Saturday, February 3, 2018

খাদ্য ও পানীয় বিষয়ে ইসলামের বিধি-বিধান

খাদ্য ও পানীয় বিষয়ে ইসলামের বিধি-বিধান
পানাহারের বিধান
যেসব খাদ্য ও পানীয় পবিত্র-উপকারী তা হালাল আর যা নাপাক ও ক্ষতিকর তা হারাম। মূলত উপকারী খাদ্যদ্রব্য ও পানীয়ের ব্যাপারে বিধান হচ্ছে তা হালাল ও বৈধ। হ্যাঁ, যে সব খাদ্য ও পানীয়ের ব্যাপারে আল্লাহ কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, অথবা যার মধ্যে নিশ্চিত ও স্পষ্ট ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে, তা হারাম ও নিষিদ্ধ। যেমন :
• যেসব খাদ্য, পানীয় বা পোশাক-আশাকের মধ্যে আত্মা বা শরীরের উপকারীতা রয়েছে, আল্লাহ তা হালাল করে দিয়েছেন। যাতে বান্দা এর দ্বারা শক্তি সঞ্চয় করে তার এবাদতে ব্রতী হতে সক্ষম হয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘হে মানুষ, যমীনে যা রয়েছে, তা থেকে হালাল পবিত্র বস্তু আহার কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের জন্য সুস্পষ্ট শত্রু।’ (সূরা বাকারা : ১৬৮)
• যেসব বস্তুর মধ্যে ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে অথবা যার মধ্যে ক্ষতির চেয়ে উপকারের বিষয়টি খুবই গৌণ, আল্লাহ তা হারাম করে দিয়েছেন।
মুদ্দাকথা : আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক বস্তু থেকে পবিত্র জিনিসগুলো হালাল করে দিয়েছেন আর অপবিত্র জিসিনগুলো করেছেন হারাম। যেমন আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে বলেন,
‘ সে তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করে আর অপবিত্র বস্তু হারাম করে।’ (সূরা আরাফ : ১৫৭)
খাদ্যের প্রভাব :
মানুষ জীবিকা নির্বাহের জন্য খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল, আর এ খাদ্যের প্রভাবই তার স্বভাব ও চরিত্রের ওপর বিশেষভাবে ক্রিয়াশীল হয়। পবিত্র খাদ্য আহার করলে মানুষের ওপর ভাল প্রভাব পড়ে আর অপবিত্র খাদ্য আহার করলে মানুষের ওপর তার বিরূপ প্রভাব পড়ে। এ জন্যই আল্লাহ তাআলা মানব জাতিকে পবিত্র খাদ্য গ্রহণ করার নিদের্শ দিয়েছেন, বারণ করেছেন অপবিত্র খাদ্য থেকে।
খাদ্য ও পানীয়ের স্বভাব :
মূলত খাদ্য ও পানীয় পবিত্র ও হালাল, যদি তাতে কোন ক্ষতিকর উপাদান না থাকে। যেমন, গোশত, শষ্য, ফল, মধু, দুধ, খেজুর ও এ জাতীয় অন্যান্য হালাল খাদ্য।
নাপাক খাদ্য ও পানীয় হারাম। যেমন, মৃত জানোয়ার, প্রবাহিত রক্ত এবং সেসব বস্তু যার মধ্যে কোন উপকার নেই, যেমন বিষ, মদ, খড়কুটা, মাদকদ্রব্য, তামাক ইত্যাদি। কারণ, এগুলো অপবিত্র, এতে রয়েছে শরীরের ক্ষতি, সম্পদের অপচয় ও বিবেকের বিলুপ্তি।
কেউ কিছু খেতে বললে করণীয় :
১. কোন মুসলমান কিছু খেতে বললে বা কারো বাড়িতে মেহমান হলে, মেজবান যা পরিবেশন করে তা খেয়ে নেয়াই হচ্ছে সুন্নত, তদ্রূপ কোন পানীয় পেশ করলে তা পান করে নেয়াই হচ্ছে সুন্নত, এ ব্যাপারে তাকে কোন প্রশ্ন না করা।
২. হ্যাঁ, যারা লোক দেখানো, প্রশংসা কুড়ানো ও অহমিকা প্রদর্শন করার জন্য মেহমানদারী করছে, তাদের দাওয়াত গ্রহণ না করা এবং তাদের খাদ্য না খাওয়াই শ্রেয়।
খেজুরের ফজিলত :
সব চেয়ে উত্তম খাদ্য হচ্ছে খেজুর। যে ঘরে খেজুর নেই সে ঘরের লোকজন ক্ষুধার্থ। খেজুর বিষ ও যাদু থেকে প্রতিরক্ষার কাজ করে। আর সব চেয়ে উত্তম খেজুর মদিনার খেজুর, বিশেষ করে আজওয়া খেজুর।
সাদ বিন আবিওয়াক্কাস থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘যে ব্যক্তি সকাল বেলা সাতটি খেজুর খায় সারাদিন তাকে বিষ কিংবা যাদু কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’ বুখারি (৫৪৪৫), মুসলিম (২০৪৭)
খেজুরের উপকারিতা :
খেজুর যকৃৎ শক্তিশালী করে, প্রকৃতিতে কোমলতা আনে ও প্রেসার কমায়। খেজুর অন্যান্য ফলের তুলনায় শরীরে সব চেয়ে বেশী খাদ্য সরবরাহ করে। খেজুরে মিষ্টি জাতীয় কোন উপাদান মিশানোর প্রয়োজন নেই, সে নিজেই মিষ্ট, খেজুর মুখের জীবাণু ধ্বংস করে। খেজুর একই সাথে ফল, খাদ্য, ওষুধ ও মিষ্টান্নের কাজ করে।
• পুরানো খেজুর বেছে খাওয়া এবং কীটদষ্ট অংশ ফেলে দেয়া।
যেসব প্রাণী খাওয়া হারাম, তা নাপাক, তবে তিন প্রকার প্রাণী খাওয়া হারাম হলেও পাক :
১. মানুষ।
২. যেসব পোকামাকড়ের প্রবাহিত রক্ত নেই, তবে নাপাক বস্তু থেকে সৃষ্ট পোকামাকড় নাপাক, যেমন আরসোলা ইত্যাদি। এগুলো জীবিত অথবা মৃত উভয় অবস্থাতেই নাপাক।
৩. যেসব প্রাণী থেকে সাবধানতা অবলম্বন করা খুব কঠিন তা পাক। যেমন বিড়াল, গাধা, তবে কুকুর নাপাক।
 হারাম পশু ও পাখি
• ইসলামি শরিয়ত কর্তৃক হারাম কৃত চতুষ্পদ জন্তু। যেমন গৃহপালিত গাধা ও শূকর।
• ইসলামি শরিয়ত কর্তৃক হারামকৃত পাখপাখালি ও হিংস্র প্রাণী। যেমন চিড়ে-ফেড়ে ভক্ষণকারী পশু ও পাঞ্জা দিয়ে শিকারকারী পাখি।
• সাধারণত যেসব প্রাণী নাপাক। যেমন ইদুর ও কীটপতঙ্গ।
• সাময়িক ভাবে নাপাক প্রাণীও সাময়িক ভাবে হারাম। যেমন সদ্য নাপাক ভক্ষণকারী মুরগি।
• ইসলাম যেসব প্রাণী হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছে। যেমন, সাপ, বিচ্ছু।
• ইসলাম কর্তৃক নিষিদ্ধ প্রাণী। যেমন, হুদহুদ, ব্যঙ্গ, পিঁপড়া ও মধুমাক্ষি ইত্যাদি।
• মৃত জন্তু খেতে অভ্যস্ত পাখি। যেমন, ঈগল, শকুন ও কাক।
• হালাল-হারাম উভয় প্রকার পশুর মিলনে জন্মা প্রাণী। যেমন, খচ্ছর। মাদি গোড়া ও নর গাধার মিলনের ফলে যার জন্ম।
• মৃত পশু বা আল্লাহর নাম ব্যতীত অন্য নামে জবেহ কৃত জানায়োর।
এ সব প্রাণী হারাম, এগুলোর গোশত নাপাক।
বিভিন্ন প্রকার নিষিদ্ধ প্রাণী :
দাঁত দিয়ে শিকারকারী পশু হারাম। যেমন, বাঘ-সিংহ, নেকড়ে বাঘ, চিতা বাঘ, হাতি, কুকুর, শিয়াল, শূকর, বিড়াল, কুমীর, কচ্ছপ, শজারু ও বানর ইত্যাদি।
হারাম পাখপাখালি :
নখ দিয়ে শিকারকারী পাখি হারাম। যেমন, ঈগল, শ্যান, বাজ, শাহীন পাখি, পেঁচা ইত্যাদি।
মৃত জীব জন্তু ও পশুমল ভক্ষণকারী পাখি হারাম। যেমন, শকুন, কাক, বাজপাখি, হুদহুদ ও দোয়েল ইত্যাদি।
হালাল পশু ও প্রাণী
১. উলি্লখিত জীবজন্তু বা যেসব জীবজন্তুর স্বভাব প্রকৃতি উলি্লখিত জীবজন্তুর ন্যায় তা ব্যতীত স্থলের সব চতুষ্পদ জন্তু হালাল। যেমন, উট, গরু, বকরি। তদ্রুপ জঙ্গলী গাধা, ঘোড়া, গোসাপ, জঙ্গলী গরু, হরিণ, খরগোশ, জিরাফ; তবে দাঁত দিয়ে শিকারকারী জঙ্গলী জানোয়ার হারাম।
২. উল্লেখিত পাখপাখালী বা তার ন্যায় অন্যান্য পাখপাখালী ব্যতীত সব পাখিই হালাল। যেমন, মুরগি, হাস, রাজহাঁস, কবুতর, উটপাখি, চড়ুই, বুলবুল, ময়ূর, ঘুঘু ইত্যাদি।
ইবনে আব্বাস রা. বলেন,
‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁত দিয়ে শিকারকারী হিংস্র পশু ও নখ দিয়ে শিকারকারী হিংস্র পাখি খেতে নিষেধ করেছেন।’ (মুসলিম : ১৯৩৪)
৩. সমুদ্রে বাস করে ছোট বড় সব প্রাণীই হালাল। আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে সমুদ্রের শিকার ও তার খাদ্য।’ (সূরা মায়েদা : ৯৬)
হারাম খাদ্য :
১. আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘আর তোমরা তা থেকে আহার করো না, যার উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়নি এবং নিশ্চয় তা সীমালঙ্গন।’ (সূরা আনআম : ১২১)
২. আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত প্রাণী, রক্ত ও শূকরের গোশত এবং যা আল্লাহ ভিন্ন কারো নামে যবেহ করা হয়েছে, গলা চিপে মারা জন্তু, প্রহারে মরা জন্তু, উঁচু থেকে পড়ে মরা জন্তু, অন্য প্রাণীর শিঙের আঘাতে মরা জন্তু এবং যে জন্তুকে, হিংস্র প্রাণী খেয়েছে, তবে যা তোমরা যবেহ করে নিয়েছ তা ছাড়া, আর যা মূর্তি পূজার বেদিতে বলি দেয়া হয়েছে এবং জুয়ার তীর দ্বারা বণ্টন করা হয়, এগুলো গুনাহ।’ (সূরা মায়েদা : ৩)
• জীবিত প্রাণী থেকে আলাদা করা গোশত হারাম, তা মৃত প্রাণীর ন্যায়।
হালাল মৃত প্রাণী ও রক্ত :
দু’প্রকার মৃত প্রাণী ও প্রবাহিত রক্ত ব্যতীত, সব মৃত প্রাণী ও রক্ত হারাম।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘আমাদের জন্য দু’প্রকার মৃত প্রাণী ও দু’প্রকার রক্ত হালাল করা হয়েছে :
(ক) মৃত প্রাণী : যেমন, মাছ ও পঙ্গপাল বা টিড্ডি।
(খ) রক্ত : যেমন, কলিজা ও প্লীহা।’ আহমদ : (৫৭২৩), সিলসিলা সহিহা : (১১১৮), ইবনে মাজা : (৩২১৮)
খানার সঙ্গে তৈল মিশানোর বিধান
জয়তুন বা অন্যান্য তৈল যা উদ্ভিত থেকে সংগৃহিত, খাদ্য-মিষ্টিদ্রব্য বা এ জাতীয় কোনো কিছুর সঙ্গে মিশানো বৈধ ও হালাল। যতক্ষণ-না তা কোন নাপাক জিনিসের সঙ্গে মিশ্রিত হয়। হ্যাঁ, যেসব তৈল হারাম জানোয়ার থেকে নেয়া, যেমন
শূকর বা মৃত প্রাণী, তা হারাম।
হালাল প্রাণীর তৈল তখনই হালাল, যখন তা শরিয়ত সম্মতভাবে যবেহ করা হয় ও তার মধ্যে কোন নাপাক বস্তুর মিশ্রণ না ঘটে।
 নাপাক বস্তু খেতে অভ্যস্ত প্রাণীর বিধান
যেসব পশু বা পাখির অধিকাংশ খাদ্যই নাপাক, তার ওপর আরোহন করা, তার গোস্ত খাওয়া, তার দুধ পান করা ও ডিম খাওয়া নিষেধ; হ্যাঁ, তা আবদ্ধ করে রাখার পর, যখন হালাল খাদ্য খেতে অভ্যস্ত হয় এবং ধারণা হয় যে, তার গোশত পাক হয়েছে, তখনই তা হালাল।
হারাম খাদ্য কখন বৈধ :
যে ব্যক্তি এমন খাদ্য সঙ্কটে পতিত হল যে হারাম না খেলে মারা যাবে, তার জন্য জীবিত থাকার পরিমাণ হারাম খাদ্য গ্রহণ করা বৈধ, যদি তা বিষ না হয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘নিশ্চয় তিনি তোমাদের উপর হারাম করেছেন মৃত জন্তু, রক্ত, শূকরের গোশত এবং যা গায়রুল্লাহর নামে যবেহ করা হয়েছে। সুতরাং যে বাধ্য হবে, অবাধ্য বা সীমালঙ্গনকারী না হয়ে, তাহলে তার কোন পাপ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (বাকারা : ১৭৩)
 মদের বিধান
১. ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘প্রত্যেক নেশা দ্রব্যই মাদক, আর প্রত্যেক নেশা দ্রব্যই হারাম।’ মুসলিম : (২০০৩)
২. ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘ যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং কেয়ামত দিবসের ওপর ঈমান রাখে, সে যেন কখনই সে দস্তরখানে না বসে, যাতে মাদক পরিবেশন করা হয়।’ সহিহ সূত্রে আহমদ : (১২৫), তিরমিজি : (২৮০১)
মাদকদ্রব্য গ্রহণকারীর শাস্তি :
১. ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘প্রত্যেক নেশাদ্রব্য মাদক আর প্রত্যেক নেশাদ্রব্য হারাম। যে ব্যক্তি দুনিয়ায় মদ পান করে অতঃপর সে তওবা না করে মারা যায়, পরকালে সে মদ পান করতে পারবে না।’ বুখারি : (৫৫৭৫), মুসলিম : (২০০৩)
২. জাবের রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘প্রত্যেক নেশাদ্রব হারাম। আল্লাহ তাআলার ওয়াদা, যে ব্যক্তি নেশাদ্রব্য পান করবে, আল্লাহ অবশ্যই তাকে তিনাতুল খাবাল পান করাবেন। তারা জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহর রাসূল, তিনাতুল খাবাল কি? তিনি বললেন, জাহান্নামীদের ঘাম, অথবা জাহান্নামীদের পূঁজ।’ মুসলিম : (২০০২)
মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাও অভিশপ্ত :
আনাস রা. বলেন,
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাদকের ব্যাপারে দশ ব্যক্তিকে অভিসম্পাত করেছেন : যার মাদক তৈরি করার পেশা বা যে নিজের জন্য মাদক তৈরি করে, যে মাদক পান করে, যে বহন করে ও যার জন্য বহন করা হয়, যে পরিবেশন করে, যে মাদক বিক্রি করে, যে মাদকের মূল্য খায়, যে মাদক ক্রয় করে ও যার জন্য ক্রয় করা হয়।’ তিরমিজি : (১২৯৫), ইবনে মাজা : (৩৩৮০)
• খেজুর, জাবিব অথবা এ জাতীয় কোন কিছু ভেজানো পানি পান করা বৈধ। এ পানির নাম নাবিয। পানিতে মিষ্টি স্বাদ অথবা পানির লবণাক্ততা দূর করার জন্য নাবিয বানানো হয়। কিন্তু যদি তা ফুটানো হয় কিংবা তিন দিনের বেশি রাখা হয়, তবে তা হারাম।
 অন্যের সম্পদ ভক্ষণ করার বিধান
ক্ষুধার্থ ব্যক্তি যদি কোন ফলবান বাগান দিয়ে যায়, অথবা এমন বাগান দিয়ে যায় যার ফল নিচে পড়ে আছে, যার চারপাশে কোনো দেয়াল নেই বা তা দেখাশোনার কোনো মালি নেই, সে বাগানের ফল খাওয়া তার জন্য বৈধ, তবে বহন করে কিছু নিয়ে যেতে পারবে না। যদি নিয়ে যায় তবে তাকে মূল্য ফেরৎ দিতে হবে এবং এর শাস্তিও ভোগ করতে হবে।
 হারাম পাত্রে পানাহার করার বিধান
স্বর্ণ, রূপ অথবা সোনা-রূপা দিয়ে প্রলেপ দেয়া পাত্রে পানাহার করা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য হারাম। সে শরীর জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যে হারাম ভক্ষণ করেছে এবং তার দোয়াও কবুল হবে না।
কোন পাত্রে মাছি পড়ে গেলে করণীয় :
আবুহুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘তোমাদের কারো পাত্রে মাছি পড়ে গেলে, তার উচিত পুরো মাছিই ডুবিয়ে দেয়া অতঃপর তা বাইরে ফেলে দেয়া, কারণ তার এক পাখায় রয়েছে রোগ ও অন্য পাখায় রয়েছে প্রতিষেধক।’ বুখারি : (৫৭৮২)
পশু যবেহ করা
হালাল জন্তু বা প্রাণী খাওয়ার পদ্ধতি হচ্ছে যবেহ করে বা নহর করে খাওয়া। অর্থাৎ নির্দিষ্ট নিয়মে খাদ্যনালী ও ঘারের দুপাশের রগ কেটে ফেলা।
যবেহ করার পদ্ধতি :
উটের ব্যপারে সুন্নত হচ্ছে বাঁ হাত বেঁধে দাঁড়ানো অবস্থায় ধারালো ছুরি দিয়ে গর্দান ও বুকের মাঝখানে আঘাত করা, এটাকে বলা হয় নহর। গরু, বকরির ব্যাপারে সুন্নত হচ্ছে বাম পাশে শোয়াইয়ে ধারালো ছুরি দিয়ে যবেহ করা। মনে রাখা প্রয়োজন যে, জীবজন্তু তীর ধনুকের নিশানা বানানো হারাম।
• গর্ভবতী প্রাণীর যবেহ দ্বারা পেটের বাচ্চারও যবেহ হয়ে যায়; হ্যাঁ, পেটের বাচ্চা যদি জীবিত বের হয়ে আসে, তবে তাকেও যবেহ করা জরুরি।
যবেহ শুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলী :
১. যবেহকারীকে যবেহকরার উপযুক্ত হওয়া : অর্থাৎ যবেহকারী পুরুষ কিংবা নারীকে বুদ্ধিমান, মুসলমান বা আহলে কিতাবের কেউ হতে হবে। অতএব নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি, পাগল ও আহলে কিতাব ব্যতীত অন্যান্য কাফেরদের যবেহ হারাম।
২. ধারালো অস্ত্র দিয়ে যবেহ করা, অতএব দাঁত বা নখ দিয়ে যবেহ করা পশু হারাম।
৩. খাদ্য নালী ও দুপাশের রগ কাটার মাধ্যমে রক্ত প্রবাহিত করা।
৪. যবেহ করার সময় বিসমিল্লাহ বলা। বিসমিল্লাহ বলতে ভুলে গেলে কোন সমস্যা নেই, তবে ইচ্ছাকৃতভাবে বিসমিল্লাহ ত্যাগ করলে পশু হালাল হবে না।
৫. শিকার বা শিকারীর ব্যাপারে আল্লাহ কর্তৃক কোন নিষেধাজ্ঞা না থাকা। যেমন হেরেম শরীফে শিকার না করা কিংবা এহরাম অবস্থায় শিকার না করা।
মৃত প্রাণীর বিভিন্ন প্রকার :
গলা চাপার কারণে, অথবা মাথায় আঘাতের কারণে, অথবা বিদু্যতের শর্টের কারণে, অথবা গরম পানিতে ডুবিয়ে দেয়ার কারণে, অথবা অন্য কোনো গ্যাসের কারণে যেসব প্রাণী মারা যায় তা খাওয়া হারাম। কারণ, এমতাবস্থায় রক্ত গোশতের সঙ্গে মিশে যায়, যা মানুষের জন্য খুবই ক্ষতিকর। দ্বিতীয়ত এ পশুর রুহ সুন্নতের বিপরীত পদ্ধতিতে বের করা হয়েছে, তাই এগুলো মৃত প্রাণীর ন্যায়।
আহলে কিতাবিদের যবেহকৃত গোশতের বিধান
১. আহলে কিতাব তথা ইহুদ, নাসারাদের যবেহ-করা গোশত হালাল। আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘আজ তোমাদের জন্য বৈধ করা হল সব হালাল বস্তু এবং যাদেরকে কিতাব প্রদান করা হয়েছে, তাদের খাবার তোমাদের জন্য বৈধ এবং তোমাদের খাবার তাদের জন্য বৈধ।’ (মায়েদা : ৫)
২. যদি জানা যায় যে, আহলে কিতাব বৈধ পন্থায় যবেহ করে নি, বরং গলা চেপে কিংবা বৈদু্যতিক শর্টের মাধ্যমে হত্যা করেছে, তবে তা খাওয়া হালাল নয়। তাদের ব্যতীত অন্য কাফেরদের গোশত কোনো অবস্থায় খাওয়া হালাল নয়।
অবাধ্য বা নাগালের বাইরের পশু যবেহ করা :
নাগালের বাইরের শিকার বা অবাধ্য পশুর কোন অংশে আঘাত করে হত্যা করা হারাম, তদ্রুপ মালিকানাহীন কোন প্রাণী হত্যা করা ও তার দ্বারা উপকৃত হওয়া হারাম।
আহলে কিতাবদের যবেহ-করা গোশত মুসলমান কখন খাবে :
আহলে কিতাব যদি আল্লাহর নাম নিয়ে পশু যবেহ করে, তবে তা হালাল, অন্যথায় তা হারাম। আর যদি কিছু জানা না যায় তবুও হালাল। যবেহ করার পদ্ধতির ব্যাপারে প্রশ্ন করা জরুরি নয়, বরং প্রশ্ন না করাই ভাল।
হালাল পশু যবেহ করা ব্যতীত শুদ্ধ নয়, তবে পতেঙ্গা ও মাছ এর ব্যতিক্রম। আবার যেসব প্রাণী শুধু পানিতে বাস করে তাও যবেহ ছাড়া হালাল।
 শিকারি খাওয়ার বিধান
স্থলের পশু ও পাখি হালাল হওয়ার জন্য দু’টি শর্ত :
(ক) যবেহ করা ও
(খ) আল্লাহর নাম নেয়া।
কারো জন্য পশু যবেহ করা :
মৃত ব্যক্তিকে সওয়াব পৌঁছানোর জন্য পশু যবেহ করা এবং তার গোশত সদকা করাতে কোন সমস্যা নেই। হ্যাঁ, এর দ্বারা যদি মৃত ব্যক্তির নৈকট্য অর্জন করা উদ্দেশ্য হয়, তাহলে এটা হবে বড় শিরক এবং তা খাওয়াও হারাম।
সুন্দরভাবে হত্যা বা যবেহ করা :
১. ধাড়ালো ছুরি দিয়ে যবেহ করা, এক পশুর সামনে অপর পশু যবেহ না করা, পশু সামনে রেখে ছুরি ধার না দেয়া এবং রুহ বের না হওয়া পর্যন্তঘাড় না ভাঙা, চামড়া না ছিলা ও তার কোন অংশ না কাটা।
সাদ্দাদ বিন আউস বলেন, আমি দু’টি জিনিস রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মুখস্থ করেছি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
‘আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক বস্তুর ব্যাপারে ইহসান নির্ধারিত করে দিয়েছেন, তোমরা যখন হত্যা করবে, তখন সুন্দরভাবে হত্যা করবে, আর যখন তোমরা যবেহ করবে, তখন সুন্দরভাবে যবেহ করবে, তোমাদের উচিত ছুরি ধার দিয়ে নেয়া এবং পশু নিস্তেজ হতে দেয়া।’ মুসলিম : (১৯৫৫)
২. যবেহ করার সময় পশু কেবলামুখি করে নেয়া ও বিসমিল্লার সঙ্গে আল্লাহু আকবার মিলিয়ে পড়া।’ আবুদাউদ : (২৮১০), তিরমিজি : (১৫২১)
শিকার
শিকার : কারো মালিকানা ব্যতীত জঙ্গলী কোন জানোয়ার ইচ্ছাকৃতভাবে শিকার করা।
শিকার করার হুকুম :
শিকার করা বৈধ এবং শিকার করা পশু হালাল, তবে হেরেম শরিফে শিকার করা হারাম, তধ্রূপ যে এহরাম অবস্থায় রয়েছে, তার জন্যও স্থলের পশু শিকার করা হারাম।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে সমুদ্রের শিকার ও তার খাদ্য, তোমাদের ও মুসাফিরদের ভোগের জন্য। আর স্থলের শিকার তোমাদের উপর হারাম করা হয়েছে যতক্ষণ তোমরা ইহরাম অবস্থায় থাক।’ (মায়েদা : ৯৬)
শিকারের বিভিন্ন অবস্থা :
শিকারকৃত পশু হস্তগত করার দু’টি অবস্থা :
এক. পূর্ণ জীবিত অবস্থায় ধরা। এ প্রকার শিকার নির্ধারিত পদ্ধতিতে যবেহ করা জরুরি।
দুই. মৃত অবস্থায় ধরা অথবা সামান্য জীবিত অবস্থায় ধরা। এ প্রকার শিকার হালাল হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে। নিম্নে তা তুলে ধরা হল :
হালাল শিকারের শর্তসমূহ :
১. শিকারি ব্যক্তির মুসলমান বা আহলে কিতাব হওয়া এবং সাবালক বা তার কাছাকাছি বয়সের হওয়া।
২. শিকার করা পশুর যবেহ দু’প্রকার :
ক. দাঁত ও নখ ব্যতীত ধারালো অস্ত্র দিয়ে যবেহ করা।
খ. প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিকারি কুকুর বা শিকারি পাখির জখম করে ফেলা। যেমন, কুকুর ও বাজপাখি। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত না হলে শিকার হালাল হবে না।
৩. শিকারি কুকুর বা পাখি শিকারের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা।
৪. তীর নিক্ষেপ করার সময় বা শিকারি প্রাণী প্রেরণ করার সময় মিসমিল্লাহ বলা, বিসমিল্লাহ ভুলে গেলে সমস্যা নেই, তবে ইচ্ছাকৃত ছেড়ে দিলে শিকার হালাল হবে না।
৫. শিকারের জন্য উপযুক্ত স্থান ও উপযুক্ত ব্যক্তি হওয়া। কারণ, এহরাম অবস্থায় শিকার করা হারাম, তদ্রূপ হেরেমে শরিফে শিকার করাও হারাম।
কুকুর পোষ্য বানানোর বিধান
কুকুর পোষ্য বানানো হারাম। যেহেতু কুকুর মানুষের ভীতিগ্রস্ত করে এবং এর কারণে ফেরেশতারা ঘরে প্রবেশ করে না, এর মধ্যে নাপাকি ও নোংড়ামি তো রয়েছেই, উপরন্তু কুকুর পোষ্যকারীর সওয়াব প্রতিদিন দুই কিরাত করে কমে যায়। হ্যাঁ, কেউ যদি শিকারের জন্য, চড়ানোর জন্য অথবা ক্ষেত পাহাড়া দেয়ার প্রয়োজনে কুকুর পোষ্য বানায় তার কথা ভিন্ন।
• কুকুর কোন শিকার করলে অথবা কোন শিকার তার মুখে আটকে রাখলে, তা সাত বার ধোয়া জরুরি নয়, কারণ মানুষের সুবিধার জন্যই কুকুরের শিকার বৈধ করা হয়েছে।
• যদি কোন ব্যক্তি লাঠি বা এ জাতীয় কিছুর দ্বারা শিকার করে, আর ধারালো দিক যদি শিকারের গায়ে আঘাত করে, তবে তা হালাল, অন্যথায় হালাল নয়, ধরে নেয়া হবে তা আঘাতের কারণে মারা গেছে।
• শিকার নিয়ে খেলা করা :
খেলতামাশার জন্য শিকার করা ও ছেড়ে দেয়া এবং তার দ্বারা কোনোভাবে উপকৃত না হওয়া হারাম।
• শিকারের সময় অথবা যবেহ করার সময় রুহ বের হওয়ার পূর্বে পশু থেকে যে রক্ত বের হয় তা নাপাক, এর দ্বারা উপকৃত হওয়া হারাম।
• লুণ্ঠিত অথবা চুরিকৃত অস্ত্র দিয়ে শিকার করা হালাল কিন্তু শিকারকারী গুনাহগার হবে।
• সালাত ত্যাগকারীর শিকার বা যবেহ করা পশু হালাল নয়, কারণ সে কাফের।
• পাখি দ্বারা বাচ্চাদের শান্তনা দেয়ার বিধান :
বাচ্চাদের শান্তনা দেয়ার জন্য পাখি শিকার করা বৈধ। কিন্তু বাচ্চাদের দেখে রাখতে হবে, যাতে সে শিকারকে কোন কষ্ট না দেয় কিংবা ক্ষুধার্থ না রাখে।
• নিরাপরাধ ব্যক্তির দিকে অস্ত্র তাক করা বা অস্ত্র দিয়ে তার দিকে ইশারা করা মসকরা বা সত্যিসত্যি উভয় অবস্থাতেই হারাম।
 
সমাপ্ত
 
লেখক: মুহাম্মদ বিন ইবরাহীম বিন আব্দুল্লাহ আততুইজিরী
অনুবাদক : সানাউল্লাহ নজির আহমদ
সম্পাদক : আবু শুআইব মুহাম্মাদ সিদ্দীক
সূত্র: ইসলামহাউজ

No comments:

Post a Comment

সাম্প্রতিক পোষ্ট

"যারা facebook চালায় তারা কখনই ভাল মুসলিম হতে পারে না" "FB তো ইহুদীর আবিষ্কার"?

"যারা facebook চালায় তারা কখনই ভাল মুসলিম হতে পারে না" "FB তো ইহুদীর আবিষ্কার" . "আপনি এত ইসলাম মানেন তাহলে f...

জনপ্রিয় পোষ্ট সমুহ