আরো একটি আয়াতের অর্থ বিকৃতি
নিসাবের
গ্রন্থকার কুরআনের আর একটি আয়াতের বিকৃত অনুবাদ করে চরম ধৃষ্টতা প্রদর্শন
করেছেন। তিনি সূরা কামারের ১৭ নং আয়াতখানি তুলে তার তরজমা করেছেন এভাবে :
وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ
هم نـ كلام ﭘاك كو حفظ كرنـﮯ كـﮯ لئـﮯ سهل كرركها هـﮯ كوئ هـﮯ خفظ كرنـﮯ ولا؟
‘‘আমি কোরআনকে হেফজ করিবার জন্য সহজ করিয়া দিয়াছি, কোন ব্যক্তি কি হেফজ করিতে প্রস্ত্তত আছে?’’ (ফাজায়েলে কুরআন- ২২৬)
উক্ত আয়াতটির উপরে তিনি লিখেছেন,
প্রকৃতপক্ষে
কুরআন মুখস্থ থাকা তার একটি প্রকাশ্য মু’জিযা। নচেৎ তার এক
তৃতীয়াংশ পরিমাণ অন্য বই মুখস্থ করাও অসম্ভব। সূরা কামারে আল্লাহ তা‘আলা
হিফ্য করাকে খাস ইহসান বলে আখ্যায়িত করেছেন।
* শায়খ সাহেব উক্ত আয়াতের যে অনুবাদ
করেছেন পৃথিবীর কোন তাফসীরকারকগণ সে তরজমা গ্রহণ করেনি। এটা তার
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বানোয়াট অনুবাদ। কুরআনের যে কোন আয়াত বা বাক্য দ্বারা
আল্লাহর ইচ্ছা বিরোধী কোন অর্থ করাকে বিকৃতি বলে। যে ব্যক্তি কুরআনের
বিকৃতি করে সে যেন ইসলামের মূলে কুঠারাঘাত করলো। আর যে ব্যক্তি ইসলামের
মূলে আঘাত হানে তার সাথে ইসলামের কতটুকু সম্পর্ক থাকতে পারে তা সচেতন পাঠক
ভেবে দেখুন। মহান আল্লাহ বলেন :
{وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللهِ الْكَذِبَ وَهُوَ يُدْعَى إِلَى الأِ<سْلامِ وَاللهُ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ}
‘‘যে ব্যক্তি ইসলামের দিকে আহুত হয়েও
আল্লাহ্ সম্বন্ধে মিথ্যা রচনা করে তার অপেক্ষা অধিক যালিম আর কে? আল্লাহ
যালিম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না।’ (সূরা সাফ্ফ ৭)
সম্মানিত পাঠক লক্ষ্য করুন, তিনি للذكر শব্দের অর্থ লিখেছেন হিফ্য করার জন্য। আর مذكر অর্থ লিখেছেন হিফ্য করতে প্রস্তুত ব্যক্তি। অথচ আরবী অভিধান অনুযায়ীللذكر অর্থ উপদেশ, উল্লেখ, স্মরণ ও বুঝার জন্য। مذكر
অর্থ হল উপদেশ গ্রহণকারী বা উপদেশ স্মরণকারী। অতএব উক্ত আয়াতের প্রকৃত
অর্থ হলো : আমরা কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি (ঘটনা ও কাহিনী বর্ণনা করে) যাতে
করে লোকেরা উপদেশ গ্রহণ করতে পারে (এবং কুফরী ও শির্কী, মনমগজ থেকে বের করে
দিয়ে ঈমানী জীবন যাপন করতে সক্ষম হয়)। অতএব উক্ত (ঘটনাবলী ও কাহিনী থেকে)
নির্দেশ গ্রহণ করার কেউ আছে কি?
সম্মানিত পাঠক! আয়াতের অনুবাদে বন্ধনীর
মধ্যে সব ঘটনা এবং কাহিনী দেখে হয়তো ভাবতে পারেন এ সব আবার কি? আপনাদের
নিকট অনুরোধ সূরা কামার অর্থ সহকারে একটু পড়ে দেখুন এবং সূরাটির প্রথমে যে
সব কাফির কোন অবস্থাতেই সোজা পথে আসার মত নয়, এ কথা তাদেরকে উদ্দেশ্য করে
বলা হয়েছে। তাদের সম্মুখে পূর্ববর্তী নাবীগণের কয়েকটি ঘটনা বা ইতিহাস তুলে
ধরা হয়েছে। এমনকি ‘শাক্কে কামার’ চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে
যাওয়ার পরও তাদের জ্ঞান চক্ষুর উন্মীলন হয়নি। অথচ এই ঘটনা বা কাহিনী
দ্বারা উপদেশ গ্রহণ ও সাবধান হওয়া উদ্দেশ্য ছিল।
অতঃপর নূহ, আদ, সামূদ, লূত জাতি এবং
ফিরআউনের বংশধরদের অবস্থা সংক্ষেপে বর্ণনা করতঃ বলা হয়েছে যে, এসব জাতি
আল্লাহ প্রেরিত নাবী ও রসূলদের কথা মিথ্যা প্রতিপন্ন করা ও অমান্য করার
কারণে ভয়াবহ, পরিণতি ও কষ্টদায়ক আযাবের শিকার হয়েছিল। একেকটি জাতির কাহিনী
বর্ণনা করার পর ৫ বার এ কথার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে যে, কুরআন উপদেশ গ্রহণ
করার জন্য সহজ করা হয়েছে। কেউ এ কথা থেকে উপদেশ গ্রহণ করতঃ সঠিক পথে চললে
সে আল্লাহর ‘আযাব থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে। প্রত্যেক আলিম আল্লাহর উদ্দেশ্য
মোতাবেক উক্ত আয়াতের তরজমা করেছেন। উদাহরণ স্বরূপ এখানে আশরাফ আলী থানবীর
অনুবাদ উল্লেখ করব। তিনি ছিলেন সাম্প্রতিককালের বিখ্যাত আলিম, যার ‘ইল্মের
প্রশংসা তাবলীগ জামা‘আতের প্রতিষ্ঠাতা মৌঃ ইলিয়াস সাহেব তার মলফুজাতে
করেছেন ৫৬ নং মালফুজাতে তিনি বলেন, থানবী (রহ.) বহু বড় কাজ করে গিয়েছেন।
আমার অন্তর চায় তা’লীম হবে তাঁর, আর তাবলীগের তরীকা হবে আমার। এভাবে তাঁর
তা’লীম যেন সাধারণ্যে ছড়িয়ে পড়ে। সুতরাং লক্ষ্য করুন, শায়খ সাহেব যে তরজমা
করেছেন তা কি থানবীর সঙ্গে মিলে কি না?
* ‘আমরা কুরআনকে নাসীহাত লাভ করার জন্য সহজ করে দিয়েছি। সুতরাং উপদেশ গ্রহণ করার কেউ আছে কি’?
* শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান দেওবন্দি
আয়াতের অর্থ লিখেছেন- ‘আমরা কুরআনকে বুঝার জন্য সহজ করে দিয়েছি, অতএব
চিন্তা করার কেউ আছে কি’?
* উর্দু ভাষায় কুরআনের প্রসিদ্ধ তরজমাকারী
শাহ আবদুল কাদির দেহলভী (রহ.) বলেন- ‘আমরা কুরআন বুঝার জন্য সহজ করে
দিয়েছি, কেউ চিন্তা করার আছে কি’?
* খ্যাতনামা আলিম ও সর্বজননন্দিত
মুহাদ্দিস ভারতগুরু শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলবী (রহ.) বলেছেনঃ ‘আমরা
কুরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ করেছি, কোন উপদেশ গ্রহণকারী আছে কি’?
* বিশ্বনন্দিত মুফাস্সিরে কুরআন আল্লামা
ইবনু কাসীর (রহ.) করেছেন : ‘কুরআনকে আমি সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের
জন্য; অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি’? (ইবনু কাসীর ১৭ খন্ড, ১৮৯ পৃঃ)
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলদেশ কর্তৃক অনূদিত কুরআন ঐ একই অর্থ করা হয়েছে।
মোটকথা গোটা আলিম ও মুফাস্সির সমাজ সূরার
বিষয়বস্তু ও পটভূমি অনুযায়ী অর্থ ও তাৎপর্য উল্লেখ করেছেন। শুধুমাত্র শায়খ
যাকারিয়া (রহ.) সাহেব সমস্ত আলিম থেকে ভিন্নতর এবং সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন অর্থ
বর্ণনা করেছেন। এমন অর্থ ও তাৎপর্য সূরা বিষয়বস্তু ও শানে নুযূলের সাথে
কখনও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। পরিশেষে তাবলীগী মুরুববীদের কাছে অনুরোধ- এসব বিকৃত
অর্থ পরিহার করে তাবলীগী নিসাবকে পুনরায় কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে ঢেলে
সাজান এবং বিশ্বের সরলমনা মুসলিমদের বিভ্রান্তি থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করুন।
আল্লাহ তা‘আলা আপনাদের সুমতি দান করুন।
No comments:
Post a Comment