যাদের ইমামতি বৈধ ও শুদ্ধ
এমন
কতক লোক আছে যাদেরকে আপাত:দৃষ্টিতে ইমামতির অযোগ্য মনে হলেও
প্রকৃতদৃষ্টিতে তাদের ইমামতি বৈধ ও শুদ্ধ। অবশ্য শুরুতে একটা গুরুত্বপূর্ণ
নীতি মনে রাখলে এ প্রসঙ্গে অনেক ভুল বুঝাবুঝি দূর হয়ে যাবে। যে ব্যক্তির
নামায শুদ্ধ, তার ইমামতিও শুদ্ধ এবং তার পিছনে মুক্তাদীর নামাযও শুদ্ধ। আর
যার নামায শুদ্ধ নয়, তার ইমামতিও শুদ্ধ নয় এবং তার পিছনে মুক্তাদীর নামাযও
শুদ্ধ নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ২/৩১৬-৩১৭)
যারা ইমাম হওয়ার যোগ্য নয় বলে ধারণা হতে পারে অথচ (ইমামতির গুণাবলী বর্তমান থাকলে) তারা আসলে তার যোগ্য এমন কিছু লোক নিম্নরুপ :-
১ । অন্ধ :
অন্ধ মানুষের পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার
ব্যাপারে সন্দেহ্ থাকলেও সব অন্ধ সমান নয়। সুতরাং যোগ্যতা থাকলে সে ইমাম
হতে পারে। আল্লাহর রসূল (সাঃ) অন্ধ সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন উম্মে মাকতূমকে
দু-দু বার মদ্বীনার ইমাম বানিয়েছিলেন এবং তিনি লোকেদের নামাযের ইমামতি
করেছেন। (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ১১২১নং)
২। ক্রীতদাস :
ক্রীতদাস, যুদ্ধবন্দী দাস, মুক্তদাস,
সাধারণ দাস, ভৃত্য, চাকর, বা রাখাল যোগ্য হলে তার ইমামতি শুদ্ধ এবং এমন
আতরাফদের পশ্চাতে আশরাফদেরও নামায শুদ্ধ। মহানবী (সাঃ) যখন মদ্বীনায় প্রথম
প্রথম হিজরত করে এলেন, তখন মুহাজেরীনরা কুবার নিকটবর্তী উসবাহ্ নামক এক
জায়গায় অবস্থান শুরু করলেন। সেখানে আবূ হুযাইফা (রাঃ)-এর মুক্ত করা দাস
সালেম (রাঃ) লোকেদের ইমামতি করতেন। তাঁর সবার চাইতে বেশী কুরআন মুখস্থ ছিল।
অথচ তাঁর পশ্চাতে মুক্তাদীদের মধ্যে হযরত উমার এবং আবূ সালামাও ছিলেন। (বুখারী, ৬৯২, আবূদাঊদ, সুনান ৫৮৮নং, মিশকাত ১১২৭নং)
তদনুরুপ হযরত আয়েশা (রাঃ) এর মুক্ত করা
দাস আবূ আম্র নামাযের ইমামতি করতেন। (মুসনাদ ইমাম শাফেয়ী) তাঁর যাকওয়ান
নামক আর এক মুক্ত করা দাসও ইমামতি করতেন। (মালেক, মুঅত্তা, ইবনে আবী শাইবা ৭২১৫, ৭২১৬, ৭২১৭ নং)
৩। মুসাফির :
মুসাফিরের জন্য সফরে নামায জমা ও কসর করা
সুন্নত হলেও এবং সে ইমামতি করার সময় নামায কসর করে পড়লেও তার পিছনে
গৃহ্বাসীদের নামায শুদ্ধ। অবশ্য এ ক্ষেত্রে গৃহ্বাসীরা ঐ মুসাফির ইমামের
সালাম ফিরার পর উঠে বাকী নামায পূরণ করে নেবে। অর্থাৎ, ইমাম ও মুক্তাদী
মিলে ২ রাকআত হয়ে গেলে মুক্তাদীরা ইমামের সালাম ফিরার পর উঠে একা একা আরো
বাকী ২ রাকআত পড়ে নেবে। আর সে নামায জমা করে পড়লে স্থানীয় বাসিন্দারা তা
করবে না।
৪। দাঁড়াতে অক্ষম ব্যক্তি :
দাঁড়াতে অক্ষম ব্যক্তির ইমামতি শুদ্ধ। তবে
মুক্তাদীরাও (দাঁড়ানোর সময়) বসে নামায পড়বে। মহানবী (সাঃ) বলেন, “ইমাম এ
জন্যই বানানো হয়েছে যে, তার অনুসরণ করা হবে। সুতরাং --- সে যখন দাঁড়িয়ে
নামায পড়বে, তখন তোমরাও দাঁড়িয়ে নামায পড় এবং যখন বসে নামায পড়বে তখন
তোমরাও বসে নামায পড়। আর সে বসে থাকলে তোমরা দাঁড়াও না; যেমন পারস্যর
লোকেরা তাদের সম্মানার্হ ব্যক্তিদের জন্য করে থাকে।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, জামে ২৩৫৬নং)
কিন্তু পরবর্তীতে তিনি বসে নামায পড়লে
তাঁর পশ্চাতে সাহাবীগণ দাঁড়িয়েই নামায পড়েছেন। এর ফলে উলামাগণ বলেন যে,
ইমাম সাময়িক অসুবিধার কারণে বসে নামায পড়লে মুক্তাদীরাও বসে নামায পড়বে।
নচেৎ, শেষ জীবনে বাধ্যক্যজনিত কারণে বসে নামায পড়লে মুক্তাদীরা (দাঁড়ানোর
সময়) দাঁড়িয়েই নামায পড়বে।
বলা বাহুল্য, তাঁর পূর্বেকার আমল মনসূখ
নয়। কারণ, তাঁর আমল দ্বারা তাঁর আদেশ মনসূখ হয় না। তাছাড়া তাঁর পরবর্তীতে
সাহাবাগণও ইমাম বসে নামায পড়লে বসেই নামায পড়েছেন। অবশ্য ঐ ক্ষেত্রে বসে
নামায পড়া ওয়াজেব না বলে মুস্তাহাব বলা যেতে পারে। (মিশকাত ১১৩৯নং, ১/৩৫৭ আলবানীর টীকা সহ্ দ্র:)
৫। তায়াম্মুমকারী :
যে ব্যক্তি ওযূ করতে না পেরে তায়াম্মুম করে নামায পড়ে তার ইমামতি এবং তার পশ্চাতে যারা ওযূ করে নামায পড়ে তাদের নামায শুদ্ধ।
হযরত আম্র বিন আস (রাঃ) বলেন, যাতুস
সালাসিল যুদ্ধ-সফরে এক শীতের রাতে আমার স্বপ্নদোষ হল। আমার ভয় হল যে, যদি
গোসল করি তাহলে আমি ধ্বংস হয়ে যাব। তাই আমি তায়াম্মুম করে সঙ্গীদেরকে নিয়ে
(ইমাম হয়ে) ফজরের নামায পড়লাম। আমার সঙ্গীরা একথা নবী (সাঃ)-র নিকটে উল্লেখ
করলে তিনি বললেন, “হে আম্র! তুমি নাপাক অবস্থায় তোমার সঙ্গীদের ইমামতি
করেছ?” আমি গোসল না করার কারণ তাঁকে বললাম। আরো বললাম যে, আল্লাহ তাআলার এ
বাণীও আমি শুনেছি, তিনি বলেন, “তোমরা আত্মহ্ত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ
তোমাদের প্রতি বড় দয়াশীল।” (কুরআন মাজীদ ৪/২৯)
একথা শুনে তিনি হাসলেন এবং আর কিছুই বললেন না। (বুখারী, সহীহ আবূদাঊদ, সুনান ৩২৩নং, আহমাদ, মুসনাদ,হাকেম, মুস্তাদরাক, দারাক্বুত্বনী, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ)
৬। কেবল মহিলাদের জন্য মহিলা :
মহিলা মহিলা নামাযীদের ইমামতি করতে পারে।
উম্মে অরাকাহ্ বিন নাওফাল (রাঃ) মহানবী (সাঃ)-এর নির্দেশমতে তাঁর পরিবারের
মহিলাদের ইমামতি করতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৫৯১-৫৯২নং)
অবশ্য এ ক্ষেত্রে মহিলা ইমাম মহিলাদের কাতার ছেড়ে পুরুষের মত সামনে একাকিনী দাঁড়াবে না। বরং কাতারের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে ইমামতি করবে। (আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ, মুহাল্লা ৩/১৭১-১৭৩) আশেপাশে বেগানা পুরুষ না থাকলে সশব্দে তকবীর ও কিরাআত পড়বে। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ৩০/১১৩)
৭। কেবল মহিলাদের জন্য পুরুষ :
কোন পুরুষ কেবল মহিলা জামাআতের ইমামতি
করতে পারে। তবে শর্ত হল, মহিলা যেন এগানা হয়, নচেৎ বেগানা হলে যেন একা না
হয়, পরিপূর্ণ পর্দার সাথে একাধিক থাকে এবং কোন প্রকার ফিতনার ভয় না থাকে
অথবা তার সঙ্গে যেন কোন এগানা মহিলা বা অন্য পুরুষ থাকে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৫২)
একদা ক্বারী সাহাবী হযরত উবাই বিন কা’ব
(রাঃ) আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর কাছে আরজ করলেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! গতরাত্রে
আমি একটি (অস্বাভাবিক) কাজ করেছি।’ তিনি বললেন, “সেটা কি?” উবাই বললেন,
‘কিছু মহিলা আমার ঘরে জমা হয়ে বলল, আপনি (ভালো ও বেশী) কুরআন পড়তে পারেন,
আমরা পারি না। অতএব আপনি আজ আমাদের ইমামতি করেন। তাদের এই অনুরোধে আমি
তাদেরকে নিয়ে ৮ রাকআত এবং বিতর পড়েছি।’ এ কথা শুনে মহানবী (সাঃ) চুপ
থাকলেন। অর্থাৎ তাঁর এই নীরব থাকা এ ব্যাপারে তাঁর মৌনসম্মতি হয়ে গেল। (ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, আবূ য়্যা’লা)
৮। নাবালক কিশোর :
জ্ঞানসম্পন্ন নাবালক কিশোরের জন্য যদিও নামায ফরয নয়, তবুও বড়দের জন্য ফরয-নফল সব নামাযেই তার ইমামতি শুদ্ধ।
আম্র বিন সালামাহ্ ৬-৭ বছর বয়সে লোকেদের ইমামতি করেছেন। আর তিনি ছিলেন সকলের মধ্যে বেশী কুরআনের হাফেয। (বুখারী ৪৩০২, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ৫৮৫নং)
৯। জারজ :
ব্যভিচারজাত সন্তানের কোন দোষ নেই। তার
মা-বাপের দোষ তার ঘাড়ে আসতে পারে না। সুতরাং অন্যান্য দিকে যোগ্যতা থাকলে
তার ইমামতি এবং তার পশ্চাতে নামায শুদ্ধ। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৯/১৪৭-১৪৮)
১০। যে নফল বা ভিন্ন ফরয নামায পড়ছে :
যে নফল নামায পড়ছে তার পিছনে ফরয নামায
শুদ্ধ; যেমন তারাবীহ্র জামাআতে এশার নামায, অথবা আসরের জামাআতে যোহরের
কাযা নামায অথবা কাযা নামায আদায়কারীর পিছনে ফরয নামায আদায় করা শুদ্ধ। এ
ক্ষেত্রে ইমাম ও মুক্তাদীর নিয়ত ভিন্ন হলেও তা কোন দোষের নয়। যেহেতু জরুরী
হল বাহ্যিক কর্মাবলীতে ইমামের অনুসরণ করা।
হযরত মুআয বিন জাবাল মহানবী (সাঃ)-এর সাথে
এশার নামায পড়তেন। অতঃপর ফিরে গিয়ে নিজের গোত্রের লোকেদের ঐ নামাযই
পড়াতেন। এক বর্ণনায় আছে যে, এ নামায তাঁর নফল হত এবং লোকেদের হত ফরয। (বুখারী, মুসলিম, শাফেয়ী, দারাক্বুত্বনী, সুনান, বায়হাকী ৩/৮৬, মিশকাত ১১৫০-১১৫১নং)
১১। সম্মানিত থাকতে অপেক্ষাকৃত কম সম্মানিত লোকের ইমামতি
সম্মানিত থাকতে অপেক্ষাকৃত কম সম্মানিত ব্যক্তির ইমামতি বৈধ। একদা আব্দুর রহ্মান বিন আওফের পশ্চাতে মহানবী (সাঃ) নামায পড়েছেন। (মুসলিম, সহীহ ২৭৪নং)
No comments:
Post a Comment