মাসজিদে নারীদের সালাত আদায় করা বৈধ না অবৈধ?
মাসজিদে নারীদের সালাত আদায় করা বৈধ না অবৈধ?
হাদীস-১; আব্দুল্লাহ ইবন উমার(রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণীত রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তোমরা আল্লাহর বান্দীদেরকে(নারীদের) মাসজিদে যেতে নিষেধ করো না। আব্দুল্লাহ ইবন উমার(রাদিয়াল্লাহু আনহু) অন্য সনদে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তোমরা আল্লাহর বান্দীদেরকে মাসজিদে গিয়ে সালাত আদায় করতে নিষেধ করো না। [সহীহ মুসলিম, মুয়াত্তা ইমাম মালিক,আবু দাউদ, মুসনাদ ইমাম আহমাদ;হাদীস-১৩২৭,খণ্ড-২]
হাদীস-২; আবু হুরাইরা(রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
তোমরা আল্লাহর বান্দীদেরকে মাসজিদে যাওয়া থেকে বাধা দিও না, তারা যেন সুগন্ধীবিহীন বের হয়। [আবু দাউদ, দারেমী, বাইহাকী, ইবন খুযাইমা, মুসনাদ ইমাম আহমাদ;হাদীস-১৩২৮,খণ্ড-২]
হাদীস-৩; আব্দুল্লাহ ইবন উমার(রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণীত রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তোমরা তোমাদের নারীদেরকে রাত্রিবেলা মাসজিদে যাওয়া থেকে বাধা প্রদান করবে না। [মুসনাদ ইমাম আহমাদ;হাদীস-১৩৩২,খণ্ড-২]
হাদীস-৪; আয়িশা(রাদিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন নারীরা রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথে ফজরের সালাত আদায় করতো, অতঃপর তাদের চাদর মুড়ি দিয়ে বের হয়ে যেত (তখন) তাদেরকে চেনা যেত না। [সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ, তিরমিযী, ইবন মাজাহ, মুসনাদ ইমাম আহমাদ;হাদীস-১৩৪৪,খণ্ড-২]
হাদীস-৫; আব্দুল্লাহ ইবন উমার(রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তোমরা তোমাদের নারীদেরকে তাদের মাসজিদে যাওয়ার অধিকার থেকে বাধা দিও না। যখন তারা তোমাদের কাছে অনুমতি চাইবে। [সহীহ মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, তাবারানী, মুসনাদ ইমাম আহমাদ;হাদীস-১৩৩৪,খণ্ড-২]
হাদীস-৬; আব্দুল্লাহ ইবন উমার(রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যখন তোমাদের কারো স্ত্রী তার নিকট থেকে মাসজিদে যাওয়ার অনুমতি চায় তখন সে তাকে বাধা দিবে না। রাবী বলেন, উমার(রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর স্ত্রী মাসজিদে সালাত আদায় করতেন। উমার(রাদিয়াল্লাহু আনহু) তাকে বললেন, তুমি তো জান আমি কি পছন্দ করি? তখন তিনি(স্ত্রী) জবাবে বললেন, আল্লাহর কসম! আমাকে তুমি নিষেধ না করা পর্যন্ত আমি এ কাজ(মাসজিদে গিয়ে সালাত আদায় করা) থেকে বিরত হব না। রাবী বলেন- উমার(রাদিয়াল্লাহু আনহু) কে যখন আঘাত(শহীদ) করা হয় তখনও তিনি (তার স্ত্রী) মাসজিদে। [সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, মুসনাদ ইমাম আহমাদ;হাদীস-১৩৩৬,খণ্ড-২]
হাদীস-৭; আবু হুরাইরা(রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যে মহিলা সুগন্ধ জাতীয় দ্রব্য (শরীরে) লাগিয়েছে সে যেন ইশার সালাতে হাযির না হয়। [সহীহ মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাই, ইবন মাজাহ, মুসনাদ ইমাম আহমাদ;হাদীস-১৩৪০,খণ্ড-২]
হাদীস-৮; আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ এর স্ত্রী জয়নব আছ ছাকাফিয়া থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যখন তোমাদের কেউ ইশার জামা’আতে আসবে তখন যেন সে সুগন্ধি স্পর্শ না করে। [সহীহ মুসলিম, মুসনাদ ইমাম আহমাদ;হাদীস- ১৩৪৩,খণ্ড-২]
হাদীস-৯; আব্দুল্লাহ ইবন উমার(রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণীত,রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তোমরা তোমাদের নারীদেরকে মাসজিদে যাওয়াকে বাধা দিও না। অবশ্য (সালাতের জন্য) তাদের গৃহই তাদের জন্য উত্তম। [আবু দাউদ, বায়হাকী, তাবারানী, মুসনাদ ইমাম আহমাদ;হাদীস-১৩৩৩,খণ্ড-২]
এই মর্মে আরো হাদীস রয়েছে যে নারীরা মাসজিদে গিয়ে সালাত আদায় করতে পারবে। ইমাম মালিক, ইমাম শাফেঈ, ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল এরও এই অভিমত পাওয়া যায়।
ইমাম আবু হানিফা এর অনুসারীরা এই বিষয়ে দু’ভাগে বিভক্ত। তাদের একদল বলে যে নারীরা মাসজিদে সালাত আদায় করতে পারবে আরেকদল বলে যে নারীরা মাসজিদে সালাত আদায় করতে পারবে না।
উপরক্ত ৯টি হাদীস থেকে এটি প্রমানিত যে নারীরা মাসজিদে সালাত আদায় করতে পারবে, আর কেউ যদি নারীদের মাসজিদে গিয়ে সালাত আদায় করতে বাধা দেয় তাহলে সে রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর বিরুদ্ধাচারন করলো, কেননা রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “তোমরা আল্লাহর বান্দীদেরকে(নারীদের) মাসজিদে যেতে নিষেধ করো না”।
নারীরা মাসজিদে গিয়ে সালাত আদায় করতে পারবে কিন্তু একটি নিয়ম তাদের মেনে চলতে হবে, তা হল তারা সুগন্ধি লাগিয়ে মাসজিদে যেতে পারবে না, কেননা রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “তোমরা আল্লাহর বান্দীদেরকে মাসজিদে যাওয়া থেকে বাধা দিও না, তারা যেন সুগন্ধীবিহীন বের হয়”
উক্ত হাদীস দ্বারা প্রমানিত হয় যে সুগন্ধীবিহীন অবস্থায় মাসজিদে যাওয়া একটি সর্ত। অর্থাৎ নারীদের সুগন্ধীবিহীন অবস্থায় মাসজিদে যেতে হবে।
নারীদের জন্য কোথায় সালাত আদায় করা উত্তম?
নারীদের জন্য তাদের নিজেদের গৃহে সালাত আদায় করা উত্তম। কেননা,
উম্মু সালামা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ(সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, নারীদের সর্বোত্তম মাসজিদ হচ্ছে, তাদের গৃহের কুঠরি। [তাবারানী, ইবন খুজাইমা, মুসনাদ ইমাম আহমাদ;হাদীস-১৩৩৮,খণ্ড-২]
অর্থাৎ, নারীদের জন্য মাসজিদে গিয়ে সালাত আদায় করা বৈধ কিন্তু তাদের জন্য উত্তম হল তাদের গৃহে সালাত আদায় করা।
যারা বলে নারীদের মাসজিদে গিয়ে সালাত আদায় করা বৈধ নয়, তাদের জবাবঃ
যারা বলে নারীদের মাসজিদে গিয়ে সালাত আদায় করা বৈধ নয় তারা দলীল হিসাবে পেশ করে যে,
মা আয়েশা(রাদিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, যদি রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আজকের দিনের নারীদেরকে দেখতেন তাহলে তাদের মাসজিদে যেতে বারন করতেন। [মুসনাদ ইমাম আহমাদ;হাদীস-১৩৪১,১৩৪২,খণ্ড-২]
উক্ত হাদীর ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত হানাফী ফাকিহ আবুল হাই লাখনোভী(রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ “উক্ত হাদীস দ্বারা নারীদের মাসজিদে যাওয়ার বৈধতা প্রমানিত হয়, কেননা উক্ত হাদিসে আয়েশা(রাদিয়াল্লাহু আনহা) বলেছেন যদি রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আজকের দিনের নারীদেরকে দেখতেন তাহলে তাদের মাসজিদে যেতে বারন করতেন, কিন্তু যেহেতু নিষেধ করেননি সেহেতু একে নিষেধ করার মত কেউ নেই”
প্রকৃত পক্ষেই উক্ত হাদীস নারীদের মাসজিদে যাওয়ার বৈধতা প্রমান করে, কেননা আয়েশা(রাদিয়াল্লাহু আনহা) বলেছেন যদি রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আজকের দিনের নারীদেরকে দেখতেন তাহলে তাদের মাসজিদে যেতে বারন করতেন, কিন্তু যেহেতু রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেই নারীদেরকে দেখেননি এবং নিষেধও করেননি সেহেতু নারীদের মাসজিদে যাওয়া এখনও বৈধ।
যারা বলে নারীদের মাসজিদে গিয়ে সালাত আদায় করা বৈধ নয় তারা একটি মিথ্যা দলীল পেশ করে, তারা বলে যে, উমার(রাদিয়াল্লাহু আনহু) নারীদের মাসজিদে গিয়ে সালাত আদায় করাকে হারাম করেছেন।(নাউযুবিল্লাহ) এত বড় অপবাদ একজন সাহাবীর নামে দিতে তাদের কি বুক কাঁপে না???
কোন হাদীসে এই কথা নেই যে উমার(রাদিয়াল্লাহু আনহু) নারীদের মাসজিদে গিয়ে সালাত আদায় করাকে হারাম করেছেন। বরং সহীহ হাদীসে আমরা তার উল্টোটা পাই, তা হল-
উমার(রাদিয়াল্লাহু আনহু) কে যখন আঘাত(শহীদ) করা হয় তখনও তিনি (তার স্ত্রী) মাসজিদে। [সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, মুসনাদ ইমাম আহমাদ;হাদীস-১৩৩৬,খণ্ড-২]
যদি উমার(রাদিয়াল্লাহু আনহু) নারীদের মাসজিদে গিয়ে সালাত আদায় করাকে হারাম করে থাকেন তাহলে যখন উমার(রাদিয়াল্লাহু আনহু) কে যখন আঘাত(শহীদ) করা হয় তখন তার স্ত্রী মাসজিদে কাভাবে থাকে? তার মানে কি উমার(রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর স্ত্রী হারাম [যদি উমার(রাদিয়াল্লাহু আনহু) নারীদের মাসজিদে গিয়ে সালাত আদায় করাকে হারাম করে থাকেন] কাজ করেছেন? না, কখনই না, উমার(রাদিয়াল্লাহু আনহু) কখনই নারীদের মাসজিদে গিয়ে সালাত আদায় করাকে হারাম করেন নি।
এছাড়াও আমরা জানি যে, মা আয়েশা(রাদিয়াল্লাহু আনহা) সারা জীবন মাসজিদে সালাত আদায় করতেন।
অর্থাৎ, যারা বলে নারীদের মাসজিদে গিয়ে সালাত আদায় করা বৈধ নয়, তারা মূলত ভুল কথা বলছেন।
আর মা আয়েশা(রাদিয়াল্লাহু আনহা) কেন বললেন যে, যদি রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আজকের দিনের নারীদেরকে দেখতেন তাহলে তাদের মাসজিদে যেতে বারন করতেন?
মা আয়েশা(রাদিয়াল্লাহু আনহা) এই কথা বলেছেন তার কারন হল, নারীরা সুগন্ধী লাগিয়ে মাসজিদে যাওয়া শুরু করেছিল। তার প্রমানঃ
আয়েশা(রাদিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তোমরা আল্লাহর বান্দীদেরকে আল্লাহর মাসজিদে যেতে বাধা দিও না। আর তারা মাসজিদে যাবে সুগন্ধীমুক্ত(সুগন্ধী বিহীন) অবস্থায়। আয়েশা(রাদিয়াল্লাহু আনহা) বলেন- যদি রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আজকের দিনের নারীদেরকে দেখতেন তাহলে তাদের মাসজিদে যেতে বারন করতেন। [মুসনাদ ইমাম আহমাদ;হাদীস-১৩৪১,খণ্ড-২]
উক্ত হাদীসে সুগন্ধী লাগানোর বিষয়টি এবং রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর বারন করার বিষয়টি একই সাথে আসায় এটিই প্রমান হয় যে নারীদের সুগন্ধী লাগিয়ে মাসজিদে আসার অবস্থা দেখে মা আয়েশা এই কথা বলেছেন। এই কথার প্রমান বহন করে নীচের হাদিসটি,
আয়েশা(রাদিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নিশ্চয়ই আজকে আমরা নারী সমাজের যে অবস্থা দেখছি, তা যদি রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দেখতেন তাহলে অবশ্যই তাদের মাসজিদে যেতে বারন করে দিতেন। [মুসনাদ ইমাম আহমাদ;হাদীস-১৩৪২,খণ্ড-২]
সুতরাং, নারীদের জন্য নিজ গৃহে সালাত আদায় করা উত্তম, মাসজিদে সালাত আদায় করা বৈধ তবে শর্ত হল যে সুগন্ধী ছাড়া মাসজিদে যেতে হবে।
ক্যারিয়ার হিসেবে মেয়েদের জন্য এয়ার হোস্টেস / কেবিন ক্রু ক্যারিয়ার বেছে নেয়া প্রসঙ্গে
ক্যারিয়ার হিসেবে মেয়েদের জন্য এয়ার হোস্টেস / কেবিন ক্রু ক্যারিয়ার বেছে নেয়া প্রসঙ্গেঃঅনেকের কাছে এটা স্বপ্নের ক্যারিয়ার।
অধিকাংশ লোকই মনে করে থাকে-
উন্নত জীবনের প্রত্যাশী তরুণীদের জন্যও কেবিন ক্রু একটি আদর্শ পেশা , আকাশে স্বপ্নের ঠিকানা। আকাশে উড়ার সাধ অনেকেরই থাকে। বিশেষ করে এয়ার হোস্টেস/কেবিন ক্রু হয়ে। এ পেশায় আকাশের বুকে উড়ার পাশাপাশি জানা যায়গোটা বিশ্বকেই।
উন্নত জীবনের প্রত্যাশী তরুণীদের জন্যও কেবিন ক্রু একটি আদর্শ পেশা , আকাশে স্বপ্নের ঠিকানা। আকাশে উড়ার সাধ অনেকেরই থাকে। বিশেষ করে এয়ার হোস্টেস/কেবিন ক্রু হয়ে। এ পেশায় আকাশের বুকে উড়ার পাশাপাশি জানা যায়গোটা বিশ্বকেই।
এই পেশার যে লাইফ স্টাইল এবং রোমাঞ্চকর অনুভূতি তা সহজেই তরুণ তরুণীদের আকর্ষণ করে। এছাড়া বেতন ও রোজগারও ভাল। মধ্যপ্রাচ্যের এয়ারলাইন্সগুলো লক্ষাধিক, ব্রিটিশ সিঙ্গাপুর সহ অন্যান্য এয়ার লাইন্সে কেবিন ক্রু ১ লাখ টাকারও বেশি আয় করে থাকে। কেবিন ক্রু যখন যে দেশে যায় তার সে দেশে থাকা খাওয়ার খরচ ও ফ্লাইং আওয়ার ভিত্তিতে ভাতা পেয়ে থাকে। অন্যান্য পেশার চাকরির মত এই পেশায় রয়েছে প্রভিডেন্ট ফান্ড, মেডিকেল বেনিফিট, আবাসন সহ বিভিন্ন সুবিধাবলী।
কথাগুলো শুনে মনে হতে পারে এটি নারীদের জন্য অত্যান্ত সম্মানজনক পেশা।
কিন্তু আসুন দেখি এ ব্যাপারে ইসলামী শারিয়াহ কি বলেঃ
কিন্তু আসুন দেখি এ ব্যাপারে ইসলামী শারিয়াহ কি বলেঃ
বেশীরভাগ ফ্লাইটের এয়ার হোস্টেস হিসেবে নারীদের নিয়োগ দেয়া হয়। আর এয়ার হোস্টেস হিসেবে কোন কুৎসিত চেহারার নারী কখনোই আপনি দেখবেন না। এয়ার হোস্টেস হিসেবে শুধুমাত্র সুন্দরী রমনীদের-ই নিয়োগ দেয়া হয়। এছাড়াও এয়ার হোস্টেস হিসেবে কোন বিবাহিত নারীকে নিয়োগ দেয়া হয় না। কোন মেয়েকে নিয়োগ দেয়ার পর তাকে শর্ত দিয়ে দেয় যে- আপনি আগামী ৫ বছরের মধ্যে বিয়ে করতে পারবেন না। কোন নারীর বয়স ৩৫ ঊর্ধ্ব হয়ে গেলে তাকে আর রাখা হয় না। কোন নারী সন্তান প্রসব করার কারনে যদি তার ফিগার নষ্ট হয়ে যায় তবে তাকে আর রাখা হয় না। এটা আসলে কাস্টমারদের আকৃষ্ট করার একটা কৌশল। এভাবে তারা নারীকে পণ্য বানিয়ে গ্রাহক আকৃষ্ট করছে। এবার আপনারাই বলুন এই পেশাটা সম্মানজনক নাকি নারীর পণ্যায়ণ?
অনেক সময় অনেক পুরুষ যাত্রী টিজ করার উদ্দেশে নারী এয়ার হোস্টেসকে আদেশ করে- আমার সিট বেল্টটা বেঁধে দিন। তখন ঐ নারীর অন্য কোন উপায় থাকে না তাকে সিট বেল্ট বেঁধে দেয়া ছাড়া। ফলে ঐ নারীকে ঐ পুরুষের খুব কাছাকাছি আসতে হয় আর সুযোগে ঐ পুরুষ যাত্রী তাকে টিজ করে।
এবার আপনারাই বলুন এই পেশা কি সম্মানজনক?
আমিই পূর্বেই বলেছি-
এই পেশার যে লাইফ স্টাইল এবং রোমাঞ্চকর অনুভূতি তা সহজেই তরুণ তরুণীদের আকর্ষণ করে। এছাড়া বেতন ও রোজগারও ভাল। মধ্যপ্রাচ্যের এয়ারলাইন্সগুলো লক্ষাধিক, ব্রিটিশ সিঙ্গাপুর সহ অন্যান্য এয়ার লাইন্সে কেবিন ক্রু ১ লাখ টাকারও বেশি আয় করে থাকে। কেবিন ক্রু যখন যে দেশে যায় তার সে দেশে থাকা খাওয়ার খরচ ও ফ্লাইং আওয়ার ভিত্তিতে ভাতা পেয়ে থাকে। অন্যান্য পেশার চাকরির মত এই পেশায় রয়েছে প্রভিডেন্ট ফান্ড, মেডিকেল বেনিফিট, আবাসন সহ বিভিন্ন সুবিধাবলী।
এই পেশার যে লাইফ স্টাইল এবং রোমাঞ্চকর অনুভূতি তা সহজেই তরুণ তরুণীদের আকর্ষণ করে। এছাড়া বেতন ও রোজগারও ভাল। মধ্যপ্রাচ্যের এয়ারলাইন্সগুলো লক্ষাধিক, ব্রিটিশ সিঙ্গাপুর সহ অন্যান্য এয়ার লাইন্সে কেবিন ক্রু ১ লাখ টাকারও বেশি আয় করে থাকে। কেবিন ক্রু যখন যে দেশে যায় তার সে দেশে থাকা খাওয়ার খরচ ও ফ্লাইং আওয়ার ভিত্তিতে ভাতা পেয়ে থাকে। অন্যান্য পেশার চাকরির মত এই পেশায় রয়েছে প্রভিডেন্ট ফান্ড, মেডিকেল বেনিফিট, আবাসন সহ বিভিন্ন সুবিধাবলী।
বর্তমানে মুসলিম নারীরা পশ্চিমা বিশ্বের কাফের নারীদের খোলামেলা ও অবাধবিচরন দেখে এই ধরণের পেশার প্রতি আকৃষ্ট হয়।
কিন্তু আমাদের রব বলেছেনঃ দেশে-বিদেশে কাফেরদের অবাধচাল-চলন যেন তোমাদিগকে মোহে না ফেলে দেয়। এটা হলো সামান্য দিনেরপ্রাপ্তি। এরপর তাদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম। আর সেটি হলো অতি নিকৃষ্ট স্থান। (সুরা আলেইমরানঃ ১৯৬-১৯৭)
মহান আল্লাহ্ আরো বলেনঃ “পার্থিব জীবনের উপর কাফেরদিগকে উম্মত্ত করে দেয়া হয়েছে। আর তারা ঈমানদারদের প্রতি লক্ষ্য করে হাসাহাসি করে। পক্ষান্তরে যারা পরহেযগার তারা সেই কাফেরদের তুলনায় কেয়ামতের দিন অত্যন্ত উচ্চমর্যাদায় থাকবে। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সীমাহীন রুযী দান করেন। (সুরা বাকারাঃ ২১২)
মুখমণ্ডল কি হিজাবের অংশ নয়?
মুখমণ্ডল কি হিজাবের অংশ নয়?
বর্তমান বিশ্বে হিজাব পশ্চিমা রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাথাব্যথার বিষয়। তারা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন হিসেবে চিহ্নিত করে হিজাবের প্রসারকে বাধাগ্রস্থ করতে নানা কৌশল ও প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে। এর বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাক ও নিকোলা সারকোজি, সাবেক ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জ্যাক স্ট্র, রাশিয়ার প্রেসিডেন্টসহ বহু রাজনীতি ও শিক্ষাবিদসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ পেশার লোক।
২০০২ সালে সাবিনা নামক এক স্কুলছাত্রী উত্তর লন্ডনের ডেনবিগ হাইস্কুল থেকে বহিস্কৃত হন; জার্মানিতে স্কুল শিক্ষিকা ফিরিশতা লুদিন চাকুরি হারান হিজাবের সপক্ষে কথা বলায়। ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে হিজাব নিষিদ্ধ করে আইন পাশ করে ফ্রান্স। সুইডেনে হিজাব সম্মত পোশাক পরার অপরাধে চাকরি হারাতে হয় অনেক নারীকে। ২০০২ সালের ডিসেম্বরে সুইডিশ টিভি হিজাব পরা এক মুসলিম উপস্থাপিকার উপস্থাপনায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তেমনি অনেক দেশেই হিজাবকে ‘আইনী লড়াই’ এবং নানা রকম বাধা ও প্রতিরোধের মুখে পড়তে হচ্ছে।
এমন প্রেক্ষাপটে পাশ্চাত্য ধারার শিক্ষা ও চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত কিছু কিছু ইসলামিক স্কলার বা মুসলিম রাজনীতিক হিজাবের প্রতি গুরুত্ব প্রদান সত্ত্বেও নিকাবকে অস্বীকার কিংবা অপ্রয়োজনীয় বলে দাবী করছেন। হোসনী মোবারকের আমলে মিশরের ঐতিহ্যবাহী আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শায়খ তানতাবী তো নিকাবকে অস্বীকার করেই বসেছিলেন। তখন এ ঘটনা পুরো মুসলিম বিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছিল। এর আগে এবং পরে বর্তমানকাল পর্যন্ত মেয়েদের নিকাব তথা মুখবন্ধনী হিজাব বা পর্দার অন্তর্ভুক্ত কি-না বিষয়টি নিয়ে মাঝে মধ্যে অনেকে কবরে দাফন হয়ে যাওয়া বিতর্ক নতুন করে চাঙ্গা করতে সচেষ্ট হয়েছেন। সর্বশেষ বাংলাদেশে গত ১৪ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার) দৈনিক যুগান্তরের ‘ইসলাম ও জীবন’ পাতায় একটি লেখা প্রকাশিত হয় ‘কোরআনের পর্দাকে বোরকায় ঢাকল কারা’ শিরোনামে। লেখাটিতে ইসলামের পর্দা বিধানের দুটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ-‘বোরকা’ ও ‘পরপুরুষের সামনে নারীর চেহারা আবৃত রাখা’র বিষয়ে কিছু অশালীন ও অমার্জিত বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে। অস্বীকার করা হয়েছে মুখ ঢাকার আবশ্যকীয়তাকে।
মূলত বিষয়টি এক পর্যায়ে ইষৎ বিরোধপূর্ণ ছিল। চেহারা পর্দার অংশ নয় মর্মে কিছু বক্তব্য আছে ঠিকই। কিন্তু নানা মত ও যুক্তি পর্যালোচনার পর অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মত ও তাবৎ শরীয়তবিদের সিদ্ধান্ত হলো, হিজাব যেমন অপরিহার্য, ঠিক তেমনি নিকাব তথা মুখ ঢাকাও অত্যাবশ্যক। দু’টিকে পৃথক ভাবার কারণ নেই। কারণ শরীয়তে দু’টো পৃথক কোনো বিষয় নয়। যখন হিজাব শব্দটি আসে তখন তার শর‘ঈ অর্থ এটাই বুঝা যায়, নারী মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে রাখবে। কুরআনে কারীমের সূরা আল-আহযাবে মুসলিম নারীদেরকে স্পষ্টভাবে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে, ঘর থেকে বাইরে বেরুবার সময় যেন তারা নিজেদের শরীরে জিলবাব ঝুলিয়ে নেয়। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ قُل لِّأَزۡوَٰجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَآءِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ يُدۡنِينَ عَلَيۡهِنَّ مِن جَلَٰبِيبِهِنَّۚ ذَٰلِكَ أَدۡنَىٰٓ أَن يُعۡرَفۡنَ فَلَا يُؤۡذَيۡنَۗ وَكَانَ ٱللَّهُ غَفُورٗا رَّحِيمٗا ٥٩ ﴾ [الاحزاب: ٥٩]
‘হে নবী, তুমি তোমার স্ত্রীগণকে, কন্যাগণকে ও মু’মিনদের নারীগণকে বল, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজতর হবে, ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না।’ {সূরা আল-আহযাব, আয়াত : ৫৯}
পর্দা বিষয়ে এ আয়াত অত্যন্ত পরিস্কার ও স্পষ্ট। কারণ, এ আয়াত থেকে জানা যায়, পর্দার নির্দেশের মধ্যে মুখমণ্ডলও অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়া এ আয়াতে আযওয়াজে মুতাহহারাত (রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পুতঃপবিত্র সহধর্মীনীগণ) ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কন্যাগণের সঙ্গে মুসলিম মহিলাদেরও সম্বোধন করা হয়েছে। এ আয়াতে ‘জালাবীব’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যা ‘জিলবাব’ শব্দের বহুবচন। আরবী অভিধানের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘লিসানুল ‘আরাব’ –এ লেখা হয়েছে, ‘জিলবাব’ ওই চাদরকে বলা হয় যা মহিলারা নিজেদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকার জন্য ব্যবহার করে। [১/২৭৩]
অভিধান থেকে সরে গিয়ে মুফাসসিরগণের বক্তব্য দেখলেও জানা যায়, ‘জিলবাব’ এমন কাপড়কে বলে যদ্বারা মহিলারা নিজেদের শরীর ঢাকেন। ‘জিলবাব’ অর্থ বড় চাদর, যা দ্বারা মুখমণ্ডল ও পূর্ণ দেহ আবৃত করা যায়। [কুরতুবী, আল-জামে‘ লিআহকামিল কুরআন : ১৪/২৪৩]
আল্লামা আলূসী রহ. ‘আব্দুল্লাহ ইবন ‘আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর বরাত দিয়ে লিখেন, ‘জিলবাব’ সেই চাদরকে বলে যা মহিলারা দেহের ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত উড়িয়ে ছেড়ে দেয়। [রুহুল মা‘আনী : ২২/৮৮]
আল্লামা ইবন হাযম রহ. লিখেন, আরবী ভাষায় ‘জিলবাব’ এমন কাপড়কে বলা হয় যা সারা শরীর আচ্ছাদন করে। যে কাপড় সমস্ত শরীর ঢাকে না, সে কাপড়ের ক্ষেত্রে ‘জিলবাব’ শব্দটির প্রয়োগ সঠিক ও শুদ্ধ নয়। [আল-মুহাল্লা : ৩/২১৭]
তাই শত শত বছর যাবৎ মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র যে দীনদার নারীগণ নিকাব ও হিজাব পরিধান করে আসছেন তাঁরা এই জিলবাব ধারণের বিধানই পালন করছেন।
রূহুল মা‘আনী গ্রন্থের লেখক يُدۡنِينَ عَلَيۡهِنَّ এর তফসীরে লিখেছেন, শব্দটি অভিধানে কোনো জিনিস নিকটবর্তী করা অর্থে বলা হয়। এখানে শব্দটি ঝুলানো এবং ফেলে দেওয়া অর্থে এসেছে। কারণ, শব্দটিকে এখানে عَلَيۡ (‘আলা) অব্যয় দ্বারা কর্মবাচক ক্রিয়ায় রূপান্তর করা হয়েছে। [রুহুল মা‘আনী : ২২/৮৮]
আল্লামা যামাখশারী রহ. শব্দটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেন, এর অর্থ, মহিলারা নিজেদের মুখমণ্ডলের ওপর চাদর টেনে দেবে। যেমন : কোনো মহিলার মুখমণ্ডল থেকে নিকাব সরে যায় তখন তাকে আরবীতে বলা হয় : (ইউদ্নী ছাওবিকে আলা ওয়াজহিকে) তোমার মুখমণ্ডলের ওপর তোমার কাপড় ফেলে দাও। (প্রাগুক্ত) এ থেকে বুঝা গেল, কুরআন কারীমের এই আয়াতে মুখমণ্ডল ঢাকার স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে।
কোনো কোনো সাহাবী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তাঁরা পর্দা হিসেবে ‘জিলবাব’ ব্যবহারের নিয়ম-পদ্ধতিও বর্ণনা করেছেন। ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু মুখমণ্ডলের ওপর ‘জিলবাব’ ফেলার যে পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন তা হলো, ‘মুসলিম মহিলারা নিজেদের চাদর দ্বারা নিজ নিজ মাথা ও মুখমণ্ডল ঢেকে বের হবে। তারা কেবল একটি চোখ খোলা রাখতে পারে’। [শাওকানী, ফাতহুল কাদীর : ৭/৩০৭]
জনৈক ব্যক্তি ‘উবায়দা ইবন সুফইয়ান ইবন হারিছ হাযরামী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর কাছে এর নিয়ম জানতে চান। তিনি নিজের চাদরটি উঠিয়ে এমনভাবে ছড়িয়ে দেন যে, তাঁর মাথা ও কপাল ভ্রূ পর্যন্ত ঢেকে যায়। তারপর চাদরের কিছু অংশ মুখমণ্ডলের ওপর এমনভাবে রাখেন যে, গোটা মুখমণ্ডল ঢেকে যায়, কেবল একটি চোখ খোলা থাকে। [তাফসীরে কুরতুবী : ৪/২৩৪]
সূরা আল-আহযাবের উল্লেখিত আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে সকল মুফাসসির মুখমণ্ডল ঢাকা হিজাবের অত্যাবশ্যক অংশ গণ্য করেছেন। আবূ বকর আর-রাযী ও আল-জাস্সাস আল-হানাফী রহ. বলেন, এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়, যুবতী মহিলারা ঘর থেকে বাইরে বেরোনোর সময় বেগানা পুরুষের দৃষ্টি থেকে তাদের মুখমণ্ডল আবশ্যিকভাবে ঢেকে রাখবে, যাতে দুষ্ট প্রকৃতির লোক তাদেরকে বিরক্ত করতে না পারে। [আহকামুল কুরআন : ৩/৩৭১]
আল্লামা নাসাফী আল-হানাফী রহ. লিখেছেন, মহিলারা চাদর বা অন্য কিছু নিজেদের মাথার ওপর ছেড়ে দেবে এবং নিজেদের মুখমণ্ডল ও দেহের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঢেকে নেবে। [মাদারিকুত- তানযীল : ৩/৭৯]
ইমাম নাববী রহ. স্বীয় গ্রন্থ ‘আল-মিনহাজ’-এ লিখেছেন, যদি ফিতনার আশংকা থাকে তাহলে কোনো প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষের জন্য কোনো প্রাপ্ত বয়স্কা নারীর মুখমণ্ডল ও হাত দেখা জায়িয নেই। আল্লামা রামালী রহ. ‘আল-মিনহাজ’ গ্রন্থের ব্যাখ্যায় এই মতের ওপর আলিমগণের ইজমা’র কথা বর্ণনা করেছেন। তিনি এও লিখেছেন, সঠিক মতানুযায়ী ফিতনার আশংকা না থাকলেও প্রাপ্ত বয়স্কা নারীকে দেখা হারাম। এর দ্বারা বুঝা যায়, মুখমণ্ডল খোলা অবস্থায় মহিলাদের বাইরে বের হওয়া জায়িয নেই। কারণ, সে অবস্থায় পুরুষ তাদেরকে দেখবে এবং দেখার মাধ্যমে ফিতনা ও কুপ্রবৃত্তির সৃষ্টি হবে। [নিহায়াতুল মিনহাজ ইলা শারহিল মিনহাজ : ৬/১৮৮]
শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যা রহ. বলেন, বেগানা পুরুষ দেখতে পারে এমনভাবে মহিলাদের মুখমণ্ডল খোলা রাখা জায়িয নেই। দায়িত্বশীল পুরুষদের (স্বামী, পিতা, ভাই প্রমুখের) উচিত ‘আমর বিল মা‘রুফ’ ও ‘নাহি ‘আনিল মুনকার’ তথা ‘সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধে’র অংশ হিসেবে তাদেরকে এমন কাজ থেকে বিরত রাখতে সচেষ্ট হওয়া। অধীনস্থ নারীদের পর্দাহীনতা থেকে বিরত না রাখাও দায়িত্বশীল পুরুষদের জবাবদিহিতামূলক অপরাধ। এজন্য তাদেরকে শাস্তিও দেয়া যেতে পারে। [মাজমূ‘ ফাতাওয়া : ২৪/৩৮২]
হাফিয ইবনুল কাইয়্যিম রহ. লিখেন, স্বাধীন নারী মুখমণ্ডল ও হাতের কবজি পর্যন্ত খোলা রেখে সালাত আদায় করতে পারে (এই শর্তে যে সেখানে কোনো বেগানা পুরুষ থাকবে না)।
তবে এ অবস্থায় সে বাজারে এবং পুরুষের ভীড়ের মধ্যে যেতে পারবে না। [ই‘লাম আল-মুওয়াককিঈন : ২/৮০]
আল্লামা সুয়ূতী আশ-শাফিঈ‘ রহ. উল্লেখিত আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে লিখেন, হিজাবের আয়াত সব নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মাথা ও মুখমণ্ডল ঢাকা যে ওয়াজিব তা এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়।[‘আওনুল মা’বুদ : ১১/১৫৪]
হাফিয ইবনুল কারবী মালেকী রহ.ও এই আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে লিখেন, ‘অভিজাত আরব মহিলারা দাসীদের মত মুখমণ্ডল খোলা অবস্থায় ঘোরাফেরা করতো। এতে পুরুষের দৃষ্টি আন্দোলিত হতো। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে নির্দেশ দেন, তারা যেন শরীরের ওপর জিলবাব পরে নেয়। তাহলে তাদের মুখমণ্ডল তাদের দৃষ্টির আড়ালে চলে যাবে। [আত-তাসহীল লি ‘উলুমি তানযীল : ৩/১৪৪]
আল্লামা বাহুতী হাম্বলী রহ. -এরও এই মত যে, সালাতের বাইরে স্বাধীন ও প্রাপ্ত বয়স্ক নারীর দু’হাতের কবজি এবং মুখমণ্ডলও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতই পর্দার অন্তর্ভুক্ত। [কাশফুল কান্না‘ : ১/২৬৬]
হিজাবের আয়াত নাযিলের পর আযওয়াজে মুতাহ্হারাত ও অন্যান্য মহিলা সাহাবীদের যে কর্মপদ্ধতি ছিল তা দ্বারাও এটা প্রমাণিত হয় যে, মহিলাদের জন্য মুখমণ্ডল ঢাকা জরুরী। যখন এই আয়াত নাযিল হয় :
﴿ وَقُل لِّلۡمُؤۡمِنَٰتِ يَغۡضُضۡنَ مِنۡ أَبۡصَٰرِهِنَّ وَيَحۡفَظۡنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبۡدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنۡهَاۖ وَلۡيَضۡرِبۡنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّۖ وَلَا يُبۡدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوۡ ءَابَآئِهِنَّ أَوۡ ءَابَآءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوۡ أَبۡنَآئِهِنَّ أَوۡ أَبۡنَآءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوۡ إِخۡوَٰنِهِنَّ أَوۡ بَنِيٓ إِخۡوَٰنِهِنَّ أَوۡ بَنِيٓ أَخَوَٰتِهِنَّ أَوۡ نِسَآئِهِنَّ أَوۡ مَا مَلَكَتۡ أَيۡمَٰنُهُنَّ أَوِ ٱلتَّٰبِعِينَ غَيۡرِ أُوْلِي ٱلۡإِرۡبَةِ مِنَ ٱلرِّجَالِ أَوِ ٱلطِّفۡلِ ٱلَّذِينَ لَمۡ يَظۡهَرُواْ عَلَىٰ عَوۡرَٰتِ ٱلنِّسَآءِۖ وَلَا يَضۡرِبۡنَ بِأَرۡجُلِهِنَّ لِيُعۡلَمَ مَا يُخۡفِينَ مِن زِينَتِهِنَّۚ وَتُوبُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ ٣١ ﴾ [النور: ٣١]
‘আর মুমিন নারীদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। আর যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য তারা প্রকাশ করবে না। তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে বক্ষদেশকে আবৃত করে রাখে। আর তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, নিজদের ছেলে, স্বামীর ছেলে, ভাই, ভাই এর ছেলে, বোনের ছেলে, আপন নারীগণ, তাদের ডান হাত যার মালিক হয়েছে, অধীনস্থ যৌনকামনামুক্ত পুরুষ অথবা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ বালক ছাড়া কারো কাছে নিজদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। আর তারা যেন নিজদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশ করার জন্য সজোরে পদচারণা না করে। হে মুমিনগণ, তোমরা সকলেই আল্লাহর নিকট তাওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।’ {সূরা আন-নূর, আয়াত : ৩১}
তখন মহিলা সাহাবীদের আমল কী ছিল তা আমরা জানতে পারি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয়তমা পত্নী আয়িশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার বর্ণনা থেকে। তিনি বলেন,
يَرْحَمُ اللَّهُ نِسَاءَ الْمُهَاجِرَاتِ الأُوَلَ لَمَّا أَنْزَلَ اللَّهُ : {وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَى جُيُوبِهِنَّ} شَقَّقْنَ مُرُوطَهُنَّ فَاخْتَمَرْنَ بِهِ.
‘আল্লাহ হিজরতকারী অগ্রবর্তী নারীদের ওপর রহমত করুন। যখন তিনি নাযিল করলেন, ‘আর তারা যেন তাদের বক্ষের ওপর ওড়না টেনে দেয়’ তখন তারা তাদের নিম্নাংশের কাপড়ের প্রান্ত ছিঁড়ে ফেলেন এবং তা দিয়ে ওড়না বানিয়ে নেন।’ [বুখারী : ৮৫৭৪]
আলোচ্য বর্ণনায় ‘ইখতামারনা’ শব্দটি এসেছে। সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যাকার হাফিয ইবন হাজার ‘আসকালানী রহ. ‘ইখতামারনা’ শব্দের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘গাত্তাইনা উজুহাহুন্না’।
অর্থাৎ তারা নিজেদের মুখমণ্ডল ঢেকে রাখতেন। [ফাতহুল বারী : ৮/৩৪৭]
শুধু পবিত্র কুরআনের তাফসীর নয় চেহারা আবৃত রাখার বিধান সহীহ হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত। আবদুল্লাহ ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« وَلاَ تَنْتَقِبِ المَرْأَةُ المُحْرِمَةُ، وَلاَ تَلْبَسِ القُفَّازَيْنِ»
‘আর ইহরাম গ্রহণকারী নারী যেন নিকাব ও হাতমোজা পরিধান না করে।’ [বুখারী : ১৮৩৮] এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে মেয়েরা তাদের হাত ও চেহারা ঢাকতেন। এ কারণে ইহরামের সময় নেকাব ও দস্তানা না পরার আদেশ করতে হয়েছে।
আয়েশা রাদিআল্লাহু ‘আনহা হজ অবস্থায় মহিলা সাহাবীদের পর্দার যে বিবরণ দিয়েছেন তা থেকে অনুমান করা যায় পর্দা রক্ষায় তাঁরা কতটা আন্তরিক ছিলেন। তাঁরা স্বাভাবিক অবস্থায় তো বটেই ইহরাম অবস্থায় যখন মুখ ঢাকতে নিষেধ করা হয়েছে সেখানেও পরপুরুষের সামনে থেকে নিজেদের চেহারা আড়াল করেছেন। আয়েশা রাদিআল্লাহু ‘আনহা বলেন,
كَانَ الرُّكْبَانُ يَمُرُّونَ بِنَا وَنَحْنُ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- مُحْرِمَاتٌ فَإِذَا حَاذَوْا بِنَا سَدَلَتْ إِحْدَانَا جِلْبَابَهَا مِنْ رَأْسِهَا إِلَى وَجْهِهَا فَإِذَا جَاوَزُونَا كَشَفْنَاهُ.
‘আমরা ইহরাম অবস্থায় সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ছিলাম। তখন আরোহীরা আমাদের সঙ্গে পথ চলছিলেন। যখন তারা আমাদের আড়াআড়ি হন, আমাদের সঙ্গীনীরা তাদের বড় চাদর মাথা থেকে চেহারায় ঝুলিয়ে দেন। তারা আমাদের অতিক্রম করে চলে যাবার পরই আমরা তা উন্মুক্ত করি।’ [আবূ দাঊদ : ৫৩৮১; বাইহাকী : ৩৩৮৮]
ইফক-এর ঘটনা থেকেও আমরা মুখ ঢাকার প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারি। বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন পথে এক স্থানে বিশ্রামের জন্য শিবির স্থাপন করেন। এই সফরে আয়িশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ছিলেন। তিনি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে শিবির থেকে বাইরে যান। ফিরে এসে দেখেন শিবির গুটিয়ে কাফেলা চলার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এমতাবস্থায় তিনি লক্ষ্য করেন তাঁর গলার হারটি কোথাও হারিয়ে গেছে। যেখানে হারটি পড়ার সম্ভাবনা ছিল তিনি সেখানে গেলেন এবং তালাশ করলেন, কিন্তু পেলেন না। ফিরে এসে দেখলেন কাফেলা চলে গেছে। তিনি সেখানেই বসে পড়েন। এদিকে কাফেলার লোকেরা তাঁর পাল্কিটি উষ্ট্রীর পিঠে রেখে দেন। তারা ধারণা করেন, তিনি পাল্কির মধ্যে বসা থাকলেন। ‘আয়িশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তখন যথেষ্ট শীর্ণকায় ও হালকা-পাতলা ছিলেন। এ কারণে পাল্কিটি যারা উঠিয়ে ছিলেন তারা বুঝতেই পারেন নি তিনি ভেতরে আছেন কি-না। আয়িশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন, আমি সেখানে বসে থাকতে থাকতে ঘুমে আমার চোখ বন্ধ হয়ে যায়। সাফওয়ান ইবন মুওয়াত্তাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ছিলেন কাফেলার পশ্চাৎগামী ব্যক্তি। তিনি দেখেন এক ব্যক্তি শুয়ে আছে। নিকটে এসে দেখে আমাকে চিনতে পারেন। কারণ, হিজাবের পূর্বে তিনি আমাকে দিখেছিলেন। আমাকে শোয়া অবস্থায় দেখতে পেয়ে তিনি জোরে ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পাঠ করেন। সাফওয়ানের শব্দ শুনে আমি উঠে বসি এবং খুব দ্রুত চাদর মুড়ি দিই। আরেকটি বর্ণনায় এসেছে, আমি আমার চাদর দ্বারা আমার মুখমণ্ডল ঢেকে ফেলি। [বুখারী : ৪৪৭৩; মুসলিম : ২৭৭০]
আসমা’ বিনত আবী বাকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন, আমরা পুরুষদের থেকে আমাদের চেহারা আবৃত রাখতাম। [মুস্তাদরাক হাকেম : ১৬৬৪]
ফাতিমা বিনতুল মুনযির রহ. বলেন, ‘আমরা আসমা বিনতে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার সঙ্গে ইহরাম অবস্থায় থাকাকালে আমাদের চেহারা ঢেকে রাখতাম।’ [ইমাম মালেক, মুয়াত্তা : ১/৩২৮; হাকিম, মুসতাদরাক : ১/৪৫৪]
এই বিবরণ থেকে জানা গেল, মুখমণ্ডলের পর্দার বিষয়টি ইজমা’র ভিত্তিতে স্থিরকৃত হয়েছে। কোনো মাযহাবের কোনো একজন উল্লেখযোগ্য ‘আলিম এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন নি। শায়খ ইবনে বায রাহ., শায়খ ইবনে উছাইমীন ও শায়খ ইবনে জিবরীনও একই ফতোয়া দিয়েছেন। [দেখুন : রিসালাতুন ফিল-হিজাবি ওয়াস-সুফূর : ১৯; ফাতাওয়া উলামাইল বালাদিল হারাম : ১১৬৯]
মুফতী মুহাম্মদ শাফী ‘উছমানী রহ. লিখেছেন, ‘ইমাম চতুষ্টয়ের মধ্য থেকে ইমাম মালিক, ইমাম শাফি’ঈ ও ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রহ. তিনজনই মুখমণ্ডল ও হাতের কবজি খোলা রাখার মোটেই অনুমতি দেন নি- তা ফিতনার আশংকা থাকুক বা না থাকুক। ইমাম আবূ হানীফা রহ. ফিতনার আশংকা যদি না থাকে- এই শর্তে খোলা রাখার কথা বলেন। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে এই শর্ত পূরণ হবার নয়, তাই হানাফী ফকীহগণ গায়র মাহরাম পুরুষের সামনে মুখমণ্ডল ও হাতের কবজি খোলা রাখার অনুমতি দেন নি।’ [মা‘আরিফুল কুরআন : ৭/২১৪]
তেমনি এটাও সঙ্গত নয় যে, মহিলাদের সারা শরীর ঢাকা থাকবে আর মুখমণ্ডল থাকবে খোলা। অথচ মানুষের প্রথম দৃষ্টিটিই পড়ে মুখের ওপর। তারপর সেখান থেকেই অন্তরে খারাপ বাসনার সৃষ্টি হয়। পবিত্র কুরআনে নারীদের হিজাব এবং তদসংক্রান্ত প্রায় আটটি আয়াত আছে। সেগুলো থেকেও একথা জানা যায়, শরীয়তের দাবী কেবল শরীর ঢাকা নয়, বরং মুখমণ্ডল ঢাকাও জরুরী।
ওইসব আয়াতের সারকথা হলো, নারীরা অতি প্রয়োজন ছাড়া নিজেদের ঘর থেকে বাইরে বের হবে না। যদি তাদের নিতান্ত প্রয়োজনে বাইরে বের হতে হয় তাহলে বড় ও মোটা চাদর দিয়ে নিজেদের শরীর ঢেকে বের হবে। পুরুষ নারীকে দেখবে না এবং নারীও বিনা প্রয়োজনে পুরুষকে দেখবে না। নারীদের কাছে যদি পুরুষদের কোনো জিনিস চাইতে হয় তাহলে পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। মহিলাদের গায়র মাহরাম (বেগানা) পুরুষের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন হলে পর্দার আড়াল থেকে বলবে, কণ্ঠস্বর কঠোর রাখবে, সুমিষ্ট মোলায়েম স্বরে নয়। সাধারণ অবস্থায় মাহরাম পুরুষের সামনেও মুখমণ্ডল হাত এবং পা ছাড়া নিজেদের দেহের অন্য কোনো অঙ্গ খোলা রাখবে না। [দেখুন, আল-আহযাবের আয়াতসমূহ-৩২, ৫৩, ৮৯; আন-নূর-২৪, ৩০, ৩১, ৫৮, ৬০]
আধুনিককালের প্রখ্যাত আলিম ও ফকীহগণও একই মত পোষণ করেন। পাক-হিন্দের আলিমদের কথা না হয় বাদ দিন। কারণ, তাদের অধিকাংশই হানাফী এবং তাদেরকে ফিকহ সংক্রান্ত মাসআলা ও বিষয়সমূহে কট্টরপন্থি মনে করা হয়। কিন্তু আরব বিশ্বের সমকালীন সকল আলিম ও মুফতীদের মতও এই যে, মহিলাদের জন্য মুখমণ্ডল ঢাকা একান্ত আবশ্যক। তাদের মধ্যে শায়খ আব্দুর রহমান ইবন সাদী, মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহীম আলে আশ-শায়খ, মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানকীতী, শায়খ ‘আবদুল্লাহ ইবনু বায, শায়খ আবু বাকর জাবির আল-জাযায়িরী, শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু গুনায়মীন, শায়খ আবদুল্লাহ ইবনু জুবরীন, শায়খ সালিহ আল-ফাওযান, শায়খ বাকর ইবনু ‘আবদিল্লাহ আবূ যায়েদ, মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ ইসমা’ঈল আল-মাকদাম, আবূ, ইসহাক আল-হুওয়ায়তী, মুসতাফা আল-‘আদাবী, মুহাম্মাদ হাসসান ও আরো অনেকের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
স্পষ্ট ব্যাখ্যা এবং ফকীহগণের চূড়ান্ত ফাতওয়াসমূহ থাকার পরও কোনো ‘আলিম নিকাবকে অস্বীকার করতে পারেন না। যারা মুখ না ঢাকার ব্যাপারটি জোর করে সপ্রমাণ করতে চান তারা খেয়াল করেন না যে, তাদের এহেন মত পশ্চিমা ও তাদের ভাব শিষ্যদের অতি পুলকিত করবে। তারা এই রায়কে ব্যবহার করবে হাতিয়ার হিসেবে।
পরপুরুষের সামনে নারীর মুখমণ্ডল প্রদর্শন বৈধতার পক্ষের প্রবক্তাগণ প্রমাণের জন্য পূর্বোক্ত সূরা নূরের ৩১ নং আয়াত তুলে ধরেন। তাদের বক্তব্য, ‘সাধারণত প্রকাশমান সৌন্দর্য’ এর ব্যাখ্যায় আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস ও আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণনা করা হয় যে, এ দ্বারা করতল ও চেহারা উদ্দেশ্য। অথচ আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ আলাদা। আর আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর উদ্ধৃত উক্তি আলোচ্য দাবীর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। কেননা একাধিক সহীহ সনদে ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, আয়াতের আলোচ্য অংশ ‘ইল্লা মা যাহারা মিনহা’-এর অর্থ ‘কাপড়’। [দেখুন, তাবারী, জামিউল বায়ান : ১৭/২৫৬-২৫৮; ইবন আবী শাইবা, আল-মুসান্নাফ : ৯/২৮০]
এ অংশের ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত কুরআন ব্যাখ্যাতা ইবন কাছীর রহ. বলেন, ‘আয়াতের অর্থ, পরপুরুষের সামনে নারী তার কোনো ধরনের সৌন্দর্য প্রকাশ করবে না। তবে যা আবৃত রাখা সম্ভব নয় তার কথা আলাদা। এর দৃষ্টান্ত দিয়ে ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন,
كَالرِّدَاءِ وَالثِّيَابِ يَعْنِي عَلَى مَا كان يتعاطاه نِسَاءُ الْعَرَبِ مِنَ الْمِقْنَعَةِ الَّتِي تُجَلِّلُ ثِيَابَهَا وَمَا يَبْدُو مِنْ أَسَافِلِ الثِّيَابِ. فَلَا حَرَجَ عليها فيه لأن هذا لا يمكنها إخفاؤه
‘চাদর ও কাপড়।’ অর্থাৎ আরবের নারীগণ যে বড় চাদরে তাদের পরনের কাপড় ঢেকে বের হতেন এবং কাপড়ের নীচের অংশ, যা চলার সময় চাদরের নীচ দিয়ে প্রকাশিত হয়ে যেত তা যেহেতু ঢেকে রাখা সম্ভব নয় তাই এতে কোনো দোষ নেই। [ইবন কাছীর : ৬/৪১]
‘হাসান বসরী, মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন, ইবনুল জাওযী, ইবরাহীম নাখায়ী প্রমুখ মনীষীও অনুরূপ ব্যাখ্যা করেছেন।’ [তাফসীরুল কুরআনিল আযীম : ৩/৩১২]
পবিত্র কুরআনের শব্দ ও বাক্য, আলোচ্য বিষয়ের হাদীস ও আছার এবং উসূলে ফিকহের নীতি ও বিধান ইত্যাদি বিবেচনায় ইবন মাসউদ রারাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর ব্যাখ্যাই অগ্রগণ্য। কারণ সূরা আল-আহযাবের ৫৯ নম্বর আয়াতে জিলবাবের একাংশ চেহারার ওপর নামিয়ে মুখমণ্ডল আবৃত রাখার আদেশ করা হয়েছে। তা সূরা নূরের আলোচ্য আয়াতে ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর ব্যাখ্যাকেই প্রতিষ্ঠিত করে। তাছাড়া সহীহ হাদীসসমূহে নারীদের চেহারা ঢেকে রাখার যে নির্দেশ ও বিবরণ দেখা যায় তা-ও তাঁর ব্যাখ্যাকে সমর্থন করে।
তদুপরি যারা মুখ খোলার পক্ষে বলেছেন প্রথমত তাদের মতটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মত নয় আর দ্বিতীয়ত তাঁরা সবাই এর জন্য নিরাপদ ও ফিতনামুক্ত হওয়ার শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। আর বলাবাহুল্য যে বর্তমান যুগে ফিতনার বিস্তার সর্বত্র। মানুষের মধ্যে দীনদারী ও আল্লাহভীতি হ্রাস পেয়েছে। লজ্জা ও লজ্জাবনত মানুষের সংখ্যা কমে গেছে। ফিতনার প্রতি আহ্বানকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। সাজসজ্জার নানা উপায় ও উপকরণ আবিষ্কৃত হওয়ায় ফিতনার মাত্রা আরও বেড়ে গেছে।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সব মুসলিম বোনকে যথাযথভাবে পর্দা করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
আলী হাসান তৈয়ব
সম্পাদনা : ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
No comments:
Post a Comment