৪. ইয়াজুয-মা’জুযের আগমণ
ইয়াজুয-মা’জুযের পরিচয়ঃ
ইয়াজুয-মা’জুযের দল
বের হওয়া কিয়ামতের একটি অন্যতম বড় আলামত। এরা বের হয়ে পৃথিবীতে বিপর্যয় ও
মহা ফিতনার সৃষ্টি করবে। এরা বর্তমানে যুল-কারনাইন বাদশা কতৃক নির্মিত
প্রাচীরের ভিতরে অবস্থান করছে। কিয়ামতের পূর্ব মুহূর্তে তারা দলে দলে মানব
সমাজে চলে এসে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালাবে। তাদের মোকাবেলা করার মত তখন কারো
কোন শক্তি থাকবেনা।
তাদের পরিচয়
সম্পর্কে বিভিন্ন কথা বর্ণিত হয়েছে। কোন কোন আলেম বলেনঃ
তারা শুধু মাত্র
আদমের বংশধর। আদম ও হাওয়ার বংশধর নয়। কারণ হিসেবে বলেনঃ আদম (আঃ)এর একবার
স্বপ্নদোষ হয়েছিল। স্বপ্নদোষের মাধ্যমে বীর্যপাত হয়ে মাটির সাথে মিশে গেলে
তা থেকে আল্লাহ তায়ালা ইয়াজুয-মা’জুয জাতি সৃষ্টি করেন।[1]
ইবনে হাজার আসকালানী
(রঃ) বলেনঃ কথাটি পূর্ব যুগের কোন গ্রহণযোগ্য আলেম কর্তৃক বর্ণিত হয়নি।
শুধুমাত্র কা’ব আল-আহবার থেকে বর্ণিত হয়েছে। কথাটি সুস্পষ্ট মারফূ হাদীছের
বিরোধী হওয়ায় তা গ্রহণযোগ্য নয়। মোটকথা তারা তুর্কীদের পূর্ব পুরুষ
ইয়াফিছের বংশধর। আর ইয়াফিছ হলো নূহ (আঃ)এর সন্তান। কাজেই তারা আদম-হাওয়ারই
সন্তান। প্রমাণ স্বরূপ বুখারী শরীফের হাদীছটি উল্লেখযোগ্য। নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
يَقُولُ اللَّهُ تَعَالَى يَا
آدَمُ فَيَقُولُ لَبَّيْكَ وَسَعْدَيْكَ وَالْخَيْرُ فِي يَدَيْكَ
فَيَقُولُ أَخْرِجْ بَعْثَ النَّارِ قَالَ وَمَا بَعْثُ النَّارِ قَالَ
مِنْ كُلِّ أَلْفٍ تِسْعَ مِائَةٍ وَتِسْعَةً وَتِسْعِينَ فَعِنْدَهُ
يَشِيبُ الصَّغِيرُ ( وَتَضَعُ كُلُّ ذَاتِ حَمْلٍ حَمْلَهَا وَتَرَى
النَّاسَ سُكَارَى وَمَا هُمْ بِسُكَارَى وَلَكِنَّ عَذَابَ اللَّهِ
شَدِيدٌ ) قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَأَيُّنَا ذَلِكَ الْوَاحِدُ قَالَ
أَبْشِرُوا فَإِنَّ مِنْكُمْ رَجُلًا وَمِنْ يَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ
تِسْعُمِائةٌ وَ تِسْعَةٌ وَ تسْعُوْنَ ثُمَّ قَالَ وَالَّذِي نَفْسِي
بِيَدِهِ إِنِّي أَرْجُو أَنْ تَكُونُوا رُبُعَ أَهْلِ الْجَنَّةِ
فَكَبَّرْنَا فَقَالَ أَرْجُو أَنْ تَكُونُوا ثُلُثَ أَهْلِ الْجَنَّةِ
فَكَبَّرْنَا فَقَالَ أَرْجُو أَنْ تَكُونُوا نِصْفَ أَهْلِ الْجَنَّةِ
فَكَبَّرْنَا فَقَالَ مَا أَنْتُمْ فِي النَّاسِ إِلَّا كَالشَّعَرَةِ
السَّوْدَاءِ فِي جِلْدِ ثَوْرٍ أَبْيَضَ أَوْ كَشَعَرَةٍ بَيْضَاءَ فِي
جِلْدِ ثَوْرٍ أَسْوَدَ
‘‘রোজ হাশরে আল্লাহ
তাআলা আদমকে বলবেনঃ হে আদম! আদম বলবেনঃ আমি আপনার ডাকে সাড়া দিচ্ছি এবং
আপনার আনুগত্য করার জন্য উপস্থিত আছি। সমস্ত কল্যাণ আপনার হাতে। আল্লাহ
বলবেনঃ জাহান্নামের বাহিনীকে আলাদা করো। আদম বলবেনঃ কারা জাহান্নামের
অধিবাসী। আল্লাহ বলবেনঃ প্রতি হাজারের মধ্যে নয়শত নিরানববই জন। এ সময় শিশু
সন্তান বৃদ্ধ হয়ে যাবে, গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভের সন্তান পড়ে যাবে এবং
মানুষদেরকে আপনি মাতাল অবস্থায় দেখতে পাবেন। অথচ তারা মাতাল নয়। আল্লাহর
আযাবের ভয়াবহতা অবলোকন করার কারণেই তাদেরকে মাতালের মত দেখা যাবে। সাহবীগণ
বললেনঃ আমাদের মধ্য থেকে কি হবে সেই বাকী একজন? উত্তরে নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করো। তোমাদের মধ্যে থেকে
হবে একজন। আর ইয়াজুয-মা’জুযের মধ্যে থেকে হবে নয়শত নিরানববই জন। আল্লাহর
শপথ! আমি আশা করি তোমরা জান্নাতীদের চারভাগের একভাগ হবে। আমরা এটা শুনে
তাকবীর পাঠ করলাম। তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ আমি
আশা করি তোমরা জান্নাতীদের তিনভাগের একভাগ হবে। আমরা এটা শুনেও তাকবীর পাঠ
করলাম। তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ আমি আশা করি
তোমরা জান্নাতীদের দু’ভাগের একভাগ হবে। আমরা এটা শুনেও তাকবীর পাঠ করলাম।
পরিশেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ তোমরা সমগ্র মানব
জাতির মধ্যে একটি সাদা গরুর চামড়ায় একটি কালো লোমের মত।[2]
কুরআন ও হাদীছ থেকে ইয়াজুয-মা’জুয সম্পর্কে যা জানা যায়ঃ
আল্লাহর দু’জন সৎ
বান্দা সমগ্র পৃথিবীর বাদশাহ হয়েছিলেন। একজন হলেন আল্লাহর নবী সুলায়মান
ইবনে দাউদ (আঃ) আর অন্যজন যুল-কারনাইন। যুলকারনাইন পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিম
প্রান্তসহ সমগ্র পৃথিবী পরিভ্রমণ করেছিলেন। কুরআন মাজীদের সূরা কাহাফে তাঁর
ভ্রমণ কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। তাঁর ভ্রমণের কাহিনীর এক পর্যায়ে
ইয়াজুয-মা’জুযের বিবরণ এসেছে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
)ثُمَّ
أَتْبَعَ سَبَبًا (92) حَتَّى إِذَا بَلَغَ بَيْنَ السَّدَّيْنِ وَجَدَ
مِنْ دُونِهِمَا قَوْمًا لَا يَكَادُونَ يَفْقَهُونَ قَوْلًا(93) قَالُوا
يَاذَا الْقَرْنَيْنِ إِنَّ يَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ مُفْسِدُونَ فِي
الْأَرْضِ فَهَلْ نَجْعَلُ لَكَ خَرْجًا عَلَى أَنْ تَجْعَلَ بَيْنَنَا
وَبَيْنَهُمْ سَدًّا (94) قَالَ مَا مَكَّنَنِي فِيهِ رَبِّي خَيْرٌ
فَأَعِينُونِي بِقُوَّةٍ أَجْعَلْ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُمْ رَدْمًا (95)
آتُونِي زُبَرَ الْحَدِيدِ حَتَّى إِذَا سَاوَى بَيْنَ الصَّدَفَيْنِ قَالَ
انفُخُوا حَتَّى إِذَا جَعَلَهُ نَارًا قَالَ آتُونِي أُفْرِغْ عَلَيْهِ
قِطْرًا(96) فَمَا اسْتَطَاعُوا أَنْ يَظْهَرُوهُ وَمَا اسْتَطَاعُوا لَهُ
نَقْبًا(97)قَالَ هَذَا رَحْمَةٌ مِنْ رَبِّي فَإِذَا جَاءَ وَعْدُ رَبِّي
جَعَلَهُ دَكَّاءَ وَكَانَ وَعْدُ رَبِّي حَقًّا(98) وَتَرَكْنَا
بَعْضَهُمْ يَوْمَئِذٍ يَمُوجُ فِي بَعْضٍ وَنُفِخَ فِي الصُّورِ
فَجَمَعْنَاهُمْ جَمْعًا(
‘‘অতঃপর তিনি পথ
অবলম্বন করলেন। চলতে চলতে তিনি যখন দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে পৌঁছলেন
তখন তথায় এমন এক জাতির সন্ধান পেলেন যারা তাঁর কথা একেবারেই বুঝতে
পারছিলনা। তারা বললঃ হে যুল-কারনাইন! ইয়াজুয ও মা’জুয পৃথিবীতে অশান্তি
সৃষ্টি করছে। আমরা কি আপনাকে বিনিময় স্বরূপ কর প্রদান করবো এই শর্তে যে,
আপনি আমাদের ও তাদের মাঝখানে একটি প্রাচীর নির্মাণ করে দিবেন? যুল-কারনাইন
বললেনঃ আমার প্রভু আমাকে যে ক্ষমতা দিয়েছেন তাই যথেষ্ট। তোমরা আমাকে শ্রম
দিয়ে সাহায্য কর। আমি তোমাদের ও তাদের মাঝখানে একটি মজবুত প্রাচীর তৈরী করে
দিবো। তোমরা লোহার পাত নিয়ে আসো। অতঃপর যখন দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী
ফাঁকাস্থান পূর্ণ হয়ে লৌহ স্ত্তপ দুই পর্বতের সমান হলো তখন যুল-কারনাইন
বললেনঃ তোমরা ফুঁক দিয়ে আগুন জ্বালাও। যখন ওটা আগুনে পরিণত হলো তখন তিনি
বললেনঃ তোমরা গলিত তামা আনয়ন করো, ওটা আগুনের উপরে ঢেলে দেই। এভাবে প্রাচীর
নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর ইয়াজুয ও মা’জুয তা অতিক্রম করতে পারলোনা এবং তা
ছিদ্র করতেও সক্ষম হলোনা। যুল-কারনাইন বললেনঃ এটা আমার প্রভুর অনুগ্রহ।
যখন আমার প্রভুর ওয়াদা পূরণের সময় (কিয়ামত) নিকটবর্তী হবে তখন তিনি
প্রাচীরকে ভেঙ্গে চুরমার করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিবেন। আমার প্রতিপালকের
ওয়াদা অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। সেদিন আমি তাদেরকে ছেড়ে দেবো দলের পর দলে
সাগরের ঢেউয়ের আকারে। এবং শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে। অতঃপর আমি তাদের সকলকেই
একত্রিত করবো’’। (সূরা কাহাফঃ ৯২-৯৯)
আখেরী যামানায় কিয়ামতের পূর্বে পাহাড় ভেদ করে ইয়াজুয ও মা’জুযের আগমণ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেনঃ
)حَتَّى
إِذَا فُتِحَتْ يَأْجُوجُ وَمَأْجُوجُ وَهُمْ مِنْ كُلِّ حَدَبٍ
يَنسِلُونَ (৯৬) وَاقْتَرَبَ الْوَعْدُ الْحَقُّ فَإِذَا هِيَ شَاخِصَةٌ
أَبْصَارُ الَّذِينَ كَفَرُوا يَاوَيْلَنَا قَدْ كُنَّا فِي غَفْلَةٍ مِنْ
هَذَا بَلْ كُنَّا ظَالِمِين(
‘‘এমনকি যখন ইয়াজুয ও
মা’জুযকে মুক্ত করা করা হবে তখন তারা প্রত্যেক উঁচু ভূমি থেকে দলে দলে
ছুটে আসবে। যখন সত্য প্রতিশ্রুতি নিকটবর্তী হবে তখন কাফেরদের চক্ষু স্থির
হয়ে যাবে। তারা বলবেঃ হায় দুর্ভোগ আমাদের! আমরা তো ছিলাম এ বিষয়ে উদাসীন;
বরং আমরা ছিলাম যালেম’’। (সূরা আম্বীয়াঃ ৯৬-৯৭)
এই আয়াতগুলো
প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তাআলা ন্যায় পরায়ন বাদশাহ যুল-কারনাইনকে
ইয়াজুয-মা’জুযের বিশাল প্রাচীর নির্মাণের ক্ষমতা দিয়েছিলেন। যাতে তারা
মানুষের মাঝে এবং পৃথিবীতে অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে না পারে। যখন
নির্দিষ্ট সময় এসে যাবে এবং কিয়ামত নিকটবর্তী হবে তখন উক্ত প্রাচীর ভেঙ্গে
যাবে। প্রচন্ড বেগে তারা দলে দলে বের হয়ে আসবে। কোন শক্তিই তাদের সামনে
দাঁড়াতে পারবেনা। পৃথিবীতে তারা অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। আর এটি
হবে শিংগায় ফুঁক দেয়া, দুনিয়া ধ্বংস ও কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার অতি
নিকটবর্তী সময়ে। বুখারী ও মুসলিম শরীফে যায়নাব বিনতে জাহ্শ (রাঃ) হতে
বর্ণিত আছে,
أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّه
عَلَيْهِ وَسَلَّمَ دَخَلَ عَلَيْهَا فَزِعًا يَقُولُ لَا إِلَهَ إِلَّا
اللَّهُ وَيْلٌ لِلْعَرَبِ مِنْ شَرٍّ قَدِ اقْتَرَبَ فُتِحَ الْيَوْمَ
مِنْ رَدْمِ يَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ مِثْلُ هَذِهِ وَحَلَّقَ بِإِصْبَعِهِ
الْإِبْهَامِ وَالَّتِي تَلِيهَا قَالَتْ زَيْنَبُ بِنْتُ جَحْشٍ فَقُلْتُ
يَا رَسُولَ اللَّهِ أَنَهْلِكُ وَفِينَا الصَّالِحُونَ قَالَ نَعَمْ إِذَا
كَثُرَ الْخَبَثُ
‘‘একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর নিকটে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে প্রবেশ করলেন। তিনি বলছিলেনঃ (لَا إلَهَ إلَا اللَّهُ)।
আরবদের জন্য ধ্বংস! একটি অকল্যাণ তাদের অতি নিকটবর্তী হয়ে গেছে। আজ
ইয়াজুয-মা’জুযের প্রাচীর এই পরিমাণ খুলে দেয়া হয়েছে। এ কথা বলে তিনি হাতের
বৃদ্ধাঙ্গল ও তার পার্শ্বের আঙ্গুল দিয়ে বৃত্ত তৈরী করে দেখালেন। যায়নাব
বিনতে জাহ্শ (রাঃ) বলেনঃ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে
বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মাঝে সৎ লোক থাকতেও কি আমরা ধ্বংস হয়ে
যাবো? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ হ্যাঁ, যখন পাপাচার বেড়ে
যাবে’’।[3]
ইয়াজুয-মা’জুয কখন বের হবে?
কুরআনের বর্ণনা থেকে যা জানা যায়, তাহলো কিয়ামতের পূর্বমুহূর্তে তারা মানব সমাজে চলে এসে ব্যাপক অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।
إِنَّ يَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ
يَحْفِرُونَ كُلَّ يَوْمٍ حَتَّى إِذَا كَادُوا يَرَوْنَ شُعَاعَ الشَّمْسِ
قَالَ الَّذِي عَلَيْهِمُ ارْجِعُوا فَسَنَحْفِرُهُ غَدًا فَيُعِيدُهُ
اللَّهُ أَشَدَّ مَا كَانَ حَتَّى إِذَا بَلَغَتْ مُدَّتُهُمْ وَأَرَادَ
اللَّهُ أَنْ يَبْعَثَهُمْ عَلَى النَّاسِ حَفَرُوا حَتَّى إِذَا كَادُوا
يَرَوْنَ شُعَاعَ الشَّمْسِ قَالَ الَّذِي عَلَيْهِمُ ارْجِعُوا
فَسَتَحْفِرُونَهُ غَدًا إِنْ شَاءَ اللَّهُ تَعَالَى وَاسْتَثْنَوْا
فَيَعُودُونَ إِلَيْهِ وَهُوَ كَهَيْئَتِهِ حِينَ تَرَكُوهُ
فَيَحْفِرُونَهُ وَيَخْرُجُونَ عَلَى النَّاسِ فَيُنْشِفُونَ الْمَاءَ
وَيَتَحَصَّنُ النَّاسُ مِنْهُمْ فِي حُصُونِهِمْ فَيَرْمُونَ
بِسِهَامِهِمْ إِلَى السَّمَاءِ فَتَرْجِعُ عَلَيْهَا الدَّمُ الَّذِي
اجْفَظَّ فَيَقُولُونَ قَهَرْنَا أَهْلَ الْأَرْضِ وَعَلَوْنَا أَهْلَ
السَّمَاءِ فَيَبْعَثُ اللَّهُ نَغَفًا فِي أَقْفَائِهِمْ فَيَقْتُلُهُمْ
بِهَا قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَالَّذِي
نَفْسِي بِيَدِهِ إِنَّ دَوَابَّ الْأَرْضِ لَتَسْمَنُ وَتَشْكَرُ شَكَرًا
مِنْ لُحُومِهِمْ
‘‘ইয়াজুয-মা’জুয
প্রাচীরের ভিতর থেকে বের হওয়ার জন্য প্রতিদিন খনন কাজে লিপ্ত রয়েছে। খনন
করতে করতে যখন তারা বের হওয়ার কাছাকাছি এসে যায় এবং সূর্যের আলো দেখতে পায়
তখন তাদের নেতা বলেঃ ফিরে চলে যাও, আগামীকাল এসে খনন কাজ শেষ করে সকাল সকাল
বের হয়ে যাবো। আল্লাহ তাআলা রাত্রিতে প্রাচীরকে আগের চেয়ে আরো শক্তভাবে
বন্ধ করে দেন। প্রতিদিন এভাবেই তাদের কাজ চলতে থাকে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা
কর্তৃক নির্ধারিত মেয়াদ যখন শেষ হবে এবং তিনি তাদেরকে বের করতে চাইবেন তখন
তারা খনন করবে এবং খনন করতে করতে যখন সূর্যের আলো দেখতে পাবে তখন তাদের
নেতা বলবেঃ ফিরে চলে যাও। ইনশা-আল্লাহ, আগামীকাল এসে খনন কাজ শেষ করে সকাল
সকাল বের হয়ে যাবো। এবার তারা ইনশা-আল্লাহ বলবে। অথচ এর আগে কখনো তা বলেনি।
তাই পরের দিন এসে দেখবে যেভাবে রেখে গিয়েছিল সেভাবেই রয়ে গেছে। অতি সহজেই
তা খনন কাজ সম্পন্ন তারা করে মানব সমাজে বের হয়ে আসবে। তারা পৃথিবীর
নদী-নালার সমস্ত পানি পান করে ফেলবে। এমনকি তাদের প্রথম দল কোন একটি নদীর
পাশে গিয়ে নদীর সমস্ত পানি পান করে শুকিয়ে ফেলবে। পরবর্তী দলটি সেখানে এসে
কোন পানি দেখতে না পেয়ে বলবেঃ এখানে তো এক সময় পানি ছিল। তাদের ভয়ে লোকেরা
নিজ নিজ সহায়-সম্পদ নিয়ে অবরুদ্ধ শহর অথবা দুর্গের মধ্যে প্রবেশ করবে।
ইয়াজুয-মা’জুযের দল যখন পৃথিবীতে কোন মানুষ দেখতে পাবেনা তখন তাদের একজন
বলবে যমীনের সকল অধিবাসীকে খতম করেছি। আকাশের অধিবাসীরা বাকী রয়েছে। এই বলে
তারা আকাশের দিকে তীর নিক্ষেপ করবে। রক্ত মিশ্রিত হয়ে তীর ফেরত আসবে। তখন
তারা বলবে যমীনের অধিবাসীকে পরাজিত করেছি এবং আকাশের অধিবাসী পর্যন্ত পৌঁছে
গেছি। অতঃপর আল্লাহ তাদের ঘাড়ে ‘নাগাফ’ নামক এক শ্রেণীর পোঁকা প্রেরণ
করবেন। এতে এক সময়ে একটি প্রাণী মৃত্যু বরণ করার মতই তারা সকলেই ধ্বংস হয়ে
যাবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘‘আল্লাহর শপথ! তাদের মরা
দেহ এবং চর্বি ভক্ষণ করে যমীনের জীব-জন্তু ও কীটপতঙ্গ মোটা হয়ে যাবে এবং
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবে’’।[4]
তবে নির্দিষ্টভাবে তাদের আগমণ হবে ঈসা (আঃ)এর আগমণ এবং দাজ্জালকে পরাজিত করার পর। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
ثُمَّ يَأْتِي عِيسَى ابْنَ
مَرْيَمَ قَوْمٌ قَدْ عَصَمَهُمُ اللَّهُ مِنْهُ فَيَمْسَحُ عَنْ
وُجُوهِهِمْ وَيُحَدِّثُهُمْ بِدَرَجَاتِهِمْ فِي الْجَنَّةِ فَبَيْنَمَا
هُوَ كَذَلِكَ إِذْ أَوْحَى اللَّهُ إِلَى عِيسَى إِنِّي قَدْ أَخْرَجْتُ
عِبَادًا لِي لَا يَدَانِ لِأَحَدٍ بِقِتَالِهِمْ فَحَرِّزْ عِبَادِي إِلَى
الطُّورِ وَيَبْعَثُ اللَّهُ يَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ وَهُمْ مِنْ كُلِّ
حَدَبٍ يَنْسِلُونَ فَيَمُرُّ أَوَائِلُهُمْ عَلَى بُحَيْرَةِ طَبَرِيَّةَ
فَيَشْرَبُونَ مَا فِيهَا وَيَمُرُّ آخِرُهُمْ فَيَقُولُونَ لَقَدْ كَانَ
بِهَذِهِ مَرَّةً مَاءٌ وَيُحْصَرُ نَبِيُّ اللَّهِ عِيسَى وَأَصْحَابُهُ
حَتَّى يَكُونَ رَأْسُ الثَّوْرِ لِأَحَدِهِمْ خَيْرًا مِنْ مِائَةِ
دِينَارٍ لِأَحَدِكُمُ الْيَوْمَ فَيَرْغَبُ نَبِيُّ اللَّهِ عِيسَى
وَأَصْحَابُهُ فَيُرْسِلُ اللَّهُ عَلَيْهِمُ النَّغَفَ فِي رِقَابِهِمْ
فَيُصْبِحُونَ فَرْسَى كَمَوْتِ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ ثُمَّ يَهْبِطُ نَبِيُّ
اللَّهِ عِيسَى وَأَصْحَابُهُ إِلَى الْأَرْضِ فَلَا يَجِدُونَ فِي
الْأَرْضِ مَوْضِعَ شِبْرٍ إِلَّا مَلَأَهُ زَهَمُهُمْ وَنَتْنُهُمْ
فَيَرْغَبُ نَبِيُّ اللَّهِ عِيسَى وَأَصْحَابُهُ إِلَى اللَّهِ فَيُرْسِلُ
اللَّهُ طَيْرًا كَأَعْنَاقِ الْبُخْتِ فَتَحْمِلُهُمْ فَتَطْرَحُهُمْ
حَيْثُ شَاءَ اللَّهُ ثُمَّ يُرْسِلُ اللَّهُ مَطَرًا لَا يَكُنُّ مِنْهُ
بَيْتُ مَدَرٍ وَلَا وَبَرٍ فَيَغْسِلُ الْأَرْضَ حَتَّى يَتْرُكَهَا
كَالزَّلَفَةِ
‘‘অতঃপর ঈসা (আঃ)এর
নিকট এমন কিছু লোক আসবেন, যাদেরকে আল্লাহ তাআলা দাজ্জালের ফিতনা হতে হেফাযত
করেছেন। তিনি তাদের চেহারায় হাত বুলাবেন এবং বেহেশতের মধ্যে তাদের উচ্চ
মর্যাদা সম্পর্কে সংবাদ দিবেন। ঈসা (আঃ) যখন এ অবস্থায় থাকবেন তখন আল্লাহ
তাআলা তাকে জানাবেন যে, আমি এমন একটি জাতি বের করেছি, যাদের সাথে মোকাবেলা
করার ক্ষমতা কারো নেই। কাজেই আপনি আমার বান্দাদেরকে নিয়ে তুর পাহাড়ে উঠে
যান। এ সময় আল্লাহ তাআলা ইয়াজুয-মা’জুযের বাহিনী প্রেরণ করবেন। তারা
প্রত্যেক উঁচু ভূমি থেকে বের হয়ে আসবে। তাদের প্রথম দলটি ফিলিস্তীনের
তাবারীয়া জলাশয়ের সমস্ত পানি পান করে ফেলবে। তাদের শেষ দলটি সেখানে এসে কোন
পানি না পেয়ে বলবেঃ এক সময় এখানে পানি ছিল। তারা আল্লাহর নবী ও তার
সাথীদেরকে অবরোধ করে রাখবে। ঈসা (আঃ) ও তার সাথীগণ প্রচন্ড খাদ্যাভাবে
পড়বেন। এমনকি বর্তমানে তোমাদের কাছে একশত স্বর্ণ মুদ্রার চেয়ে তাদের কাছে
একটি গরুর মাথা তখন বেশী প্রিয় হবে। আল্লাহর নবী ঈসা ও তাঁর সাথীগণ এই
ফিতনা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করবেন। আল্লাহ তাদের দু’আ
কবূল করে ইয়াজুয-মা’জুযের ঘাড়ে ‘নাগাফ’ নামক একশ্রেণীর পোঁকা প্রেরণ
করবেন। এতে একই সময়ে একটি প্রাণী মৃত্যু বরণ করার মত তারা সকলেই মারা যাবে।
অতঃপর আল্লাহর নবী ঈসা ও তার সাহাবীগণ যমীনে নেমে এসে দেখবেন
ইয়াজুয-মাজুযের মরা-পচা লাশ ও তাদের শরীরের চর্বিতে সমগ্র যমীন ভরপূর হয়ে
গেছে। কোথাও অর্ধহাত জায়গাও খালি নেই। আল্লাহর নবী ঈসা ও তাঁর সাথীগণ
আল্লাহর কাছে আবার দু’আ করবেন। আল্লাহ তাদের দু’আ কবূল করে উটের গর্দানের
মত লম্বা লম্বা একদল পাখি পাঠাবেন। আল্লাহর আদেশে পাখিগুলো তাদেরকে অন্যত্র
নিক্ষেপ করে পৃথিবীকে পরিস্কার করবে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা প্রচুর বৃষ্টি
বর্ষণ করবেন। এতে পৃথিবী একেবারে আয়নার মত পরিস্কার হয়ে যাবে।[5]
ইয়াজুয-মা’জুয ধ্বংসের পর পৃথিবীর সুখণ্ডস্বাচ্ছন্দঃ
প্রাচীরের অপর
প্রান্ত হতে বের হয়ে এসে ইয়াজুয-মা’জুয যখন পৃথিবীতে বিপর্যয় ও অশান্তি
সৃষ্টি করবে, অকাতরে গণহত্যা চালাবে এবং ধন-সম্পদ ও ফসল-ফলাদি ধ্বংসের কাজে
লিপ্ত হবে তখন আল্লাহর নবী ঈসা (আঃ) এই মহা বিপদ থেকে মুসলমানদেরকে উদ্ধার
করার জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করবেন। কারণ তারা সংখ্যায় এত বেশী এবং তাদের
আক্রমণ এত প্রচন্ড হবে যে, তাদের সাথে মোকাবেলা করার মত মুসলমানদের কোন
শক্তি থাকবেনা। আল্লাহ তাআলা তাঁর দু’আ কবূল করে ইয়াজুয-মা’জুযের উপরে ছোট
ছোট এক ধরণের পোঁকা প্রেরণ করবেন। পোঁকাগুলোর আক্রমণে এই বাহিনী স্বমূলে
ধ্বংস হয়ে যাবে। তাদের মরা-পঁচা দেহে এবং দুর্গন্ধে যমিন ভরপূর হয়ে যাবে
এবং তাতে বসবাস করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এতে নতুন এক সমস্যার সৃষ্টি হবে।
দ্বিতীয়বার আল্লাহর নবী ঈসা (আঃ) আল্লাহর কাছে দু’আ করবেন। আল্লাহ তাআলা
তাঁদের দু’আ কবূল করে উটের গর্দানের মত লম্বা লম্বা এক দল পাখি পাঠাবেন।
আল্লাহর আদেশে পাখিগুলো তাদেরকে সাগরে নিক্ষেপ করে পৃথিবীকে পরিস্কার করবে।
অতঃপর আল্লাহ তা’আলা প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। এতে পৃথিবী একেবারে আয়নার
মত পরিস্কার হয়ে যাবে। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা যমিনকে ফসল-ফলাদি উৎপন্ন করার
আদেশ দিবেন। যমিন সকল প্রকার ফল ও ফসল উৎপন্ন করবে। ফলগুলো এত বড় হবে যে,
একটি ডালিম এক দল মানুষের জন্য যথেষ্ট হবে। লোকেরা ডালিমের খোসার নিচে
ছাঁয়া গ্রহণ করতে পারবে। দুধে বরকত দেয়া হবে। একটি উটের দুধ সেদিন কয়েকটি
গোত্রের জন্য যথেষ্ট হবে, একটি গাভীর দুধ একটি গোত্রের লোকের জন্য যথেষ্ট
হবে এবং একটি ছাগলের দুধ এক পরিবারের সকলের জন্য যথেষ্ট হবে।[6]
মোটকথা মানুষের মাঝে
তখন চরম সুখণ্ডশান্তি বিরাজ করবে। কোন প্রকার অভাব-অনটন থাকবেনা। সকল
বস্ত্ততে আল্লাহর তরফ থেকে বরকত নাযিল হবে। আল্লাহর ইচ্ছায় নির্দিষ্ট সময়
পর্যন্ত এ অবস্থা বিরাজ করবে। কতই না সুন্দর হবে তখনকার মানুষের জীবন
ব্যবস্থা!
No comments:
Post a Comment