তাসবীহ দ্বারা যিকর করা বিদ‘আত
‘‘শাইখুল
হাদীস সাহেব তাবলীগী নিসাবের ফাজায়েলে যিকরের ৪৫৪ পৃষ্ঠায় সহীহ মুসলিমে
একটি হাদীসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘‘অন্য হাদীছে আসিয়াছে, হজরত
ছায়াদ (রহঃ) হুজুরের সহিত জনৈক মেয়ে লোকের বাড়িতে গিয়া দেখন যে, তাহার
সামনে অনেক গুলি মেয়ে খেজুরের বিচি অথবা পাথরের কঙ্কর পড়িয়া আছে যাহার
দ্বারা সে তাছবীহ পাঠ করিয়া থাকে।........এ জন্য সুফীগণ বলেন,
পাপ-ত অগণিত
করিতেছ অথচ আল্লাহর জিকির গুণিয়া গুণিয়া করিতেছ। ইহার অর্থ এই নয় যে, গণনা
করিয়া অজীফা পড়িতে নাই, কারণ বিশেষ সময় গণনা করিয়া পড়ার ছওয়াব হাদীছে
উল্লেখ আছে। বরং অর্থ হইল শুধু গণনার উপর হইবে না। অবসর সময়ে সীমাহীন
সংখ্যায় পড়িতে থাক, যিকির এমন একটি দৌলত যাহার পরিধি সীমারেখার উর্ধ্বে।’’
উল্লিখিত হাদীছ সমূহ দ্বারা মুছলিম সমাজের
প্রচলিত তাছবীহ, অর্থাৎ সুতায় গাঁথা দানার তাছবীহ যে জায়েজ উহার প্রমাণ
পাওয়া যায় কাহারও মতে উহা যে বেদআত তাহা ঠিক নহে, কেননা পাথর কণা বা খেজুর
বিচির উপর পড়িতে হুজুর কোন নিষেধ করেন নাই। গাঁথা বা বিনা গাঁথার মধ্যেও
কোন প্রভেদ নাই, ছুফীদের ভাষায়- প্রছলিত তাছবীহকে শয়তানকে তাড়াইবার কোড়া
বলা হয়। হযরত জুনায়েদ বাগদাদীর হাতে কেহ তাছবীহ দেখিয়া জিজ্ঞাসা করে যে,
ইহার আবার প্রয়োজন কি? তিনি বলেন, যাহার সাহায্যে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ
করিয়াছি উহাকে কি করিয়া ছাড়িতে পারি? ছাহাবায়ে কেরামদের মধ্যে হজরত আবু
ছুফিয়ান, ছায়াদ বিন আবি অক্কাছ, আবূ চায়ীদ খুদরী (রাঃ) প্রমুখ ছাহাবী পাথর
কণা অথবা খেজুরের বিচির সাহায্যে তাছবী পাঠ করিতেন। হজরত আবূ হোরায়রা ও আবু
দারদার নিকট থলিয়া ভর্তী খেজুর বিচি থাকিত। হজরত আবূ হোরায়রার পৌত্র বলেন-
দাদাজানের নিকট দুই হাজার গিরার একা তাগা ছিল, শোয়ার আগে একবার উহাতে
তাছবীহ পাঠ করিয়া লইতেন। ইমাম হোচাইনের বেটি ফাতেমার নিকটও তাছবীহ পাঠের
জন্য গিরাযুক্ত একটা তাগা ছিল।
ছুফীদের পরিভাষায় তাছবীহকে মোজাক্কেরাহ
বলা হয় অর্থাৎ ইহা আল্লাহকে স্মরণ করাইয়া দেয়। কারণ ইহা হাতে থাকিলেই জিকির
করিতে মন চায়। হজরত আলী (রাঃ) হইতে বর্ণিত, হুজুর (ছঃ) এরশাদ করেন তাছবীহ
কি চমৎকার বস্ত্ত যাহা আল্লাহকে স্মরণ করাইয়া দেয়। (ফাজায়েলে জিকির
৪৫৪-৪৫৫)
সম্মানিত মুসলিম ভ্রাতাগণ! শাইখ তাসবীহ
দানার প্রমাণ করতে গিয়ে প্রথম যে হাদীসটি উল্লেখ করেছেন সা‘দ থেকে কিন্তু
তিনি তার কোন প্রমাণ উল্লেখ করেননি। তাহলে আমরা কেমন করে বুঝব যে, এটা
রসূলুল্লাহ (সাঃ)’র হাদীস। তাছাড়া উল্লিখিত হাদীসটির রাবী বা বর্ণনাকারীর
নামের শেসে বন্দনীর মধ্যে লেখা হয়েছে (রহঃ) রহমাতুল্লাহি আলাইহ। এতে প্রমাণ
হয় তিনি একজন তাবিয়ী, সাহাবী হলে (রাযি) লেখা হত। (কিন্তু লেখার প্রিন্টিং
মিসটেক হয়েছে কি জানি না) যাই হোক তিনি যদি তাবিয়ী হন তাহলে রসূলের সাথে
তার সাক্ষাৎ ঘটল কিভাবে?
যেমন তিনি লিখেছেন, সা‘দ (রহ.) রসূলের
সহিত, জনৈক মেয়ে লোকের বাড়িতে গিয়ে দেখেন যে, উল্লিখিত বক্তব্য ঠিক হলে
আমাদের বুঝে আসে না একজন তাবিয়ীর কেমন করে রসূলের সাক্ষাত ঘটল। তাহলে তো
তিনি সহাবী হবেন। আর যদি সহাবীও ধরে নেই তথাপিও বুঝার কোন উপায় নেই যে, এটা
হাদীস কিনা? কারণ তিনি শুধু বলেছেন অন্য হাদীসে আছে। যাই হোক তাসবীহ দানার
প্রমাণ করতে গিয়ে তিনি যে দলীল উপস্থাপন করেছেন তার বেশীর ভাগ সূফীদের
উক্তি। আর সহাবীদের যে দলীল দিয়েছেন তারও কোন দলীল প্রমাণ তিনি পেশ করেননি।
তাহলে আমরা কিসের ভিত্তিতে বিশ্বাস করব যে, কথাটি হাদীসের। আসলে এসব কথা
সূফীদের অথবা হাল জামানার একজন সূফী জনাব যাকারিয়া সাহেব কথাটি বলেছেন।
তাহলে দেখুন সূফীদের ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণ কি বলেছেন। সহাবায়ে কিরামের যুগে
মুসলিমদের মধ্যে তাসাওউফ ও সূফীর প্রচলন ছিল না। পরবর্তীকালে ১৫০ হিজরীতে
মৃত আবূ হাশিম কূকী নামে জনৈক ব্যক্তি তাসাওউফের আক্বীদাহ প্রচার করেন।
তারপর মুসলিমদের মধ্যে সূফীদের উদভব হয়। সে সময় তাদেরকে ‘আহলে খায়র’ কিংবা
‘সালিহীন’ উপাধিতে সম্বোধন করা হতো। তাদের ব্যাপারে এ কথা প্রসিদ্ধ ছিল যে,
তারা তাদের মতবাদের সমর্থনে হাদীস জাল করতেন। তাই হাদীসের নাড়িবিদগণ তাদের
সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছেন। যেমন রিজালশাস্ত্রের মহাপন্ডিত
ও মুহাদ্দিস আল্লামা ইয়াহইয়া ইবনু সাঈদ আল-কাত্তান (মৃত ১৯৮ হিঃ) বলেন,
আমরা হাদীসের ব্যাপারে (সালিহীন) সূফীদের চেয়ে আর কাউকে এত মিথ্যাবাদী
দেখিনি। (সহীহ মুসলিম- ভূমিকা ১৩ পৃঃ, গৃহীত দ্বীনে ইসলামের তাবলীগ ৪২ পৃঃ)
ইবনু আবী আত্তাব বলেন, আমি ইয়াহইয়া ইবনু
সায়ীদের পুত্র মুহাম্মাদের সাথে সাক্ষাত করলাম। অতঃপর তাঁকে সূফী সম্পর্কে
জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, আমার পিতা বলেছেন, তুমি হাদীসের ব্যাপারে ‘আহলে
খায়র’ (সূফীদের) চেয়ে অধিক মিথ্যাবাদী আর কাউকে দেখবে না। (মুসলিমের
ভূমিকা ১৪ পৃ: প্রগুক্ত-৪৩ পৃ:)
বিখ্যাত মুহদ্দিস ইমাম মুসলিম (মৃত ২৬১
হিঃ) বলেন, মিথ্যা তাঁদের (সূফীদের) মুখ থেকে জারী হয়ে যেত। অথচ তারা
ইচ্ছাকৃত মিথ্য বলতেন না। (প্রাগুক্ত ৪৩ পৃঃ)
সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যাকার ইমাম নাবীভী
(মৃত ৬৭৬ হিঃ) বলেন, তাঁরা (সূফীরা) হাদীসশাস্ত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতেন
না। তাই তাদের হাদীস বর্ণনায় ভুল হয়ে যেত। আর তারা জানতেই পারতেন না, ওটা
মিথ্যা। (প্রাগুক্ত ৪৩ পৃঃ নাবাভীর শারহু মুসলিম)
সম্মানিত ভ্রাতাগণ! এতক্ষণ আপনারা জানলেন
সূফীদের সম্পর্কে হাদীস বিশারদ পন্ডিতদের মতামত। এবার লক্ষ্য করুন, তাসবীহ
সংক্রান্ত হাদীস সম্পর্কে যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস কি মন্তব্য করেছেন।
تعم المذكرور وإن افضل ما يسجد عليه الأرض وما انبتته الارض
তাসবীহ পাঠের যন্ত্র দ্বারা তাসবীহ পাঠক
কতই না ভাল ব্যক্তি। নিশ্চয়ই সর্বোত্তম বস্ত্ত সেটিই যার উপর সাজদাহ করা হয়
এবং যমীন যা উৎপাদন করে। আল্লামা নাসিরুদ্দ্বীন আলবানী (রহ.) হাদীসটিকে
জাল বলে উল্লেখ করেছেন। (বিস্তারিত দেখুন : যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ- ১ম
খন্ড, পৃঃ ১২৯-১৩০, হাঃ ৮৩।)
এছাড়া আল্লামা আলবানী বলেন, আমার নিকট এই অর্থও বাতিল কতিপয় কারণে :
১। তাসবীহ দানা দ্বারা তাসবীহ পাঠ করা
বিদ‘আত। কারণ তা নাবী (সাঃ)’র যুগে ছিল না। এটি আবিষ্কার হয়েছে পরবর্তীতে।
কিভাবে তিনি তাঁর সাথীদেরকে এমন একটি কাজ করার জন্য উৎসাহিত করেন যেটিকে
তারা চিনতেন না।
এর দলীল : ইবনু মাস‘উদ (রাঃ) এক মহিলাকে
তাসবীহ দানা দ্বারা তাসবীহ পাঠ করতে দেখে তা কেটে ফেলেছিলেন এবং ছুঁড়ে
ফেলেছিলেন। অতঃপর আরেক ব্যক্তিকে পাথর দ্বারা তাসবীহ পাঠ করতে দেখে তিনি
তাকে তার পা দ্বারা প্রহার করেন। অতঃপর বলেন : তোমরা আমাদের চেয়ে অগ্রণী
হয়ে গেছ! অত্যাচার করে বিদ‘আতের উপর আরোহণ করেছ এবং জ্ঞানের দিক দিয়ে নাবী
(সাঃ)’র সাথীদেরকেও ছাড়িয়ে গেছ!
সম্মানিত পাঠক! তাবলীগী নিসাবের
স্বনামধন্য লেখক হিকায়াতে সহাবার ৬৫৭-৬৫৮ পৃষ্ঠায় হাদীস বর্ণনায় ইবনু
মাস‘উদের সতর্কতা অধ্যয় লিখেছেন হানাফী মাযহারে অধিকাংশ সামায়েল আব্দুল্লাহ
বিন মাস‘উদ (রাঃ)’র রিওয়ায়াত হতে সংগৃহীত। তার বক্তব্য অনুযায়ী আব্দুল্লাহ
বিন মাস‘উদ (রাঃ)’র অনুসরণ আজকে যদি কোন তাবলীগী সূফীর তাসবীহ ছিড়ে বা পাও
দ্বারা ছুড়ে মারা তো দূরের কথা সামান্যতম বেইজ্জতি হয় তবে তাকে মুসলিম
ভাববেন কি?
২। এটি নাবী (সাঃ)’র দিক নির্দেশনা বিরোধী। কারণ ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আমর বলেন : رايت رسول الله صلى الله عليه وسلم يعقد التسبيح بيمينة
‘আমি রসূল (সাঃ)- কে ডান হাতের মুষ্টি
বেঁধে তাসবীহ পাঠ করতে দেখেছি।’ (হাদীসটি আবূ দাঊদ, তিরমিযী, ইবনু হিববান
হাকিম ও বাইহাকী সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন।)
৩। এছাড়া রসূল (সাঃ)’র নির্দেশেরও বিরোধী।
তিনি মহিলাদেরকেও অঙ্গুলিগুলো মুষ্টি বেঁধে তাসবীহ পাঠের নির্দেশ দেন।-
হাদীসটি হাসান। এটি আবূ দাঊদ ও অন্যরা বর্ণনা করেছেন। এটিকে হাকীম ও যাহবী
সহীহ বলেছেন এবং নাববী ও আসক্বলানী হাসান বলেছেন। (দেখুন যঈফ ও জাল হাদীস
সিরিজ ১ম খন্ড, ১৩০-১৩১ পৃঃ)
No comments:
Post a Comment