Monday, November 27, 2017

তাবলীগী নিসাবের সলাত সংক্রান্ত জাল হাদীস

তাবলীগী নিসাবের সলাত সংক্রান্ত জাল হাদীস


আল-কুরআন ও সহীহ হাদীসের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের দ্বিতীয় স্তম্ভ হল দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সলাত। যা যথাসময়ে আদায় করা প্রত্যেক আকেল-বালেগ মু’মিনের প্রতি সর্বপ্রথম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। সলাতই মু’মিন-মুসলিমের পরিচয় এবং ঈমান ও কুফরীর মধ্যে পাথর্ক্য। সলাত পরিত্যাগকারী ‘‘কাফির ও মুশরিকদের দলভুক্ত’’ বলে গণ্য হবে। কিয়ামাতের দিন সর্বপ্রথম সলাতেই হিসাব গ্রহণ করা হবে। এভাবে অগণিত দলীল প্রমাণ আল-কুরআন ও সহীহ হাদীসে ফরয সলাতের গুরুত্ব ও সলাতে অবহেলার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে আমরা জানতে পারি।
কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হল
তাবলীগী নিসাবের লিখক জনাব যাকারীয়া কান্ধালভী তার ফাজায়েলে আমল গ্রন্থের কলেবর বাড়ানোর জন্য কেন যে জাল হাদীসের আশ্রয় নিয়েছেন তা আমাদের বুঝে আসে না। প্রমাণ স্বরূপ আমরা পাঠকের জ্ঞাতার্থে একটি জাল হাদীস তাবলীগী নিসাবের ফাজায়েলে নামাজ থেকে তুলে দিচ্ছি।
‘‘একটি হাদীসে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি এহতেমামের সহীত ও গুরুত্ব সহকারে নামাজ আদায় করিবে আল্লাহ তায়ালা তাহাকে পাঁচ প্রকারে সম্মানিত করিবে। প্রথমতঃ রুজী রোজগার ও জীবনের সংকীর্ণতা হইতে তাহাকে মুক্ত করিবেন। দ্বিতীয়তঃ তাহার উপর হইতে কবরের আজাব হাটাইয়া দিবেন। তৃতীয়তঃ ক্বেয়ামতের দিন তাহার আমলনামা তাহার ডান হাতে দান করিবেন। চতুর্থঃ সে ব্যক্তি পুলছেরাতের উপর দিয়া বিদ্যুতের মত পার হইয়া যাইবে। পঞ্চমতঃ বিনা হিসাবে সে বেহেশতে প্রবেশ করিবে, পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি নামাজে শৈথিল্য প্রদর্শন করে, আল্লাহ পাক তাহাকে পনের প্রকার শাস্তি প্রদান করিবেন। পাঁচ প্রকার দুনিয়াতে, তিন প্রকার মৃত্যুর সময়, তিন প্রকার কবরের ভিতর তিন প্রকার, কবর হইতে পুনরুত্থানের পর। পৃথিবীতে যে পাঁচ প্রকার শাস্তি দেওয়া হইবে তাহা এইরূপ :
১। তাহার জিন্দেগীর বরকত কাড়িয়া নেওয়া হয়।
২। তাহার মুখমন্ডল হইতে নেককারদের জ্যোতি মুছিয়া ফেলা হয়।
৩। যে আমলই সে করুক না কেন আল্লাহ পাক উহার কোন প্রতিদান দেন না।
৪। তাহার কোন দোয়া আছমানে উঠে না অর্থাৎ কবূল হয় না।
৫। নেক বান্দাদের দোয়া হইতেও  সে কোন ফল লাভ করে না।

মৃত্যুর সময়ে তিন প্রকার আজাব এইরূপ :
১। সে বেইজ্জতের সহিত মৃত্যু বরণ করবে
২। সে ক্ষুধার্ত অবস্থায় মারা যায়।
৩। পিপাসিত অবস্থায় সে মৃত্যুর মুখে পতিত হয় যদি সমুদ্রের পানিও তাকে পান করানো হয় তবুও তাহার তৃষ্ণা মিটে না।

কবরের তিন প্রকার এইরূপ :
১। তাহার জন্য কবর এত সংকীর্ণ হয় যে, বুকের হাড়গুলো একর মধ্যে অপরটি ঢুকিয়া যাইবে।
২। তাহার কবরে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করা হয়।
৩। তাহার কবরে এমন একটি সর্প প্রেরিত হয় যাহার চক্ষুদ্বয় আগুনের মত এবং নখরগুলো লোহার। এত বড় দীর্ঘ যে একদিনের রাস্তা অপেক্ষা বড়। তাহার আওয়াজ বজ্রের মত। সাপটি বলিতে থাকিবে যে, আমার পরওয়ারদেগার আমাকে হুকুম করিয়াছেন যে, ফজরের নামাজ নষ্ট করার দরুন সূর্যোদয় পর্যন্ত এবং জোহরের নামাজ নষ্ট করার দরুন আছর পর্যন্ত, আছরের নামাজ নষ্ট করার দরুন সূর্যাস্ত পর্যন্ত, মাগরিবের নামাজ নামাজ নষ্ট করার দরুন এশা পর্যন্ত ও এশার নামাজ নষ্ট করার দরুন ভোর পর্যন্ত তোমাকে দংশন করিতে থাকিব। এই সর্প যখন তাহাকে এক একবার দংশন করিবে তখন সে সত্তর হাত মাটির নীচে ঢুকিয়া যাইবে। কেয়ামত পর্যন্ত এইভাবে সে আজাবে গ্রেফতার থাকিবে। পুনরুত্থানের পর যে তিনটি আজাব হইবে তাহা এইঃ ১। হিসাবে কাঠোরতা ২। আল্লাহর অসন্তুষ্টি ৩। জাহান্নামে প্রবেশ। এখানে সর্বমোট চৌদ্দটা আজাবের উল্লেখ রহিয়াছে, সম্ভবতঃ ভুলবশতঃ রহিয়া গিয়াছে। (তাবলীগী নিসাব ফাযায়েলে নামাজ ৮০-৮১ পৃষ্ঠা)
সম্মানিত মুসলিম ভ্রাতৃমন্ডলী উল্লিখিত  সুদীর্ঘ হাদীসটি পুরোটিই ভিত্তিহীন ও জাল। কোন হাদীস গ্রন্থে এ হাদীসটি পাওয়া যায় না। সে কথা স্বয়ং লেখক যাকারিয়া সাহেবও তার বইয়ের ফায়দার মধ্যে এবং হাদীসের শুরুতে (قال بعضهم) বলেছেন, ‘‘কেউ কেউ বলেছেন, এই কথাটি নাকী হাদীসে আছে’’ এবং হাদীসটি উল্লেখ করার পরে তিনি সংক্ষেপে বলেছেন যে, ইমাম যাহাবী, ইমাম সুয়ূতী প্রমুখ মুহাদ্দিস এই হাদীসটি জাল ও বাতিল হাদীস বলে উল্লেখ করেছেন। এ সনদের জালিয়াতদের পরিচয়ও তারা তুলে ধরেছেন। এভাবে জনাব যাকারিয়া তার গ্রন্থে আরবীতে হাদীসটি জাল উল্লেখ করলেও তার অনুবাদ উর্দূতে করেননি জনাব সাখাওয়াত উল্লাহও বাংলায় ‘জাল’ উল্লেখ করেননি। বরং তার ফায়দা উল্লেখ করেছেন। আমাদের বুঝে আসে না যে, জনাব যাকারিয়ার মত একজন সনামধন্য মুহাদ্দিস কেমন করে ফাযায়েলে আমলের ক্ষেত্রে জাল হাদীস উল্লেখ করলেন, অথচ তিনি যে কথা তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন তা হল ফাযায়েলের ক্ষেত্রে যঈফ হাদীস চলে, যা পরবর্তী যুগের কিছু সংখ্যক মুহাদ্দিস বললেও তা শর্ত সাপেক্ষে। যে শর্তগুলো আমরা এ বইয়ের মধ্যে উল্লেখ করেছি। যাইহোক জাল হাদীসকে জাল উল্লেখ না করে বর্ণনা করা কবিরা গুনাহ। সম্মানিত মুসলিম ভ্রাতাগণ! লক্ষ করেছেন একটা সনদবিহীন জাল হাদীসের জালিয়াতের কথা গোপন করে রসূলে (সাঃ)’র নামে চালিয়ে তার ফায়দা বর্ণনা করা হয়েছে অত্যন্ত সন্তপর্ণে সুকৌশলে যা শইখ যাকারিয়ার মত সূফীদের কাজ। আমরা হাদীস বিশেষজ্ঞদের থেকে জেনেছি যে, এ জাতীয় সূফীরাই ফাযীলাতের ক্ষেত্রে নেক নিয়াতে মানুষকে দ্বীনের দিকে আনার জন্য হাদীস তৈরী করত এবং যঈফ হাদীস বর্ণনা করত। জনাব যাকারীয়া সেই নীতি অবলম্বন করেননি তো?
যাইহোক, এবার লক্ষ করুন! উল্লিখিত হাদীসটি জাল হওয়ার ব্যাপারে হাদীস বিশারদের মতামত :
এই দীর্ঘ হাদীসটি পুরোটাই ভিত্তিহীন ও জাল কোন হাদীসগ্রন্থে এ হাদীসটি পাওয়া যায় না। পরবর্তী যুগের কোন কোন আলিম তাদের ওয়ায নসীহাতমূলক গ্রন্থে অন্য সকল প্রচলিত কথার সাথে এই কথাগুলোও হাদীস হিসাবে উল্লেখ করেছেন। হাদীসের ইমামগণ স্পষ্টরূপে উল্লেখ করেছেন যে, একথাগুলো বাতিল ও জাল কথা। কোন ব্যক্তি এ জালিয়াতি করেছে তাও তাঁরা উল্লেখ করেছন। ইমাম যাহাবী, ইবনু হাজার আসকালানী, সুয়ূতী, ইবনু ইরাক প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। (যাহাবী, মিযানুল ই’তিদাল ৬/২৬৪; লাআলী- পৃঃ ৯৯, ইবনু ইরাক- তানযীহ ২/১১৩-১১৪। গৃহীত- হাদীসের নামে জালিয়াতি- ৩৭০-৩৭১)

No comments:

Post a Comment

সাম্প্রতিক পোষ্ট

"যারা facebook চালায় তারা কখনই ভাল মুসলিম হতে পারে না" "FB তো ইহুদীর আবিষ্কার"?

"যারা facebook চালায় তারা কখনই ভাল মুসলিম হতে পারে না" "FB তো ইহুদীর আবিষ্কার" . "আপনি এত ইসলাম মানেন তাহলে f...

জনপ্রিয় পোষ্ট সমুহ