বার বার গুনাহ্’র ইচ্ছা পোষণ
১১. গুনাহ্গারের অন্তর বার বার গুনাহ্’র ইচ্ছা পোষণ করতে করতে আর ভালোর ইচ্ছা পোষণ করতে পারে না। এমনকি তখন তার মধ্যে গুনাহ্ থেকে তাওবা করার ইচ্ছাও একেবারেই ক্ষীণ হয়ে যায়। বরং ধীরে ধীরে উক্ত ইচ্ছা একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে পড়ে। তখন দেখা যায়, এক জন ব্যক্তি অর্ধাঙ্গ রোগী অথচ সে এখনো আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট তাওবা করছে না। আর কখনো সে মুখে তাওবা ইস্তিগ্ফার করলেও তা মিথ্যুকের তাওবা বলেই বিবেচিত। কারণ, তার অন্তর তখনো গুনাহ্লোভী। সে সুযোগ পেলেই গুনাহ্ করবে বলে আশা পোষণ করে থাকে।
গুনাহ্কে গুনাহ্ মনে না করা
১২. গুনাহ্ করতে করতে গুনাহ্কে গুনাহ্ মনে করার চেতনাটুকুও গুনাহ্গারের অন্তর থেকে সম্পূর্ণরূপে লোপ পায়। তখন গুনাহ্ করাই তার অভ্যাসে পরিণত হয়। তাকে কেউ গুনাহ্ করতে দেখলে অথবা কেউ এ ব্যাপারে তার সম্পর্কে কথা বললে সে এতটুকুও লজ্জা পায় না। বরং
অন্যকে দেখিয়ে করতে পারলে সে তাতে বেশি মজা পায়। গুনাহ্ করতে পেরেছে বলে সে অন্যের কাছে গর্ব করে এবং যে তার গুনাহ্ সম্পর্কে অবগত নয় তাকেও সে তা জানিয়ে দেয়। সাধারণত এ জাতীয় মানুষের তাওবা নসীব হয় না এবং তাকে ক্ষমাও করা হয় না।
অন্যকে দেখিয়ে করতে পারলে সে তাতে বেশি মজা পায়। গুনাহ্ করতে পেরেছে বলে সে অন্যের কাছে গর্ব করে এবং যে তার গুনাহ্ সম্পর্কে অবগত নয় তাকেও সে তা জানিয়ে দেয়। সাধারণত এ জাতীয় মানুষের তাওবা নসীব হয় না এবং তাকে ক্ষমাও করা হয় না।
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
كُلُّ أُمَّتِيْ مُعَافىً إِلاَّ الْـمُجَاهِرِيْنَ، وَإِنَّ مِنَ الْـمُجَاهَرَةِ أَنْ يَّعْمَلَ الرَّجُـلُ بِاللَّيْلِ عَمَلًا، ثُمَّ يُصْبِحُ وَقَدْ سَتَرَهُ اللهُ، فَيَقُوْلُ: يَا فُلَانٌ! عَمِلْتُ الْبَارِحَةَ كَذَا وَكَذَا، وَقَدْ بَاتَ يَسْتُرُهُ رَبُّهُ، وَيُصْبِحُ يَكْشِفُ سِتْرَ اللهِ عَنْهُ.
‘‘প্রকাশ্য গুনাহ্গার ছাড়া সকল উম্মতই ক্ষমা পাওয়ার উপযুক্ত। আর প্রকাশ্য গুনাহ্’র অন্তর্ভুক্ত এটিও যে, জনৈক ব্যক্তি গভীর রাত্রে কোন একটি গুনাহ্’র কাজ করলো। ভোর হয়েছে অথচ আল্লাহ্ তা‘আলা এখনো তার গুনাহ্টিকে লুকিয়ে রেখেছেন। কিন্তু সে নিজেই জনসম্মুখে তার গুনাহ্টি ফাঁস করে দিয়েছে। সে বলছে, হে অমুক! শুনো, আমি গত রাত্রিতে এমন এমন করেছি। অথচ তার প্রভু তার গুনাহ্টিকে রাত্রি বেলায় লুকিয়ে রেখেছেন। আর সে ভোর হতেই আল্লাহ্ তা‘আলার গোপন রাখা বিষয়টিকে ফাঁস করে দিলো’’। (বুখারী ৬০৬৯; মুসলিম ২৯৯০)
গুনাহ্গার ব্যক্তি গুনাহ্’র মাধ্যমে পূর্বের কোন এক অভিশপ্ত তথা ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির যোগ্য
১৩. গুনাহ্গার ব্যক্তি গুনাহ্’র মাধ্যমে পূর্বের কোন এক অভিশপ্ত তথা ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির যোগ্য (?) ওয়ারিশ হিসেবে গণ্য হয়। যেমন:
সমকামী ব্যক্তি লুত্ব সম্প্রদায়ের ওয়ারিশ।
মাপে কম দেয় যে সে শু‘আইব সম্প্রদায়ের ওয়ারিশ।
ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টিকারী ফির‘আউন সম্প্রদায়ের ওয়ারিশ।
দাম্ভিক ও আত্মম্ভরি হূদ সম্প্রদায়ের ওয়ারিশ।
সুতরাং গুনাহ্গার যে গুনাহ্ই করুক না কেন তার সাথে পূর্বের কোন এক জাতির সাথে সে বিষয়ে মিল রয়েছে। তবে উক্ত মিল কিন্তু প্রশংসনীয় নয়। কারণ, তারা ছিলো আল্লাহ্ তা‘আলার একান্ত অবাধ্য এবং তাঁর কঠিন শত্রু।
‘আব্দুল্লাহ্ বিন্ ’উমর (রাযিয়াল্লাহু আন্হুমা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ.
‘‘যে ব্যক্তি (মুসলিম ছাড়া) অন্য কোন জাতির সঙ্গে কোন বিষয়ে মিল রাখলো সে তাদের মধ্যেই পরিগণিত হবে’’।
(আহমাদ ২/৫০, ৯২; আবূ দাউদ ৪০৩১)
গুনাহ্গার ব্যক্তি আল্লাহ্ তা‘আলার দৃষ্টিতে একেবারেই গুরুত্বহীন
১৪. গুনাহ্গার ব্যক্তি আল্লাহ্ তা‘আলার দৃষ্টিতে একেবারেই গুরুত্বহীন। হাসান বসরী (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন: তারা (গুনাহ্গাররা) আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট গুরুত্বহীন বলেই তো তাঁর অবাধ্য হতে পারলো। আল্লাহ্ তা‘আলা যদি তাদেরকে গুরুত্বই দিতেন তাহলে তাদেরকে গুনাহ্ থেকে অবশ্যই রক্ষা করতেন।
আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট কারোর সম্মান না থাকলে মানুষের নিকটও তার কোন সম্মান থাকে না। যদিও তারা বাহ্যিকভাবে তাকে কোন প্রয়োজনে বা তার অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য সম্মান করে থাকে।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«وَمَنْ يُّهِنِ اللهُ فَمَا لَهُ مِنْ مُّكْرِمٍ».
‘‘আল্লাহ্ তা‘আলা যাকে অসম্মান করেন তাকে সম্মান দেয়ার আর কেউ নেই’’। (হাজ্জ : ১৮)
বড় গুনাহ্ও ছোট মনে হয়
১৫. গুনাহ্ করতে করতে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়ায় যে, তার নিকট বড় গুনাহ্ও ছোট মনে হয়। এটিই ধ্বংসের মূল। কারণ, বান্দাহ্ গুনাহ্কে যতই ছোট মনে করবে আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট তা ততই বড় হিসেবে পরিগণিত হবে।
আব্দুল্লাহ্ বিন্ মাস্ঊদ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নিশ্চয়ই মু’মিন গুনাহ্কে এমন মনে করে যে, যেন সে পাহাড়ের নিচে। ভয় পাচ্ছে পাহাড়টি কখন যে তার মাথার উপর ভেঙ্গে পড়ে। আর ফাসিক (আল্লাহ্’র অবাধ্য) গুনাহ্কে এমন মনে করে যে, যেমন কোন একটি মাছি তার নাকে বসলো আর সে হাত দিয়ে মাছিটিকে তাড়িয়ে দিলে তা উড়ে গেলো।
গুনাহ্গারই নয় বরং অন্য পশু এবং মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়
১৬. গুনাহ্’র কারণে শুধু গুনাহ্গারই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না বরং তাতে অন্য পশু এবং অন্য মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নিশ্চয়ই পাখি তার বাসায় মরে যায় শুধুমাত্র যালিমের যুলুমের কারণেই।
মুজাহিদ (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন: যখন এলাকায় দুর্ভিক্ষ বা অনাবৃষ্টি দেখা দেয় তখন পশুরা গুনাহ্গারদের প্রতি লা’নত করে এবং বলে: এটি আদম সন্তানের গুনাহ্’রই অপকার।
অসম্মান ও লাঞ্ছনার কারণ
১৭. গুনাহ্ গুনাহ্গার ব্যক্তির অসম্মান ও লাঞ্ছনার কারণ হয়। সম্মান তো একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার আনুগত্যের মধ্যেই নিহিত।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«مَنْ كَانَ يُرِيْدُ الْعِزَّةَ فَلِلهِ الْعِزَّةُ جَمِيْعًا».
‘‘কেউ সম্মান চাইলে তার জানা উচিৎ যে, সকল সম্মান আল্লাহ্’র জন্যই তথা তাঁরই আনুগত্যে নিহিত’’। (ফাত্বির : ১০)
’হাসান বসরী (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন: গুনাহ্গাররা যদিও উন্নত মানের ঘোড়া ও খচ্ছরে সাওয়ার হয় তবুও গুনাহ্’র লাঞ্ছনা তাদের অন্তর থেকে কখনো পৃথক হয় না। আল্লাহ্ তা‘আলা যে কোনভাবে গুনাহ্গারকে লাঞ্ছিত করবেনই।
গুনাহ্গারের মেধা নষ্ট করে দেয়
১৮. গুনাহ্ গুনাহ্গারের মেধা নষ্ট করে দেয়। কারণ, মেধার এক ধরনের আলো রয়েছে। আর গুনাহ্ উক্ত আলোকে একেবারেই নষ্ট করে দেয়।
জনৈক বুযুর্গ বলেন: মানুষের মেধা নষ্ট হলেই তো সে গুনাহ্ করতে পারে। কারণ, তার মেধা সচল থাকলে সে কিভাবে এমন সত্তার অবাধ্য হতে পারে যার হাতে তার জীবন ও মরণ এবং যিনি তাকে সর্বদা দেখছেন। ফিরিশ্তারাও তাকে দেখছেন। কুর‘আন, ঈমান, মৃত্যু ও জাহান্নাম তাকে গুনাহ্ করা থেকে নিষেধ করছে। গুনাহ্’র কারণে তার দুনিয়া ও আখিরাতের সকল কল্যাণ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ সবের পরও গুনাহ্ করা কি একজন সচল মেধাবী লোকের কাজ হতে পারে?!
গুনাহ্গারের অন্তরের উপর ভ্রষ্টাচারের সিল-মোহর পড়ে যায়
১৯. গুনাহ্ করতে করতে গুনাহ্গারের অন্তরের উপর ভ্রষ্টাচারের সিল-মোহর পড়ে যায়। তখন সে আল্লাহ্ তা‘আলার স্মরণ থেকে সম্পূর্ণরূপে গাফিল হয়ে যায়। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«كَلاَّ بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوْبِهِمْ مَّا كَانُوْا يَكْسِبُوْنَ».
‘‘না, তাদের কথা সত্য নয়। বরং তাদের কৃতকর্মই তাদের মনের উপর মরিচারূপে জমে গেছে’’। (মুত্বাফ্ফিফীন : ১৪)
কোন কোন ব্যাখ্যাকার বলেছেন: উক্ত মরিচা গুনাহ্’র মরিচা। কারণ, গুনাহ্ করলে অন্তরে এক ধরনের মরিচা ধরে। আর উক্ত মরিচা বাড়লেই উহাকে ‘‘রান’’ বলা হয়। আরো বাড়লে উহাকে ‘‘ত্বাব্’’’ বা ‘‘খাত্ম’’ তথা সীল-মোহর বলা হয়। তখন অন্তর এমন হয়ে যায় যেন তা পর্দা দিয়ে বেষ্টিত।
লেখক/সংকলকঃ মোস্তাফিজুর রহমান বিন আব্দুল আজিজ আল-মাদানী
লেখক/সংকলকঃ মোস্তাফিজুর রহমান বিন আব্দুল আজিজ আল-মাদানী
No comments:
Post a Comment