সূফীবাদ বনাম ইসলাম
সম্মানিত
মুসলিম ভাই ও বোনেরা! এ প্রবন্ধে আমরা প্রচলিত সূফীবাদ তথা পীর-মুরীদী
নিয়ে আলোচনা করব কারণ আমাদের আলোচ্য বইয়ের লেখক ও তাবলীগী জামা‘আতের
প্রতিষ্ঠাতা উভয়েই পীর ও সূফী ছিলেন। যার কারণে আমরা দেখতে পাই তাবলীগী
নিসাবে সূফীবাদের অনেক আলোচনা আছে। যা দেখলে মনে হয় তাবলীগওয়ালারা দ্বীন
ইসলামের দা‘ওয়াতের নামে প্রকারান্তরে সূফীবাদের দিকেই আহবান করছে। তার
জ্বলন্ত প্রমাণ হল জামা‘আতের প্রতিষ্ঠাতা জনাব ইলিয়াস নিজে সূফী ছিলেন। তার
পীর ছিলেন
বিখ্যাত সূফী দেওবন্দি হানাফী আলিম রশীদ আহমাদ গাঙ্গোহী (মৃত
১৩১৩ হিঃ, ৮ জমাদিউস সানী)- (তারীখে মাশারিখে চিশ্ত ২৮৫ পৃষ্ঠা)। তার পীর ও
মুর্শিদ ছিলেন ভারতবর্ষের পীরদের অন্যতম হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজির মাক্কী
আর তাবলীগী নিসাবের লেখক শায়খ যাকারিয়াও ঐ একই খান্দানী পীর ও সূফী। তার
লিখিত ফাজায়েলে ‘আমাল বা তাবলীগী নিসাব গ্রন্থ অধ্যয়ন করলে আপনারা দেখবেন
সেখানে যে সমস্ত সূফীদের কিস্সা লেখা আছে যেমন- হাসান বাসরী, বায়েজিদ
বোস্তামী, রাবেয়া বসরী, জুনায়েদ বাগদাদী গাযালী, ইত্যাদি সূফীদের কথা। এ
সকল সূফী কারা এদের আক্বীদাহ বিশ্বাস কী ছিল এবং সূফীবাদ ইসলামে গ্রহণযোগ্য
কিনা আমরা এখন কুরআন-সহীহ হাদীসের মানদন্ডে যাচাই করে দেখব।
সূফী শব্দের অর্থ :
বিশ্বের অতুলনীয় প্রতিভা ইমাম ইবনে
তাইমিয়াহ (রহ.) বলেনঃ হিজরীর প্রথম সোনালী তিন যুগে সূফী শব্দটি প্রসিদ্ধ
ছিল না। এই শব্দটির অর্থেও মতভেদ আছে যার সাথে সূফী সম্প্রদায় সম্পৃক্ত হন।
এটি একটি সম্পর্কযুক্ত নাম। যেমন : কুরাইশী ও মাদানী প্রভৃতি।
কেউ বলেন, ‘সূফী’ শব্দটি ‘আহলে
সুফ্ফাহ’-এর সাথে জড়িত। এটা ভুল। কারণ তাই যদি হতো তাহলে ‘সুফ্ফী’ বলা হতো।
কেউ বলেন, এটা আল্লাহর সামনে দাঁড়ানো প্রথম সফ্ (কাতার)-এর সাথে
সম্পর্কিত। এটাও ভুল। কারণ তাই যদি হতো ‘সফ্ফী’ বলা হতো। কারো মতে আল্লাহর
সৃষ্টির মধ্যে ছাটাইকৃত ‘সাফ্ফাহ’-এর সাথে এই শব্দটি জড়িত । এটাও ভুল। কারণ
যদি তাই হতো তাহলে ‘সাফভী’ বলা হতো। কেউ বলেন, এটা আরবের এক গোত্র ‘সূফাহ
ইবনু বিশ্র ইবনু উদ্দ ইবনে তাবিখাত’-এর সাথে সম্পৃক্ত। এরা প্রাচীন যুগ
থেকে মাক্কার আশেপাশে থাকতেন। অধিক ‘ইবাদাতকারীগণ এদেরই সাথে সম্পর্কিত
হতেন। শব্দের সাথে সম্পর্কের দিক দিয়ে এই সম্পর্কটা ঠিক মনে হলেও এটা
দুর্বল অভিমত। কারণ ঐ গোত্রটি অধিক ‘ইবাদাতকারীদের অধিকাংশের নিকট অখ্যাত ও
অপ্রসিদ্ধ। কারণ ‘ইবাদাতকারীগণ যদি তদের সাথে সম্পর্কিত হতেন তাহলে এই
সম্পর্কটা সহাবী ও তাবিয়ী এবং তাবি-তাবিয়ীদের যুগে উত্তম হতো। তদুপরি ঐ
গোত্রের কেউই সূফী নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেনি। আর কেউ ঐ কাফিরী যুগের
গোত্রের সাথে সম্পর্কিত হতে রাযীও হবে না। (ইবনু তাইমিয়াহ মাজমুয়ায়ে
ফাতাওয়া ১১ খন্ড, ৫-৬ পৃষ্ঠা)
সূফী বা তাসাওউফ আরবী শব্দ (الصوف)
হতে গৃহীত। সূফ শব্দের অর্থ পশম। প্রাচীন সূফীগণ সাধারণতঃ পশমী কম্বলে
নিজেদের দেহকে আবৃত করে রাখতেন। আর কম্বল প্রাচীনকাল হতেই সংসারত্যাগী,
সন্ন্যাসব্রত ও বৈরাগ্যের নিদর্শন বলে গণ্য করা হতো। সূফী তাপসগণ অনাড়ম্বর
জীবন যাপন করেন স্বল্প বস্ত্রে। প্রসিদ্ধ মোল্লা জামী সূফী শব্দের মূল صفاء
সফা উল্লেখ করেছেন। সফা শব্দের অর্থ পরিত্রাণ, মুক্তি, পবিত্রতা বলে
বর্ণনা করা হয়েছে। পারস্যের তাপসগণের আর এক নাম পশমিনা (ফারসী ভাষায়) পুশ্
অর্থ কম্বলধারী সাধক। সংসারত্যাগী সূফীজম্-সন্ন্যাসব্রত, বৈরাগ্য ইসলাম
পরিপন্থী, এটা ইসলাম সমর্থন করে না।
এ মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা পবিত্র কুরআনে পরিষ্কারভাবে সূরা হাদীদ-এর ২৭ নং আয়াতে ঘোষণা করেন :
{وَرَهْبَانِيَّةً ابْتَدَعُوهَا مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ إِلاَّ ابْتِغَاءَ رِضْوَانِ اللهِ فَمَا رَعَوْهَا حَقَّ رِعَايَتِهَا}
‘‘আর বৈরাগ্যকে তারা নিজেরা প্রবর্তন করে
নিল, আমি তাদের উপর তা (বৈরাগ্য) বিধিবদ্ধ করিনি, যদিও তারা আল্লাহর
সন্তুষ্টির জন্য (নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী) এ অবস্থা অবলম্বন করেছিল কিন্তু
তারা যথোপযুক্তভাবে এর সংরক্ষণ করে নি।’’ (সূরা আল-হাদীদ ২৭)
যে ‘ইবাদাত বা যিক্র আল্লাহ ও তাঁর রসূল
দেন নি সে ‘ইবাদাত বা ‘আমাল পরিত্যাজ্য। সংসারত্যাগী হয়ে, নাফ্সের উপর
চরমভাবে সংযম চালিয়ে নিজেদেরকে শুদ্ধ করতে চেষ্টা কর সুন্নাতের পরিপন্থী। এ
সম্পর্কে সহীহুল বুখারী এসেছে :
আনাস ইবনু মালিক (রাযি.) বর্ণনা করেন, তিন
ব্যক্তির একটি দল, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর স্ত্রীগণের কাছে, নাবী (সাঃ)-এর
‘ইবাদাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার জন্য আগমন করল। তাদেরকে এ সম্পর্কে অবগত
করানো হলো। নাবী (সাঃ)-এর ‘ইবাদাতের পরিমাণ কম মনে করে তারা বলল : আমরা
নাবীর সমকক্ষ হই কি করে যার আগের ও পরের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। এ
সময় তাদের মধ্য থেকে একজন বলল : আমি বিরতিহীনভাবে সারা বছর সিয়াম পালন
করব। অন্য জন বলল : আজীবন সারা রাত সলাত পড়তে থাকব। তৃতীয় ব্যক্তি বলল, আমি
‘ইবাদাতের জন্য সর্বদা নারী বিবর্জিত থাকব এবং কখনও বিবাহ করব না। (এ কথা
শুনে) নাবী (সাঃ) তাদের কাছে আসলেন এবং বললেন : তোমরা কি সেই লোক যারা এরূপ
কথাবার্তা বলেছ? আল্লাহর কসম, আমি আল্লাহর প্রতি তোমাদের চেয়ে বেশী অনুগত
এবং তাকে তোমাদের চেয়ে বেশী ভয় করি। অথচ তা সত্ত্বেও আমি সিয়াম পালন করি
আবার বিরতিও দেই। রাতে নিদ্রাও যাই, সলাতও পড়ি। আর বিবাহও করি। সুতরাং
যারা আমার সুন্নাতের প্রতি বিরাগ পোষণ করবে তারা আমার উম্মাতের মধ্যে
অন্তর্ভুক্ত নয়। (সহীহ বুখারী হাঃ নং ৪৬৯০ আ.প্র.)
উপরোক্ত কুরআনের বাণী ও রসূলুল্লাহ
(সাঃ)-এর সহীহ হাদীস মোতাবেক এটাই পরিষ্কারভাবে প্রতিভাত হয় যে, সংসার
ত্যাগ করে, দেহের উপর চরম কষ্ট দিয়ে সূফী সেজে বা বৈরাগ্য জীবন যাপন ইসলাম
পরিপন্থী ও সুন্নাত বিরোধী পদ্ধতি যা কখনও কল্যাণকর নয়। সূফী মতবাদ বা সূফী
দর্শন তাসাউফপন্থী তাপস বা সাধকদের তৈরি অর্থাৎ মানুষের তৈরী। আর কুরআনের
দর্শন, কুরআনে প্রদত্ত বাণী আল্লাহর বর্ণিত বিধান। প্রকৃত প্রস্তাবে
সূফীদের নিকট আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ, সাযুজ্ঞানুভূতিই বেহেশ্ত। আর পার্থিব
লিপ্ততা, লোভ, মোহ, কাম-লালসাই দোযখ, মানবাত্মার চরম শুদ্ধিই মুক্তি অর্থাৎ
বেহেশ্ত লাভ আর পার্থিব ও জরাজীর্ণতাই দোযখ। তাদের বেহেশ্ত দোযখ abstract
factor বা গুণবাচক বিষয়- কোন স্থান বিষয়ক কিছু নয়। ইসলাম বলে, শির্ক ও
বিদ‘আতবিহীন খালেস ‘ইবাদাত করে আল্লাহর রহমাত প্রাপ্ত হলে বান্দা বেহেশ্ত
পাবে এবং স্বর্গীয় সুখী জীবন যাপন করবে। আর বান্দার গুনার পাল্লা ভারী হলে
জাহান্নামে গিয়ে নারকীয় শাস্তি ভোগ করবে। সূফীদের আল্লাহ সপ্ততল আসমানের
উপরে আরশে অবস্থান করেন না। তাদের আল্লাহ প্রত্যেক সূফী- সাধকের অন্তরেই
বিরাজমান। শুধু সূফীদের অন্তরেই নয়, জগতে যত প্রাণী (প্রাণ) আছে, তার
মধ্যেই সেই পরম সত্তা বা পরমাত্মা অর্থাৎ আল্লাহ লীন হয়ে আছে। তারা সৃষ্টির
মধ্যেই স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার করে। সূফীদের এ বিশ্বাস ইসলামের
সম্পূর্ণ বিপরীত চিন্তাধারা। আল্লাহ বলেন :
{اللهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالأَ<رْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَو‘ى عَلَى الْعَرْشِ }
‘‘আল্লাহরই আসমানসমূহ ও যমীনকে এবং ঐ
সমস্ত বস্তুকে যা এতদুভয়ের মধ্যে রয়েছে, তা ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর
তিনি (আল্লাহ) আরশে অবস্থান নিয়েছেন।’’ (সূরা আস-সাজদাহ ৩২/৪)
সূফীদের আল্লাহ তাদের অন্তরে আর কুরআন
বলে- আল্লাহ আরশে অবস্থান করেছেন। সুতরাং সূফীদের ধ্যান-ধারণা ইসলামের
পরিপন্থী পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রাচ্যের ধর্মীয় দর্শন অর্থাৎ দক্ষিণ-পূর্ব
এশীয় হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মীয় অনুসৃত সংসার ত্যাগী গেওয়া বসনধারী কৃচ্ছ
সাধনাবলে হৃদয়কে জ্যোতিময় করা এবং পাশ্চাত্যের ধর্মীয় দর্শন ‘সাধনা বলে’
(Divine Power) ঐশ্বরিক শক্তি নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলা মতবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে
বৈরাগ্য পথ ধরা এ দুই মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে সর্বেশ্বরবাদী ও
অদ্বৈতবাদী ধর্মীয় দর্শন। সর্বেশ্বরবাদ হলো সমস্ত প্রাণীর মধ্যে এবং সমস্ত
বস্তুর মধ্যে সৃষ্টিকর্তা লীন হয়ে আছে। জগতে যা কিছু বিরাজ করছে যেমন
চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, গাছপালা, জীব-জন্তু, কীট-পতঙ্গ ইত্যাদি এ
সবই স্রষ্টার বহিঃপ্রকাশ। আর অদ্বৈতবাদ হলো স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে কোন
পার্থক্য নেই। জীবাত্মা ও পরমাত্মা অভিন্ন। মানবাত্মাই পরমাত্মার অংশ
বিশেষ। পরমাত্মাই মানবাত্মার মধ্যে মূর্ত হয়ে থাকেন। ধর্মীয় এ দর্শনদ্বয়
একত্রে মিলিত হয়ে সৃষ্ট হয় সূফী মতবাদ যা ভ্রান্ত মা’রেফাতের বোরকা পরে
বলকান, সিরিয়া, ইরাক ও ইরানে প্রসার লাভ করে হিজরী তৃতীয় শতাব্দীতে। আস্তে
আস্তে পঞ্চম হিজরী শতাব্দীতে বিস্তৃতি ঘটে ভারত উপমহাদেশে। ইসলাম জীবাত্মা ও
পরমাত্মার একাত্মতা স্বীকার করে না। কারণ ইসলাম বলে জীবাত্মা বা মানবাত্মা
আল্লাহর দ্বারা সৃষ্ট। সৃষ্টি ও স্রষ্টা এক হতে পারে না, (সূরা আশ-শূরা
১১)। সমস্ত সৃষ্টির লয় আছে, আছে ধ্বংস, কিন্তু স্রষ্টার ধ্বংস নাই, স্রষ্টা
আল্লাহ অবিনশ্বর, চিরঞ্জীব, শাশ্বত সত্তা-অনন্তকাল ধরে জীবিত থাকবেন।
(দেখুনঃ সূরা আর-রহমান ২৬-২৭, সূরা ইখলাস ১-২)
সূফীদের বিশ্বাস আল্লাহ সূফীর অন্তরে
বিরাজমান; শুধু তার একার অন্তরে নয়, সমস্ত জগতে যত প্রাণ আছে সেই প্রাণে
পরম সত্তা বা পরমাত্মা অর্থাৎ আল্লাহ বিরাজমান। সমস্ত প্রাণ আত্মার মধ্যে
আল্লাহ লীন হয়ে আছেন- তারা সৃষ্টির মধ্যে স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার করে-
নাউযুবিল্লাহ। সূফীদের চরম উৎকর্ষতা হলো আল্লাহ্তে প্রত্যাবর্তন করা,
ফানাফিল্লাহ হয়ে যাওয়া অর্থাৎ আল্লাহ্তে নিমজ্জিত হয়ে যাওয়া, আল্লাহর মধ্যে
লীন হয়ে যাওয়া। এ ফানাফিল্লাহ হওয়ার জন্যই সূফীরা তাদের নফস্কে পরাভূত করে
কঠোর সাধনা বলে মহাসত্তায় (আল্লাহ্তে) বিলীন হয়ে যেতে চায়। সূফীদের কঠোর
সাধনার মূলেই রয়েছে এ উদ্দেশ্য মানবাত্মার চরম শুদ্ধি তাদের মতে মুক্তি
অর্থাৎ বেহেশ্ত এবং পার্থিব জরাজীর্ণতাই দোযখ। তাই যদি হয়, তাহলে সূফী
দর্শনে ক্বিয়ামাতের দিন বা শেষ বিচারের দিন বলে কোন কিছু আছে এমন চিন্তা
করার অবকাশ আছে কি?
সূফীদের আক্বীদা বা বিশ্বাস হলো
‘ফানাফিল্লাহ’ আল্লাহর সত্তায় বিলীন হয়ে যাওয়াই তাদের সাধনার প্রধান লক্ষ্য
এবং এটাই তাদের জান্নাত। জরাজীর্ণতা পার্থিব লোভ-লালসাই তাদের জাহান্নাম।
কিন্তু কুরআনের স্রষ্টার ঘোষণা হচ্ছে সূফী দর্শনের বিপরীতে। কুরআনে বলা
হয়েছে- শেষ বিচারের দিন সমস্ত জ্বীন-ইনসানের বিচার হবে ‘আমাল অনুযায়ী
ডানপন্থী কল্যাণপ্রাপ্ত জ্বিন-ইনসান জান্নাতী এবং বামপন্থী অকল্যাণপ্রাপ্ত
জ্বিন-ইনসান জাহান্নামী হবে।
সূফী মতবাদ অনুযায়ী আল্লাহ সূফীদের
অন্তরেই বিরাজমান, সমস্ত প্রাণী আত্মার মধ্যেই আল্লাহ বর্তমান, সৃষ্টির
মধ্যেই স্রষ্টার অস্তিত্ব যদি স্বীকার করা হয়, তাহলে হিন্দুদের ধর্মীয়
গ্রন্থ বেদান্তের বাণী- যত্র জীবঃ তত্র শিবঃ অর্থ যেখানেই জীব (প্রাণ) আছে
সেখানেই শিব (ভগবান) আছে। উপনিষদ গ্রন্থে আছেঃ নরঃ নারায়ণ অর্থাৎ নরই
নারায়ণ মানে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে নারায়ণ বা ভগবান মূর্ত হয়ে আছেন। তাহলে
সূফী মতবাদ এবং উপনিষদ বৈদান্তিক হিন্দুমত কি একই বলে বিবেচিত হয় না? আবার
প্রত্যেক সৃষ্টির মধ্যেই যদি স্রষ্টা বর্তমান মেনে নেয়া হয়, তাহলে
হিন্দুরা যে মানুষ, গাভী, গাছ, পেঁচা পাখী, সাপ ইত্যাদির পূজা করে বা
প্রণাম করে বা সাজদাহ করে, তা তো সূফী মতবাদে কোন অন্যায় হওয়া উচিৎ নয়।
কারণ হিন্দু Mythology -এর নিগূড় তত্ত্বনুযায়ী হিন্দুরা তো মানুষ গাছ,
গাধা, দূর্গা, শীব, কালী ইত্যাদির পূজা করে না- তারা বাস্তবে পূজা করে
একমাত্র ভগবানের, যিনি ঐ সমস্ত জীবাত্মার মধ্যে (দেবতার মধ্যে) মূর্ত হয়ে
আছেন, অর্থাৎ জীবাত্মায়ই মহাত্মার বা পরমাত্মার অবস্থান। এই আলোচনায় এটাই
কি প্রতিভাত হয় না যে, সূফী মতবাদ আর হিন্দু বৈদান্তিক দর্শনে মূলতঃ কোন
পার্থক্যই নেই।
পাশ্চাত্যের খ্রীস্টান ধর্মীয় ও গ্রীক
দর্শন, পারস্যের (ইরানের) পারসিক এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ ও হিন্দু
দর্শনের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে মুসলিম সমাজে হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর
দ্বিতীয়ার্ধে মারেফাতের আবরণে যে সূফীুবাদের সূচনা হয়। তৎকালীন কিছু
বিশিষ্ট সূফী সাধকের চিন্তাধারা তাদের ভ্রান্ত আক্বীদা সম্পর্কে আলোকপাত
করা প্রয়োজন যাতে সূফী দর্শন সম্পর্কে পাঠকগণের সম্যক জ্ঞান লাভ হয়।
সূফীদের ধর্মীয় সাধক আত্তারের ভিতর দিয়ে
তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ইরানে সূচিত হয়েছিল এক নব
চেতনা-উদ্বেলিত সূফীবাদের প্রবল প্রসার। সূফী সাধক আত্তার বলতেন, আমি
কাশফের বলে দুনিয়ার সব কিছু দেখতে পাই, অদৃশ্যের পর্দা উঠিয়ে ফেলি, দূরকে
আমি আনি চোখের সম্মুখে।
তিনি আরও বলতেন- কি-ই বা প্রয়োজন হাজার
মাইলের ব্যবধানে কায়িক শ্রমে মক্কাহ গিয়ে কা’বার চতুর্দিক শারী‘আতের আচার
অনুযায়ী সাত চক্কর দিয়ে এতে কতটুকুই বা পাবে! যা পাবে তা তো খুবই নগণ্য।
কেননা তুমি কা’বাকে (সাধনা বলে) উঠিয়ে এনে হৃদয়ের পবিত্রস্থানে বসিয়ে
দিন-রাত তওয়াফ করে অশেষ পুণ্যের অধিকারী হও। ইরানের বিস্ত্বম بسطام)
শহরে আবূ ইয়াজিদ বিস্তামী (মৃত্যু ২৬১ হিঃ) ওরফে বায়েজীদ বোস্তামী ঐ
মতবাদের একজন খ্যাতনামা সূফী সাধক ছিলেন। ‘আল-ফিকরূ সূফী’ কিতাবের ৬৫
পৃষ্ঠায় এবং ইসলামী বিশ্বকোষের ২য় খন্ড ১৪৬ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে- ইরানের
কুমিস প্রদেশের বুস্তাম শহরে তার জন্ম এবং সেখানেই তার মৃত্যু। ইলখানী
সুলতান মুহাম্মাদ খদাবন্দ ১৩১৩ খৃস্টাব্দে তার কবরের উপরে একটি গম্বুজ বা
কুবা তৈরি করেন, যা আজও আছে। (কথিত আছে, বায়েজীদ বুস্তামী একবার পূর্ব ভারত
পর্যন্ত সফরে গিয়েছিলেন) তাহলে চট্টগ্রামের বায়েজীদ বুস্তামীর মাজার নামে
যে পীর পূজারীদের টাকা-পয়সা আয়ের গদীটি কি ভন্ডামীর আস্তানা নয়? সে যা-ই
হোক, বায়েজীদ বুস্তামী বলতেনঃ প্রেমিক ও প্রেমাস্পদ একই সত্তা উভয়ের
অস্তিত্বে কোন পার্থক্য নেই। তিনি বলেন, سُبْحَانِْي سُبْحَانِىْ مَا أَعْظَمَ شَأْنِىْ
‘‘মহা পবিত্র আমি, মহা পবিত্র আমি, আমার কতই না বড় মর্যাদা।’’ তিনি তার
আস্তানায় সাধনায় মশগূল থাকতে কেউ যদি তার দরজায় খটখট করতো (Knock করতো)
তিনি ভেতর থেকে উত্তর দিতেন,
لَيْسَ فِيْ الَْبَيْتِ غَيْرُ الله
‘‘আল্লাহ ছাড়া বাড়ীতে আর কেউ নেই।’’
তিনি বার্ধক্যে পৌঁছে এ কথা অহরহ প্রচার করতেন এবং শাগরেদদের বলতেন
طَلَبْتُ اللهَ سِتِّيْنَ سَنَةً فَإِذَا أَنَا هُوَ
‘‘ষাট বছর ধরে আমি আল্লাহ্কে খুঁজেছি, এখন দেখছি আমিই তিনি।’’ অর্থাৎ আমি সেই আল্লাহ। (আন-নকশবন্দীয়াহ ৭৫-৭৭ পৃষ্ঠা)
এ সূফী মতবাদের আর একজন অন্যতম সাধক
ছিলেন হুসাইন বিন মানসুর হাল্লাজ (মৃত্যু ৩০৯ হিঃ)। যিনি নিজেকে সরাসরি
আল্লাহ বলে দাবী করায় মুরতাদ হওয়ার কারণে তাকে শুলে বিদ্ধ করে হত্যা করা
হয়- (মাদখালী, হাক্বীক্বাতুস সূফীয়াহ ২৯ পৃষ্ঠা)। তিনি যিক্র করে বিভোর হয়ে
আল্লাহ্তে বিলীন হয়েছেন বিলীন হয়েছেন বিশ্বাসে, আল্লাহ ও নিজের সম্পর্কে
তিনি বলতেনঃ
نَحْنُ رُوُحَانَ حَلَلْنَا بِبَدَانٍ
‘‘আমরা দু’টি রূহ একটি দেহে লীন হয়েছি।’’ এজন্যই তিনি নিজে বলতেনঃ أنا الحق
‘‘আমি সত্য’’ অর্থাৎ ‘‘আমি আল্লাহ’’- (আন-নকশ্বন্দিয়াহ ৬৪, ৭৪-৭৫ পৃষ্ঠা)।
তিনি আরও বলতেন, আমার মধ্য হতে আল্লাহ্ই কথা বলেন, আমি তো আল্লাহ্তেই
বিলীন হয়ে আছি।
এমনি আর একজন সূফী সাধক হলেন বলখের
ইব্রাহীম আদহাম তিনি তার এক ভক্তকে সূফীতত্ত্ব শিক্ষা দিতে উদাহরণ দিয়ে
বুঝালেন, এক কলসী পানির মধ্যে এক মুঠো লবণ ছেড়ে দিলে লবণ যেমন পানির সাথে
মিশে বিলীন হয়ে যায়, তদ্রূপ যিক্র করে আল্লাহ্কে নিজের ক্বল্বের মধ্যে লীনি
করে ফেলতে হবে। ইরাকের বসরা শহরের তাপসী রাবেয়া বস্রী একদা এক হাতে
জ্বলন্ত আগুনের মশাল অন্য হাতে পানির পাত্র নিয়ে চললেন। পথিমধ্যে এক পরিচিত
লোক তাপসী রাবেয়াকে জিজ্ঞেস করলো- হে তাপসী! কোথায় যাচ্ছ? উত্তরে রাবেয়া
বসরী বললেন, লোকে নাকি কুরআন পড়ে, সলাত পড়ে, ‘ইবাদাত করে, বেহেশ্তের সুখের
আশায় এবং দোযখের কষ্টের ভয়ে। তাই আমি এ আগুন দিয়ে বেহেশ্ত পুড়িয়ে ফেলবো এবং
পানি দিয়ে দোযখ নিভিয়ে ফেলবো, যাতে জগতে নিষ্কাম ঐশী প্রেম প্রতিষ্ঠিত হয়,
প্রলোভন ও ভয়-ভীতি দূর হয় এবং প্রত্যেক অস্তিত্বেই আল্লাহ- এ বিশ্বাস গড়ে
উঠে।
সূফীদের এরূপ অনৈসলামিক ও কুফরী চিন্তা স্মরণ করিয়ে দেয় ইশ্বর বন্দনায় রচিত কবি দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের নিম্নোক্ত কবিতা-
‘‘তুমি আছ অনল-
অনিলে চির নভো নীলে,
ভূধর সলিলে গহনে;
আছ বিটপী লতায় জলধের গায়
শশী তারকায় তপনে।
No comments:
Post a Comment