ব্যাংকের ধ্বংসকারিতা
ব্যাংকের
আলোচনা প্রসঙ্গে মওলানা মওদূদী (রঃ) লিখেছেন, ‘‘এভাবে পুঁজিপতিদের সংগঠন
কায়েম হওয়ার পর প্রথম যুগের একক ও বিক্ষিপ্ত মহাজনদের তুলনায় বর্তমানের
একত্রীভূত ও সংগঠিত পুঁজিপতিদের মর্যাদা, প্রভাব ও অবস্থা কয়েকগুণ বেড়ে
গেছে এবং এর ফলে সারা দেশের ধন-সম্পদ তাদের নিকট কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে।
আজকের দিনে এক একটি ব্যাংকে শত শত কোটি টাকা জমা হয়। মুষ্টিমেয় কয়েকজন
প্রভাবশালী পুঁজিপতি এগুলো নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। এ পদ্ধতিতে তারা কেবল
নিজের দেশের নয় বরং সারা দুনিয়ার অর্থনৈতিক, তমদ্দুনিক ও রাজনৈতিক জীবনের
উপর চরম স্বার্থান্ধতা সহকারে কর্তৃত্ব করতে থাকে।
এদের শক্তিমত্তা আন্দাজ করার জন্য কেবল
এতটুকুই বলা যথেষ্ট যে,
১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভাগের পূর্বে ভারতের বড় বড়
ব্যাংকগুলোর অংশীদারদের সংগৃহীত পুঁজির পরিমাণ ছিল মাত্র ১৭ কোটি টাকা,
কিন্তু আমানতকারীদের গচ্ছিত পুঁজির পরিমাণ ৬১২ কোটি টাকায় পৌঁছে গিয়ে ছিল। এ
ব্যাংকগুলোর সমগ্র শাসন ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছিল বড়জোর দেড়-দু’শ
পুঁজিপতির হাতে। কিন্তু একমাত্র সূদের লোভে দেশের লাখো লাখো লোক এ বিপুল
পরিমাণ অর্থ তাদের হাতে তুলে দিয়েছিল এবং এ শক্তিশালী অস্ত্র তারা কখন
কোথায় কিভাবে ব্যবহার করে, সে ব্যাপারে কারোর কোনো চিন্তাই ছিল না। যে কোন
ব্যক্তি অনুমান করতে পারে, যে সব পুঁজিপতির হাতে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা
হয়ে গেছে তারা দেশের শিল্প, ব্যবসায়, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতি-সভ্যতার
উপর কত ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। এ প্রভাব দেশ ও দেশবাশীর স্বার্থে
কাজ করছে, না এ সব স্বার্থান্ধ পুঁজিপতিদের নিজেদের স্বার্থোদ্ধারে ব্যয়িত
হচ্ছে তাও সহজেই অনুমান করা যায়।
এ পর্যন্ত এমন এক দেশের অবস্থা বর্ণনা
করলাম যেখানে পুঁজিপতিদের সংগঠন এখনো সম্পূর্ণ প্রাথমিক পর্যায়ে অবস্থান
করছে এবং ব্যাংকগুলোর মোট আমানত সমস্ত জনসংখার মাথাপিছু মাত্র ৭ টাকা করে
পড়ে। এখন এই প্রেক্ষিতে অন্যান্য দেশের কথা চিন্তা করুন, যেখানে এ হার
মাথাপিছু হাজার দু’হাজার টাকা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। চিন্তা করুন সেখানে
পুঁজি কেন্দ্রীয়করণের কি অবস্থা। ১৯৩৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী কেবলমাত্র
ব্যবসায়িক ব্যাংকগুলোর আমানতের হার আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপিছু ১৩১৭
পাউন্ড, ইংল্যান্ডে ১৬৬৪ পাউন্ড, সুইজারল্যান্ডে ২৭৫ পাউন্ড, জার্মানীতে
২১২ পাউন্ড ও ফ্রান্সে ১৬৫ পাউন্ড ছিল। এ দেশগুলোর অধিবাসীরা এত ব্যাপক
হারে ও বিপুল পরিমাণে নিজেদের অতিরিক্ত আয় ও সঞ্চিত পুঁজি তাদের
পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিয়েছিল। প্রতিটি গৃহ থেকে সংগৃহীত এ বিপুল পরিমাণ
অর্থ মাত্র মুষ্টিমেয় কয়েকটি হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছিল। যাদের নিকট এগুলো
কেন্দ্রীভূত হচ্ছে তাদেরকে কারোর নিকট জবাবদিহি করতে হয় না, নিজেদের
প্রবৃত্তি ছাড়া অন্য কারোর নির্দেশও তারা গ্রহণ করে না এবং নিজেদের স্বার্থ
ছাড়া অন্য কোন দিকে তাদের দৃষ্টিও নেই। তারা কেবলমাত্র সামান্য সূদের
আকারে এ বিরাট-বিশাল ধনাগারে ‘ভাড়া’ আদায় করে যাচ্ছে এবং বাস্তবে তারাই এর
মালিকে পরিণত হচ্ছে। অতঃপর এ শক্তির জোরে তারা বিভিন্ন দেশের ও জাতির ভাগ্য
নিয়ে খেলা করে; তারা ইচ্ছামত যে কোন দেশে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে, তারা
ইচ্ছামত দু’ দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধায়, আবার ইচ্ছামত যে কোন সময় সন্ধি
স্থাপন করায়। নিজেদের অর্থ-লিপ্সার দৃষ্টিতে যে জিনিসটিকে তারা বাঞ্ছনীয়
মনে করে তার প্রচলন বাড়ায় ও বিকাশ সাধন করে, আবার যেটিকে অবাঞ্ছনীয় মনে করে
তার বিকাশ লাভের সমস্ত পথই বন্ধ করে দেয়। তাদের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা কেবল
বাজারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, সাহিত্য ও জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র, বৈজ্ঞানিক
গবেষণাগার, সাংবাদিক প্রতিষ্ঠান, ধর্মচর্চা কেন্দ্র ও রাষ্ট্রীয়
পার্লামেন্ট--সর্বত্রই তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত। কারণ দেশের ও জাতির
সমুদয় অর্থ তাদের ‘পায়ের ভৃত্যে’ পরিণত হয়েছে।
এ মহা বিপর্যয়ের ধ্বংসলীলা দেখে
পাশ্চাত্য চিন্তাবিদগণই শিউরে উঠেছেন। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ থেকে উচ্চ
কলরোল ধ্বনি উত্থিত হচ্ছে; একটি অতি ক্ষুদ্র দায়িত্বহীন স্বার্থান্ধ
শ্রেণীর হাতে ধনের এ বিপুল শক্তি কেন্দ্রীভূত হওয়া সমগ্র সমাজ ও জাতীয়
জীবনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কিন্তু আমাদের দেশে এখনো বলা হচ্ছে, সূদের
কারবার তো ছিল পুরনো আমলের আড়তদার মহাজনদের অপবিত্র ও হারাম কারবার। আজকের
যুগের উন্নত রুচিশীল ও সুসভ্য ব্যাংকারগণ অত্যন্ত পূত-পবিত্র কারবার করছেন।
তাদের ব্যবসায়ে অর্থ খাটানো এবং তা থেকে নিজের অংশ নেয়া হারাম হবে কেন?
অথচ পুরনো মহাজন ও আজকের এ ব্যাংকারদের মধ্যে যদি সত্যিই কোনো পার্থক্য
সূচিত হয়ে থাকে, তাহলে তা কেবল এতটুকু যে, তারা একা একা ডাকাতি করতো আর এরা
দলবল জুটিয়ে, ডাকাতদের বড় বড় দল গঠন করে, দলবদ্ধভাবে ডাকাতি করছে। এদের
মধ্যে দ্বিতীয় পার্থক্যটি হচ্ছে পুরনো ডাকাতদের প্রত্যেকেই দরজা ও দেওয়াল
ভাঙার যন্ত্রপাতি এবং মানুষ মারার অস্ত্রশস্ত্র নিজেরাই আনতো, কিন্তু আজ
সমগ্র দেশবাসী নিজেদের নির্বুদ্ধিতা, মূর্খতা ও আইনের শৈথিল্যের কারণে
অসংখ্য যন্ত্র ও অস্ত্র তৈরী করে ‘সামান্য ভাড়ায়’ সংঘবদ্ধ ডাকাতদের হাতে
তুলে দিচ্ছে। দিনের বেলায় তারা জনগণকে ‘ভাড়া’ আদায় করে আর রাতের আঁধারে এ
জনগণের উপর তাদের প্রদত্ত যন্ত্র ও অস্ত্রের সাহায্যে ডাকাতি করে।
এহেন ‘ভাড়া’কে হালাল ও পবিত্র গণ্য করার জন্য আমাকে বলা হচ্ছে।’’[1]
No comments:
Post a Comment