সূফীদের মাযহাবসমূহ
সূফীদের তিনটি মাযহাবে ভাগ করা যায়। যেমন :
(১) প্রাচ্য দর্শন ভিত্তিক মাযহাব الموهب الإشراقى
যা দক্ষিণ এশীয় হিন্দু ও বৌদ্ধদের নিকট থেকে এসেছে। এই মাযহাবের অনুসারী
সূফীরা মা’রেফাত হাসিল করার জন্য দেহকে চরমভাবে কষ্ট দিয়ে স্বীয় ক্বলবকে
তাদের ধারণা মতে জ্যোতির্ময় করার চেষ্টা করে থাকে। প্রায় সকল সূফীই এরূপ
প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকে।
(২) খৃস্টানদের থেকে আগত মাযহাব, যা ‘হুলূল’ ও ‘ইত্তেহাদ’ দু’ভাগে বিভক্ত। (الموهب الحلولى) অর্থ ‘মানুষের দেহে আল্লাহর অনুপ্রবেশ’ (هو القول بأن الله يحل فى الإنسان)
হিন্দু মতে ‘নররূপী নারায়ণ’। ইরানের আবূ ইয়াযীদ বিস্তামী (মৃত ২৬১ হিঃ)
ওরফে বায়েজীদ বুস্তামী ছিলেন এই মতের হোতা। (আল-ফিকরূস সূফী ৬৫ পৃঃ,
কুয়েত- মাকতাবা ইবনু তাইমিয়াহ ২য় সংস্করণ)
এই মাযহাবের অন্যতম নেতা হুসাইন বিন
মানসূর হাল্লাজ (মৃত ৩০৯ হিঃ) নিজেকে সরাসরি ‘আল্লাহ’ (আনাল হক্ব) বলে দাবী
করায় মুরতাদ হওয়ার কারণে তাকে শূলে বিদ্ধ করে হত্যা করা হয়। (মাদখালী,
হাক্বীক্বাতুস্ সূফীইয়াহ ১৯ পৃষ্ঠা)
৩। ইত্তেহাদ বা ওয়াহ্দাতুল উজুদ (وحدة الوجود)
বলতে অদ্বৈতবাদী দর্শন বুঝায়, যা ‘হুলূল’-এর পরবর্তী পরিণতি হিসাবে রূপ
লাভ করে। এর অর্থ হল আল্লাহর অস্তিত্বের মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়া (الفناء فى الله)।
অস্তিত্ব জগতে যা কিছু আমরা দেখছি, সবকিছু একক এলাহী সত্তার বহিঃপ্রকাশ।
এই আক্বীদার অনুসারী সূফীরা স্রষ্টা ও সৃষ্টিতে কোন পার্থক্য করে না। এদের
মতে মূসা (‘আ.)-এর সময়ে যারা বাছুর পূজা করেছিল, তারা মূলতঃ আল্লাহ্কে পূজা
করেছিল। কারণ তাদের দৃষ্টিতে সবই ‘আল্লাহ’। আল্লাহ আরশে নন; বরং সর্বত্র ও
সব কিছুতে বিরাজমান। অতএব মানুষের মধ্যে মু’মিন ও মুশরিক বলে কোন পার্থক্য
নেই। যে ব্যক্তি মূর্তিপূজা করে বা পাথর, গাছ, মানুষ, তারকা ইত্যাদি পূজা
করে, সে মূলতঃ আল্লাহ্কে পূজা করে। সবকিছুর মধ্যে আল্লাহর নূর বা জ্যোতির
প্রকাশ রয়েছে। তাদের ধারণায় খৃস্টানরা কাফের এজন্য যে, তারা কেবল ঈসা
(‘আ.)-কেই প্রভু বলেছে। যদি তারা সকল সৃষ্টিকে আল্লাহ বলত, তাহলে তারা
কাফির হত না। বলা বাহুল্য এটাই হল হিন্দুদের ‘সর্বেশ্বরবাদ’।
তৃতীয় শতাব্দী হিজরী থেকে প্রচলিত এই সব
কুফুরী আক্বীদার সূফী সম্রাট হলেন সিরিয়ার মুহিউদ্দ্বীন ইবনুল আরাবী (মৃত
৬৩৮ হিঃ)। তার একটি কবিতা দ্বারা তার আক্বীদা ফুটে ওঠে, যেমন তিনি বলেন :
العبد حق والرب حق- ياليت شعرى من المكلف
إن قلت عبد فداك حق- أو قلت رب إنى يكلف
বান্দাও সত্য, রবও সত্য। জানি না কে
শারী‘আতের বাধ্য? যদি তুমি বল যে, সে হল বান্দা, তবে সেটাও সত্য। কিংবা যদি
তুমি বল যে, সে হল রব, তবে কোথায় কাকে বাধ্য করা হবে? (হাক্বীক্বাতুস্
সূফীয়া, ২০ পৃষ্ঠা)
বর্তমানে এই আক্বীদাই মা’রেফাতপন্থী
সূফীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। এই আক্বীদার নেতৃত্বে আরও রয়েছেন ইবনু
সাবাঈন, ইবনুল ফারিয, আকীক তিলমেসানী, আবদুল করীম জায়লী (মৃত ৮১১ হিঃ)
আবদুল গণী নবলুসী ও আধুনিককালে আবিষ্কৃত বিভিন্ন তরীকার সূফীরা- (ফাজায়েদুস
সুফীইয়াহ ৪৪ পৃষ্ঠা)। যেমন হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কী যিনি তাবলীগী
জামা‘আত প্রতিষ্ঠাতা জনাব ইলিয়াসের দাদা পীর। যার আক্বীদাও ছিল অনুরূপ, যা
আমরা সামনে বর্ণনা করব ইনশাআল্লাহ।
এদের দর্শন হল এই যে, প্রেমিক ও
প্রেমাস্পদের মধ্যকার সম্পর্ক এমন হতে হবে যেন উভয়ের অস্তিত্বের মধ্যে কোন
ফারাক না থাকে। অথচ আল্লাহ কারো সাথে মিলতে পারেন না। আল্লাহ এবং বান্দা
কখনোই এক হতে পারে না। যেমন আল্লাহ বলেন-لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ
‘‘তাঁর তুলনীয় কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’ (সূরা শূরা
১১)। ‘‘তিনি কাউকে জন্ম দেন না, আর তাঁকেও জন্ম দেয়া হয়নি। তাঁর সমকক্ষ কেউ
নেই’’ (সূরা ইখলাস ৩-৪)। বলাবাহুল্য ‘ফানাফিল্লাহ’র উক্ত আক্বীদা
সম্পূর্ণরূপে কুফরী আক্বীদা। এই আক্বীদাই বর্তমানে চালু আছে।
হিন্দু দার্শনিকগণ ইশ্বর, মানুষ ও ব্যাঙের
মধ্যে কোন পার্থক্য খুঁজে না পেয়ে বলেন, ‘হরির উপরে হরি, হরি শেভা পায়।
হরিকে দেখিয়া হরি হরিতে লুকায়।’
একই দর্শনের প্রভাবে কথিত মুসলিম সূফীগণ আহমাদ ও আহাদ-এর মধ্যে কোন পার্থক্য খুঁজে পান না। এজন্য তারা বলেন,
আকার কি নিরাকার সেই রববানা;
‘আহমাদ’ ‘আহাদ’ হলে তবে যায় জানা।
মীমের ঐ পর্দাটিরে উঠিয়ে দেখবে মন,
দেখবি সেথায় বিরাজ করে ‘আহাদ’ নিরঞ্জন।
এরা আরও বলেন, যত কল্লা তত আল্লাহ।
উর্দু কবি বলেছেন :
بتاء مهرمنور مين نور كسى كاهـﮯ
ميان انجم تابان ظهور كسى كاهـﮯ
বল, জ্যোতির্ময় চন্দ্রের মধ্যে আলো কার? বল তারকারাজির দীপ্তির মাঝে কার প্রকাশ?
সম্মানিত মুসলিম ভ্রাতাগণ! এবার লক্ষ্য
করুন, আমাদের তাবলীগী জামা‘আতের প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস সাহেবের দাদা পীর
ইমদাদুল্লাহ মাক্কী সাহেবের আক্বীদা। তিনি তার তরীকার ধ্যান ও যিক্রের
মহিমা বয়ান করেন এভাবে :
اس مرتبه ﭘر ﭘونـﭼـهكر عارف عالم ﭘر متصرف هو جاتا هـﮯ اور سخر لكم ما في السموات وما في الارض كا انكشاف هوتا هـﮯ اور وه ذى اختيار هو جاتا هـﮯ اور خداكى جس تجلى كو ﭼﺎهتا هـﮯ اپنـﮯ اوﭘر كرتا هـﮯ اور جس صفت كـﮯ ساته ﭼﺎهتا هـﮯ متصف هو كراس كا اثر ظاهر كر سكتا هـﮯ ﭼونكه اس ميـﮞ خدا كـﮯ اوصاف ﭘﺎﮰ جاتـﮯ هيـﮯ اور خدا كـﮯ (خلاق ميـﮞ وه مزين هـﮯ)
‘‘এই স্তরে উপনীত হবার পর আরিফ বা
মা’আরিফাতের অধিকারী ব্যক্তি সমস্ত পৃথিবীর উপর কর্তৃত্বের অধিকারী হয়।
আল্লাহ তা‘আলার যে কোন তাজাল্লীকে ও জ্যোতি রশ্মিকে নিজের উপর আপতিত করে
নিতে পারে। আল্লাহর যে কোন গুণে ইচ্ছা নিজেকে বিভূষিত করিয়া উহার তাছীর ও
প্রভাবের প্রকাশ ঘটাতে পারে। যেহেতু তাহা যেহেতু সে মধ্যে আল্লাহর গুণাবলী
বিদ্যমান এবং আল্লাহর চরিত্রে বিভূষিত। (যিয়াউল কুলুবঃ মূল উর্দু ২৭-২৮
পৃঃ, বাংলা ই.ফা.বাং ৫১ পৃঃ)
উল্লিখিত আক্বীদার দ্বারা প্রমাণিত হয় :
১। মানুষ সমস্ত পৃথিবীর অধিকারী হয়।
২। মানুষ আল্লাহর যে কোন গুণে নিজেকে যখন ইচ্ছা বিভূষিত করে যখন যা ইচ্ছা তখন তাই করতে পারে।
এ কথাগুলি সম্পূর্ণ কুরআন-হাদীস পরিপন্থী ও
শির্ক। আর এই আক্বীদায় বিশ্বাসী তাবলীগী জামা‘আতের প্রতিষ্ঠাতা ও নিসাবের
লেখক উভয়েই যেহেতু তাদের সকলের তরীকার মূলে ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কী।
তাহলে উক্ত আক্বীদার বিশ্বাসীগণ নিশ্চয়ই শির্কে বিশ্বাসী এবং তাবলীগী
জামা‘আত ঈমানের দা‘ওয়াতের নামে প্রকারান্তরে শির্ক ছড়াচ্ছে। মহান আল্লাহ
বলেন :
{لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الأَ<رْضِ}
‘‘আকাশমন্ডল ও পৃথিবী যা কিছু আছে, সবই আল্লাহর।’ (সূরা বাক্বারাহ ২৫৫)
{وَإِنْ تَكْفُرُوا فَإِنَّ ِللهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالأَ<رْضِ}
‘‘তোমরা অস্বীকার করলেও আকাশ ও যমীনে যা আছে সব আল্লাহরই।’’ (সূরা নিসা ১৭০)
আরো দেখুন, ইব্রাহীম-২, ত্বহা-৬,
আশ্শূরা-৪, বাক্বারাহ-২৮৪, ফুরক্বান-২, লুকমান-২৫-২৬। এছাড়া আরো অনেক আয়াত
আছে যাতে বলা হয়েছে সৃষ্টিজগতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর এবং তিনি এসব
নিয়ন্ত্রণ করেন, তাতে তার কোন শরীক নেই।
জনাব ইমদাদুল্লাহ সাহেব তার তরীকার মহিমা বয়ান করেন :
اور جناب بارى كوبـﮯ حجاب ديكهـﮯ ﮔﺎ
হিযাব বা কোনরূপ অন্তরায় ছাড়া আল্লাহ্কে
সে দর্শন করিতে পারিবে। এবং আল্লাহ্কে সতত সমক্ষে প্রত্যক্ষ করার সে তাওফীক
পাবে। (যিয়াউল কুলুব- মূল উর্দু ৭, ২৫ পৃঃ, বাংলা ২০, ৪৭ পৃঃ)
অথচ কুরআন বলে, আল্লাহ্কে দেখা সম্ভব নয়-
{وَلَمَّا جَاءَ مُوسَى لِمِيقَاتِنَا وَكَلَّمَه” رَبُّه” قَالَ
رَبِّ أَرِنِي أَنْظُرْ إِلَيْكَ قَالَ لَنْ تَرَانِي وَلٰكِنِ انْظُرْ
إِلَى الْجَبَلِ فَإِنِ اسْتَقَرَّ مَكَانَهُ فَسَوْفَ تَرَانِي فَلَمَّا
تَجَلَّى رَبُّهُ لِلْجَبَلِ جَعَلَهُ دَكّاً وَخَرَّ مُوسَى صَعِقاً
فَلَمَّا أَفَاقَ قَالَ سُبْحَانَكَ تُبْتُ إِلَيْكَ وَأَنَا أَوَّلُ
الْمُؤْمِنِينَ}
‘‘মূসা যখন আমার নির্ধারিত সময়ে আসল, আর
তার রবব তার সঙ্গে কথা বললেন, তখন সে বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে দেখা
দাও, আমি তোমাকে দেখব’। তিনি বললেন, ‘তুমি আমাকে কক্ষনো দেখতে পাবে না, বরং
তুমি পাহাড়ের দিকে তাকাও, যদি তা নিজ স্থানে স্থির থাকতে পারে তাহলে তুমি
আমাকে দেখতে পাবে।’ অতঃপর তার প্রতিপালক যখন পাহাড়ে নিজ জ্যোতি বিচ্ছুরিত
করলেন, তখন তা পাহাড়কে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিল আর মূসা চৈতন্য হারিয়ে পড়ে
গেল। যখন চেতনা ফিরে পেল, তখন সে বলল, ‘পবিত্র তোমার সত্ত্বা, আমি অনুশোচনা
ভরে তোমার পানেই ফিরে এলাম, আর আমি প্রথম ঈমান আনছি’।’’ (সূরা আ’রাফ ১৪৩)।
পূর্বে তিনি আরো লিখেছেন :
تمام دنيا كـﮯ حركت و سكنات كو خدا كـﮯ حركات وسكنات جانـﮯ اور ظاهرى كام كرنيوالون كو اله اور خدا فاعل حقيقى خيال كرﮮ
বিশ্ব জাহানের যাবতীয় ক্রিয়াকান্ড
অনন্তসত্তা আল্লাহ তা‘আলার ক্রিয়া বলি যাই ভাবিবে। বাহ্যতঃ যাকে কাজ করিতে
দেখা যাইতেছে, তাহাকে শুধুমাত্র একটি মাধ্যম বলিয়া মনে করিরে আর আল্লাহ
তা‘আলাকেই প্রকৃত কর্তা বলে ভাববে। (যিয়াউল কুলব উর্দু ৩৪, বাংলা ৬১ পৃঃ)
বুঝা যাচ্ছে ইমদাদুল্লাহ সাহেব সকল
পাপ-পুণ্যের অনুভূতি, ন্যায়-অন্যায়ের নৈতিকতাবোধ ও জ্ঞানকে ধূলিস্যাৎ করতে
চেয়েছেন। পশু ও মানুষের মধ্যে ব্যবধানটুকু মুছে ফেলতে চেয়েছেন। যে জ্ঞান ও
মানবতাবোধ সৃষ্টি করার জন্য নাবীদের আগমন ঘটেছে। যার প্রভাব আমরা দেখতে
পাচ্ছি তাবলীগী মুবাল্লিগদের মধ্যে। তারা তাকদীরের ভুল ব্যাখ্যা দেয়
এমনভাবে যে, তাদের সাথে যারা সময় লাগায় তাদের আক্বীদার মধ্যে অদৃষ্টবাদের
বীজ এমনভাবে ঢুকিয়ে দেয়া হয় যে, ‘নাহী আনিল মুনকার’-এর জাযবা হারিয়ে ফেলে।
সমাজের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রূখে দাঁড়াবার হিম্মত ও সাহস সে হারিয়ে
ফেলে। কারণ ‘কিছু হতে কিছু হয় না; যা কিছু হয় আল্লাহ হতে হয়’। ফলে একদিকে
যেমন অর্থনৈতিকভাবে মুসলিম উম্মাহ পঙ্গু হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি অন্যায়ের
বিরুদ্ধে ও ইসলামের বিরুদ্ধে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়াবার চেতনাকে
মেরে ফেলে মুসলিম উম্মাহ্কে কাফির মুশরিকদের গোলামে পরিণত করার দূরদর্শী
বিজাতীয় পরিকল্পনার নীল-নকশা বাস্তবায়িত হচ্ছে। আর এসবই হচ্ছে তাসাওউফের
ছোঁয়ায়। যা ছিল নির্জনে বসে খানকার মধ্যে চিল্লাকাশী করা, তাই এখন ময়দানে
নিয়ে এসেছেন জনাব ইলিয়াস। এবার আরো লক্ষ্য করুন, হাজী ইমদাদুল্লাহর আরো
ভ্রান্ত আক্বীদা। তিনি বলেন :
اور توحيد ذاتى يه هـﮯ كه تمام ﭽيزوﮞ كو خدا جانـﮯ
‘তাওহীদে জাতি’ হল এই যে, ‘বিশ্বজগতের সব কিছুকে আল্লাহ বলে ধারণা করা। (যিয়াউল কুলূব- মূল উর্দু ৩৫, বাংলা ৬২ পৃঃ)
আর এই আক্বীদাই হিন্দুদের ‘সর্বেশ্বরবাদ’। যে কুফুরের দাবী করেছিল মানসুর হাল্লাজ তেমনি দাবী করেছেন ইমদাদুল্লাহ সাহেব। তিনি বলেন :
جس نـﮯ كو مجه ديكها اس نـﮯ يقينا خدا كو ديكه ليا من رانى فقد رآى الحق كا ظهور هوتا هـﮯ
আর এই পর্যায়ে উপনীত হওয়ার পর সালিকের
(পীর বা মুরীদের) মধ্যে মান রাআনী ফাকাদ রায়াল ‘হাক্কা’ অর্থাৎ ‘‘যে
ব্যক্তি আমাকে দর্শন করিল সে অন্তময়কেই (আল্লাহ্কে) দর্শন করিল- এই
প্রবচনটির পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটে।’’ কবি বলেন : অনন্ত ময়ের মাঝে তুমি লীন হও,
লীন হওয়ার বোধও লীন কর, তাফরীদের অর্থ ইহাই। (যিয়াউল কুলব- উর্দু ২৬ পৃঃ,
বাংলা ৪৯ পৃঃ)
পীর বা মুরীদকে দর্শন করলে আল্লাহ্কে
দর্শন করা হয় এমন আক্বীদা-বিশ্বাস কি মুসলিমের না মুশরিকের পাঠক একটু
চিন্তা করে দেখুন। আরো দেখুন ইমদাদুল্লাহ সাহেব লিখেছেন :
خدا كو اپـنـﮯ وجود ميـﮯ پاكر منصور كـﮯ اسـﮯ كلمـﮯ كهنـﮯ لـﮕـﮯ گا حضرت منصور رحمه الله انا الحق بعنى مي خدا هو فرمايا كرتـﮯ تهـﮯ
আল্লাহ্কে নিজের মধ্যে প্রত্যক্ষ অনুভব
করিতে থাকে। তখন মানছুর হাল্লাজের মত ‘আনাল হক’ (আমি আল্লাহ) বলে চীৎকার
করিয়া উঠে- (যিয়াউল কুলুব উর্দু ৩১ পৃঃ, বাংলা ৫৫ পৃঃ)। মনসুর হাল্লাজ
‘আনাল হাক্ব’ আমি আল্লাহ বলার অপরাধের জন্য তৎকালীন আলিমগণ তাকে কাফির বলে
ঘোষণা করেন এবং মুরতাদ হওয়ার ফলে শাসন কর্তৃপক্ষ তাকে শূলে বিদ্ধ করে
মৃত্যুদন্ড প্রদান করে- (মাদখালী, হাক্বীকাতুস্ সূফীইয়াহ ১৯ পৃঃ)।
ইমদাদুল্লাহ সাহেব তার তরীকার এক প্রকার ধ্যান বা মুরাকাবা সম্পর্কে বলেন :
كيونكه عارف حقيقت انسانى تك (جو الوهيت هـﮯ ) پهونچ گيا
‘কেননা, এই আরিফ (পীর-মুরীদ) ‘হাকীকতে
ইনসানী’ মানুষের প্রকৃত তাৎপর্যস্তর ‘উলুহিয়্যাত’-এ যাইয়া উপনিত হইতে
পারিয়াছেন- (যিয়াউল কুলূব- মূল উর্দু ২৭ পৃঃ, বাংলা ৫০ পৃঃ)। উলুহিয়্যাত
অর্থ- (প্রভুত্ব) খোদাই- (ফিরোযুল্লগাত উর্দু অভিধান ১১৩ পঃ)। ইমদাদুল্লাহ
সাহেব বুঝাতে চেয়েছেন তার তরীকার ধ্যান রপ্ত করলে মানুষ প্রভুত্বে পৌঁছে
যায়। ভোদায়ীতে অর্থাৎ খোদায়ীতে পৌঁছে যাওয়া আর খোদা (আল্লাহ) হয়ে যাওয়া একই
কথা। যেমন পানির তাপমাত্রা কমে হিমাংকুতে পৌঁছে গেছে এবং পানি বরফ হয়ে
গেছে কথা দু’টি হলেও অর্থ এক। যেমন : একজন সূফী সাধক বলখের ইব্রাহীম আদহাম
তার এক ভক্তকে সূফীতত্ত্বের ‘ফানা’ বিষয় শিক্ষা দিতে উদাহরণ দিয়ে বুঝালেন :
‘এক কলসী পানির মধ্যে এক মুঠো লবণ ছেড়ে দিলে লবণ যেমন পানির সাথে মিশে
বিলীন হয়ে যায় তদ্রূপ যিক্র করে আল্লাহ্কে নিজের ক্বলবের মধ্যে বিলীন করে
ফেলতে হবে’।
সম্মানিত পাঠক! আমরা লক্ষ্য করেছি যে,
তাওহীদের তিনটি প্রকারের যে প্রকারের দা‘ওয়াত দেয়ার কারণে নাবীগণের সাথে
কাফির মুশরিকদের সাথে সংঘাত হয়েছিল, তা হল এই তাওহীদুল উলুহিয়্যায়। যে
দা‘ওয়াত তাবলীগী মুবাল্লিগরা দেয় না। কারণ মূলতঃ এটা তাওহীদের দা‘ওয়াত নয়;
বরং সূফীইয়ম্-এর দা‘ওয়াত। আর সূফীরা নিজেরাইতো ইলাহ, তাইতো তারা
রুবুবিয়্যাতের ঐ দা‘ওয়াত দেয় আর যে বিশ্বাস তৎকালীন কাফির মুশরিকের ছিল।
এবার দেখুন ইমদাদুল্লাহ সাহেব কি বলেন : ظاهر ميـﮞ بنده اور باطن ميـﮞ خدا هو جاتاهـﮯ
সূফী তরীকার ধ্যান ও মুরাকাবা করতে করতে
মানুষ ‘‘বাহ্যত বান্দা অভ্যন্তরীণভাবে সে আল্লাহ হয়ে দাঁড়ায়।’’ (যিয়াউল
কুলূব- মূল উর্দু ২৭ পৃঃ, বাংলা ৫০ পৃঃ)
সম্মানিত মুসলিম ভ্রাতা ও ভগ্নিগণ!
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা আপনারা বুঝতে পেরেছেন যে, দ্বীনের দা‘ওয়াতের নামে
মূলতঃ তাবলীগীরা কুরআন-হাদীস পরিপন্থী সূফী ইযম্ প্রতিষ্ঠা করতে চান। যার
সঙ্গে কুরআন সহীহ হাদীসের দূরতম কোন সম্পর্ক নেই। অতএব দেখা যায় যে,
সূফীদের বীজ কুরআন ও হাদীসের মধ্যে নিহিত ছিল না। বরং রসূলুল্লাহ (সাঃ),
সহাবায়ে কিরাম ও তাবিঈন ইযামের তিনটি স্বর্ণ যুগের পরে হিজরী তৃতীয়
শতাব্দীতে খৃস্টীয় প্রভাবে অতি পরহেযগারীর নামে এর উদ্ভব ঘটে। সহাবী
আবদুল্লাহ বিন যুবায়ির (রাযি.) ও তাবিঈ মুহাম্মাদ ইবনু সিরীন (রহ.)-এর
প্রতিবাদই তার প্রমাণ।
পরিশেষে বলব, ইসলামী আক্বীদার সাথে
মা’রেফাতের নামে প্রচলিত সূফীবাদী আক্বীদার কোন সম্পর্ক নেই। ইসলাম ও সূফী
দর্শন সরাসরি সংঘর্ষশীল। সূফীদের ভিত্তি হল আউলিয়াদের কাশফ, স্বপ্ন,
মুরশিদের ধ্যান ও ফয়েজ ইত্যাদির উপর। পক্ষান্তরে ইসলামের ভিত্তি হল আল্লাহ
প্রেরিত ‘ওয়াহী’ পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসের উপর। সূফীদের আবিষ্কৃত
তরীকাসমূহ তাদের কল্পিত। এর সাথে কুরআন সহীহ হাদীসের দূরতম কোন সম্পর্ক
নেই। সূফীদের ইমারাত হিন্দু-খৃস্টানদের বৈরাগ্যবাদের উপর দন্ডায়মান। ইসলাম
যাকে প্রথমেই দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে (সূরা হাদীদ ২৭)। আল্লাহ আমাদের
হিফাযাত করুন- আমীন!!
No comments:
Post a Comment