালে। তুমি কেবল তোমার দু’শ উটের কথা ভাবছ? আমি ঐ ঘর ধ্বংস করতে এসেছি যা তোমার ও তোমার বাপ-দাদাদের দ্বীনের ভিত্তি। এ সম্পর্কে আমাকে কোন কথা বলছ না? আব্দুল মুত্তালিব প্রত্যুত্তরে বললেন, আমি উটের মালিক, কা’বার যিনি মালিক তিনি তার প্রতিরক্ষা করবেন। আবরাহা বললেন, তিনি কা’বাকে আমার আক্রমন থেকে রক্ষা করতে পারবে না। আব্দুল মুত্তালিব বলেনঃ (পারবেন কি পারবেন না) আপনি এবং তিনি জানেন। এরপর আবরাহা তাঁর (আব্দুল মুত্তালিবের) উট ফেরত দেন। আব্দুল মুত্তালিব কুরাইশদের নিকট ফিরে আসেন ও তাদেরকে মক্কা ত্যাগ করতে আদেশ দেন, যাতে তারা পাহাড়ের চূড়ায় আশ্রয় নেয় ও সেনাদের আক্রমন হতে পরিত্রান পেতে পারে। এই বলে সরদার আব্দুল মুত্তালিব উঠে গিয়ে কা’বার দরজা ধরেন ও তাঁর সঙ্গে কিছু সংখ্যক কুরাইশ বংশের লোক আবরাহা ও তার সেনার বিরুদ্ধে আল্লাহ সমীপে দোয়া করেন ও সাহায্য চান। বিশেষ করে আব্দুল মুত্তালিব কা’বার দরজা ধরে এই দোয়া করেনঃ “হে আল্লাহ! সকল মানুষ নিজ নিজ ঘরের হেফাজত করে। তুমি তোমার ঘরের হেফাজত কর। আগামীকাল যেন তার সালীব (খৃষ্টান প্রতীক) ও চক্রান্ত তোমার শক্তির উপর জয়ী না হয়।” যখন সকাল হয় তখন আবরাহা মক্কায় প্রবেশ করার উদ্দেশ্যে প্রস্তুত হন। নিজ হাতি সেনাদলকে সাজান। তার হাতির নাম ছিল ‘মাহমুদ’। সেনারা যখন হাতিকে মক্কার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তখন সে বসে যায়। এমনকি তারা যখন হাতিকে উঠানোর জন্য মারপিট করে, তখন তা উঠতে অস্বীকার করে। যখন তারা একে ইয়েমেনের দিকে ফিরায় তখন তা ছুটতে আরম্ভ করে। অনুরূপ যখন শাম ও পূর্ব দিকে রওয়ানা করা হয় তখন সে ছুটতে আরম্ভ করে এবং যখনই মক্কার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালানো হয় তখনই সে বসে যায়। অতঃপর আল্লাহ তা’য়ালা সমুদ্রের দিক থেকে পাখি প্রেরণ করেন। প্রতিটি পাখি তিনটি করে পাথর বহন করছিল, একটি ঠোঁটে আর দুটি দু’পায়ে। পাথরের আকার ছিল মসুরি ডাল অথবা চলার দানার মতো। ঐ পাথর যার শরীরে লাগছিল সেই ধ্বংস হচ্ছিল। বাকীরা কেউ রাস্তায়, কেউ পানির ঘাটে পড়ে মারা যায়। আবরাহার গায়েও পাথর লাগে। তার লোকেরা তাকে ‘সান’আয়’ (ইয়েমেনের রাজধানী) তে নিয়ে যায়। রাস্তায় তার আঙ্গুলের গিঁট এক এক করে খসে পরে। যখন সে সান’আয় পৌঁছে, তখন সে পাখির ছানার মতো (দুর্বল) হয়ে যায় ও সেখানে মারা যায়। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে কুরাইশদের সম্মান বৃদ্ধি পায় ও অন্যান্য গোত্রের মধ্যে ছরম প্রভাব ফেলে। হাবশীরা যখন আযাবে পতিত হয় ও ধ্বংস হয় এবং আল্লাহ মক্কাকে তাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করেন তখন আরবরা কুরাইশদের সম্মান করে ও বলে, আল্লাহ তাদের হয়ে যুদ্ধ করেছেন এবং শত্রুকে ধ্বংস করেছেন। অনুরুপভাবে এই ঘটনায় আরবদের মাঝে আব্দুল মুত্তালিবের নাম, সম্মান ছড়িয়ে পরে। কারণ তিনি বুদ্ধিমত্তার সাথে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং নিজ কাওমকে বড় বিপদ ও ধ্বংসের মুখ থেকে বাঁচিয়েছিলেন। উৎসঃ বই- পবিত্র মক্কার ইতিহাস, দারুসসালাম পাবলিকেশন্স (আসহাবে ফীল (হাতি ওয়ালার) ঘটনা)
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
সাম্প্রতিক পোষ্ট
"যারা facebook চালায় তারা কখনই ভাল মুসলিম হতে পারে না" "FB তো ইহুদীর আবিষ্কার"?
"যারা facebook চালায় তারা কখনই ভাল মুসলিম হতে পারে না" "FB তো ইহুদীর আবিষ্কার" . "আপনি এত ইসলাম মানেন তাহলে f...
জনপ্রিয় পোষ্ট সমুহ
-
যৌন উত্তেজনার সময় পানির মতো আঠালো যে তরল পদার্থ বের হয়, তা কি নাপাক? একে “মাযী” বলে। আর তা নাপাক। তা বের হলে উযূ নষ্ট হয়ে যায়। শরমগাহ...
-
গুপ্ত অভ্যাস (হস্তমৈথুন) ব্যবহার করা বৈধ কি? গুপ্ত অভ্যাস (হাত বা অন্য কিছুর মাধ্যমে বীর্যপাত, স্বমৈথুন বা হস্ত মৈথুন) করা কিতাব, সুন...
-
মনোমালিন্য ‘‘সংসার সাগরে দুঃখ-তরঙ্গের খেলা, আশা তার একমাত্র ভেলা।’’ কিন্তু সেই ভেলা ডুবে গেলে আর কার কি সাধ্য? স্বামী যদি স্...
-
*সূরা বাকারা ও সূরা আলে-ইমরানের ফজিলত গুলি কি কি? এবং সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াতের অর্থঃ ✔1-রাতে ঘুমানোর আগে সুরা বাক্বারার শেষ ...
-
আপন মামাত, খালাতো, চাচাতো, ফুফাতো বোন, চাচী, মামি, স্ত্রীর বোন বা ভাবীর সাথে মুসাফাহাহ বৈধ কি? যার সাথে পু...
-
কেউ কেউ মনে করেন, আমার মন খুবই পরিস্কার। তাকে আমি মা, খালা, অথবা বোনের মতোই মনে করি ইত্যাদি ইত্যাদি। তাহলে তাঁর সাথে মেলা-মেশা করতে অসুবিধা ...
-
কথা বলার ব্যপারে "ইসলামে"র শিক্ষা কি? ====== ১। কথা বলার পূর্বে সালাম দেয়া। সূরা নূরঃ ৬১ ২। সতর্কতার সাথে কথা বলা। (কে...
-
জাহান্নাম থেকে মুক্তির ১৫টি অসাধারন হাদিস- *১-গীবত থেকে দূরে থাকা- আসমা বিনতে ইয়াযীদ হতে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যাক্তি তার (মুসলি...
-
# দোয়া_কবুল_না_হওয়ার_কারণগুলো_কি_কি ? ---------------------------------------------------------------------- কিছু পাপ আছে যা বান্দার মা...
-
প্রশ্ন:নাটক, সিনেমা দেখা , গল্পের বই পড়া কি জায়েজ ? =============================== উত্তর : যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর। দরুদ ও সালা...
No comments:
Post a Comment