ফাযায়েলে দরূদ-এর ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ী
‘‘হুজুর
(ছঃ) এরশাদ, ‘‘যে ব্যক্তি জুমার দিন আমার উপর আশী বার দরূদ শরীফ পাঠ করিবে
তার আশী বৎসরের গোনাহ মাফ হইয়া যাইবে।’’ (তাবলীগী নিসাব, ফাজায়েলে দরূদ
শরীফ- ৪৮ পৃঃ)
শাইখ উল্লিখিত হাদীসটি কোন উদ্ধৃতি ছাড়াই
উল্লেখ করেছেন। মুসলিম ভ্রাতাগণ এবার লক্ষ করুন! হাদীসটি সম্পর্কে
মুহাদ্দীসিনগণ কি মন্তব্য করেছেন। এই হাদীটি শুধু যঈফই নয়; বরং আল্লামা
আলবানী যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, সেই অনুসারে জালও বটে। (দেখুন : সিলসিলাতুল
আহদীসুয যাঈফা- ১/১২৫ বিস্তারিত দেখুন বাংলা যঈফ ও ও জাল হাদীস সিরিজ ১ম
খন্ড হা,২১৫, পৃষ্ঠা ২৩৪)
তাছাড়া এই হাদীসটা জাল হওয়ার প্রমাণ এর
বিষয় বস্ত্তর মধ্যেই রয়েছে। কেননা এতে জুমার দিন আশিবার দরূদ পড়ার পুরষ্কার
এই বলা হয়েছে যে, আশি বৎসরের গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। অথচ আল-কুরআনে মহান
আল্লাহ বলেন :
{مَنْ جَاءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَهُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا}
‘‘যে একটি নেকী নিয়ে আসবে তার জন্য দশগুণ পুরস্কার।’’ (সূরা আল-আন‘আম- ১৬০)
সহীহ হাদীসে একবার দরূদ পড়লে দশগুণ সওয়াবের কথা বলা হয়েছে।
من صلى على وحد صلى الله عليه عشرا (مسلم)
যে আমার উপর একবার দরূদ পড়ে আল্লাহ তার উপর দশবার রহমাত নাযিল করেন। (মুসলিম)
পাঠক! লক্ষ্য করুন কুরআন এবং সহীহ হাদীসে
কি অপূর্ব মিল। যারা কুরআন ও হাদীসের মধ্যে বিরোধ আছে মনে করেন তাদের জন্য
এখানে একটি বড় সবক রয়েছে তাহলে, কুরআন ও সহীহ হাদীসে কোন গড়মিল নেই। কারণ
যার উপর কুরআন অবতীর্ণ তিনি কুরআনের বিপক্ষে বলতে পারেন না। এর দ্বারা এটাও
প্রমাণিত হয় যে, যত গরমিল ও মতবিরোধ আমার দেখতে পাই তার মূল কারণই হচ্ছে
জাল ও যঈফ হাদীস। অথচ জাল যঈফ হাদীস শরী‘আতের উৎস নয় এবং তা গ্রহণযোগ্যও
নয়। এছাড়া সওয়াবের ব্যাপারে বিতর্ক সৃষ্টি করে তা অবশ্যই বর্জন করা
প্রয়োজন। কারণ এতে দ্বীনের প্রকৃত অবস্থা বিকৃত হয় এবং এর জন্য মানুষ তার
নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্থাৎ ফারায়িজ থেকে গাফিল হয়ে পড়ে। যা আমরা সহজেই
পার্থক্য করতে পারি, তাবলীগী ভাইদের আমালের মধ্যে, যার গুরুত্ব নেই সেটাকে
বড় করে দেখা হয় এই জামা‘আতে। যেমন উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় :
صلاة بعمامة تعدل خمسا وعشرين صلاة بغير عمامة
‘‘পাগড়ী পরে একটি সলাত কায়িম করা বিনা পাগড়ীতে পঁচিশবার সলাত কায়িমের সমতুল্য।’’
এই হাদীসটি জাল। অন্য বর্ণনায় দুই রাকাত
পাগড়ীসহ ৭০ রাকাতের সওয়াব বিনা পাগড়ীর চেয়ে উত্তম বলা হয়েছে। তাও জাল
(দেখুন জাল ও যঈফ হাদীস সিরিজ, ১ম খন্ড, ১৬৪-৬৫ পৃষ্ঠা)। অথচ তাবলীগী
ভাইদের এ জাতীয় ভিত্তিহীন ফযীলাত নিয়ে বাড়াবাড়ী করতে দেখা যায়। মনে রাখতে
হবে পাগড়ীর ফাযীলাত সংক্রান্ত হাদীসগুলো সবই যঈফ, তবে আল্লাহর রসূল পাগড়ী
পরিধান করতেন এই মর্মে বহু সহীহ হাদীস আছে।
‘‘হুজুর (ছঃ) এরশাদ করেন আমার উপর
শুক্রবার দিন বেশী বেশী করিয়া দরূদ শরীফ পড়িতে থাক কেননা উহা এমন একটি
মুবারাক দিন যে দিন ফেরেশতা আবতরণ করে এবং যে ব্যক্তি আমার উপর দরূদ পাঠ
করে সে দরূদ শেষ করার সাথে সাথেই আমার নিকট উহা পেশ হয়। হজরত আবূ দারদাহ
(রাঃ) বলেন, আমি আরজ করলাম, জুহুর (ছঃ) আপনার ইন্তেকালের পরও কি ঐরূপ হইবে।
জুহুর (ছঃ) বললেন, ইন্তেকালের পরেও ঐরূপ হইবে। কেননা আল্লাহ পাক মাটির জন্য নবীদের শরীরকে খাওয়া হারাম করিয়া দিয়াছেন। নবীগণ কবরে জীবিত আছেন এবং তাঁহাদের নিকট রিযিক পৌঁছিয়া থাকে।’’ (ফাজায়েলে দরূদ- ৪৫-৪৬ পৃঃ)
ফায়েদায় শাইখ সাহেব বলেন, আল্লাহ পাক
নাবীদের শরীরকে মাটির জন্য হারাম করিয়া দিয়াছেন, সুতরাং তাঁহাদরে হায়াত এবং
মাউতের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। (ফাজায়েলে দরূদ- ৪৫ পৃঃ)
শাইখ উক্ত হাদীস খানায় তারগীব ও ইবনে
মাযাহ উদ্ধৃতি দিয়েছেন। হাদীসটি যাচাই করতে আমি পারি নি, তবে জুমু‘আর দিনে
দরূদের ফাযীলাত সংক্রান্ত অনুরূপ একটি হাদীস আমরা পেয়েছি সেখানে বলা হয়েছে :
اكثروا الصلاة على يوم الجمعة فإنه ليس يصلى احد يوم الجمعة الا عرض على الصلاة
অর্থ : জুমু‘আর দিন আমার উপর বেশি বেশি
দরূদ পড়। কেননা তোমাদের মধ্যে যে কোন ব্যক্তি জুমু‘আর দিনে আমার উপর দরূদ
পড়লে তার দরূদ আমার কাছে পেশ করা হয়। (মুস্তাদারাক হাকিম হাঃ ৩৬৩৪, ২/৪৯৫
পৃঃ সহীহল জামে হাঃ ১২০৮, পৃঃ ২৩৬ সহীহ হাদীস।) আর শাইখ বর্ণিত হাদীসের
রেখাযুক্ত যে অংশটুকু সহীহ হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত তা হল :
ان الله عزوجل قد حرم على الأرض ان تاكل اجساد الانبياء
‘আল্লাহ তা‘আলা যমীনের উপর আম্বিয়ায়ে কিরামের শরীর খাওয়া হারাম করে দিয়েছেন।’
(আবূ দাঊদ- সলাত অধ্যায়, জুমু‘আর দিনের ফাযীলাত অনুচ্ছেদ, হাঃ ১০৪৭, ১/২৯০)
উক্ত হাদীস দ্বারা বুঝা যায়, নাবীগণ স্ব
স্ব কবরে স্বশরীরে জীবিত আছে এবং ইবাদাতে রত আছেন। মাটি তাদের পবিত্র শরীর
স্পর্শ করে না। উল্লেখ থাকে যে, নাবীদের জন্য উক্ত হাদীসগুলো দ্বারা
ইন্তিকালের পর যে জীবন প্রমাণিত হয়েছে, এটা দুনিয়াবী জীবন নয়; বরং এটা
বারযাখী জীবন। এ জীবনের ধরন, পদ্ধতি, আকৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে আল্লাহ পাকই
ভাল জানেন। সুতরাং কেউ যদি নাবীদের কবরে জীবিত থাকার অর্থ এই বলেন যে, তারা
বাস্তবে মৃত্য বরণ করেন না, (যা শাইখ সাহেব তার ফায়দায় উল্লেখ করেছেন যে,
তাঁদের হায়াত-মাউতের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই) আমাদের মত খানাপিনা করেন,
চলাফেরা করেন, স্ত্রী সহবাস ইত্যাদি করে থাকেন, আমাদের সভা মজলিসে উপস্থিত
হন, আমাদের চলাফেরা দেখতে পান এবং আমাদের সালাম দরূদ নিজ কানে শুনেন, তাহলে
এটি হবে কুরআন-হাদীস বিরোধী অনৈসলামিক এবং মস্তবড় ভ্রান্ত ও বাতিল
আক্বিদাহ। আম্বিয়ায়ে কিরাম বা ওয়ালীদের সম্পর্কে মুসলিমদের এ ধরনের ভয়ানক ও
বিভ্রান্তিকর এরূপ আক্বীদাহ পোষণ করা শিরক-বিদ‘আত ছাড়া কিছুই নয়। এজাতীয়
আক্বীদাহ থেকে সর্তক থাকা উচিৎ। শাইখ সাহেব ফাজায়েল গ্রন্থের মধ্যে এ ধরনের
বহু বিভ্রান্তিকর আক্বীদাহ স্পষ্ট। যেমন এই হাদীসের ফায়েদায় তিনি লিখেছেন নাবীদের হায়াত ও মাওতের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। অথচ আল্লাহ আরো বলেন :
{وَمَا يَسْتَوِي الْأَحْيَاءُ وَلا الْأَمْوَاتُ إِنَّ اللهَ يُسْمِعُ مَنْ يَشَاءُ وَمَا أَنْتَ بِمُسْمِعٍ مَنْ فِي الْقُبُورِ }
‘‘সমান নয় জীবিত ও মৃত। আল্লাহ যকে ইচ্ছা শ্রবণ করান আর তুমি শুনাতে সমর্থ হবে না যারা কবরে রয়েছে তাদেরকে।’’ (সূরা ফাতির ২২)
মহান আল্লাহ আরো বলেন :
{إِنَّكَ لا تُسْمِعُ الْمَوْتَى }
অর্থ : ‘‘(হে নাবী) তুমি মৃতদের কোন কিছু শুনাতে পারবে না।’’ (সূরা আন-নামল-৮০)
ومن ورائهم برزخ إلى يوم يبعثون
অর্থ : তাদের (মৃতদের) সম্মুখে রয়েছে বারযাখ (পর্দা) থাকবে, পুনঃউত্থান দিবস পর্যন্ত।
মহান আল্লাহ বলেন :
{إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُم مَّيِّتُونَ}
হে নাবী! তুমি তো মরণশীল এবং তারাও মরণশীল। (সূরা আয-যুমার : ৩০)
উল্লিখিত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হল যে,
নাবীসহ মুর্দা এবং জীবিত উভয়ে সমান নয়। এ বিতর্কের অবসান আবূ বাকর (রাঃ)
করেছিলেন সাহাবাদের মাঝে রসূল (সাঃ)-এর ইন্তিকালের সঙ্গে সঙ্গে সূরা
আল-ইমরনের ১৪৪ নং আয়াতের মাধ্যমে। অন্যদের যে জীবন তাহল বারযাখী জীবন, যে
সম্পর্কে আমাদের কোন জ্ঞান নেই, এমনকি শহীদ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন যে,
যারা আল্লাহর পতে নিহত হয় তাদেরকে মৃত বল না; বরং তারা জীবিত কিন্তু তোমরা
উপলদ্ধি করতে পার না।
ولكن لا تشعرون
এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা একথা
স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, তাদের জীবনকে আমরা উপলদ্ধি করতে পারব না। সেটা
তিনিই ভাল জানেন। কিন্তু শাইখ লিখিত আক্বীদাহ দ্বারা আমার মনে হয়
মাযারপূঁজার দ্বার উন্মুক্ত করা হয়েছে। কারণ উল্লিখিত বর্ণনা দ্বারা বুঝা
যায় যে, নাবী ওয়ালীগণ তাদের কবরে জীবিত দুনিয়ার জীবনের মত। আর যার জন্য
তারা সালাম শুনেন এবং উত্তর প্রদান করেন এবং সকলে তা শুনতে পান। এটা কত বড়
ভয়ানক বিশ্বাস যা তাবলীগী নিসাবের মাধ্যমে শাইখ সাহেব দিতে চেয়েছে তার
প্রমাণ নিন :
‘‘বিখ্যাত ছুফী ও বুজুর্গ হজরত শায়েখ আমদ
রেফায়ী (রঃ) ৫৫৫ হিজরী সনে হজ্ব সমাপন করিয়া জেয়ারতের জন্য মদ্বীনায় হাজির
হন। তিনি কবর শরীফের সামনে দাঁড়াইয়া এই দুইটা বয়াত পড়েন-
ِفِيْ حَالَةِ الْبُعْدِ رُوْحِىْ كُنْتُ اُرْسِلُهَا * تُقَبِّلُ الاَ(রাঃ)رْضَ عَنِّي وَهِىَ نَائِبَتِيْ وَهَذِهৃ دَوْلَةً الاَ(রাঃ)شْبَاحِ قَدْ حَضَرَتْ * فَاَمْدُ وَيَمْنِيَكَ كي تَحْظِيَ بِهَا شَفَتِي
‘‘দূরে থাকা অবস্থায় আমি আমার রুহকে
হুজুরের খেদমতে পাঠাইয়া দিতাম; সে আমার নায়েব ইহয়া আস্তানা শরীফে চুম্বন
করিত। আজ আমি সশরীরে দরবারে হাজির হইয়াছি। কাজেই হুজুর আপন হস্ত মোবারক
বাড়াইয়া দিন যেন আমার ঠোঁট তাহা চুম্বন করিয়া তৃপ্তি হাছেল করিতে পারে।’’
বয়াত পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কবর শরীফ হইতে হাত
মোবারক বাহির হইয়া আসে এবং হজরত রেফায়ী (রঃ) তাহা চুম্বন করিয়া ধন্য হন।
বলা হয়, সেই সময় সমজিদে নববীতে নববই হাজার লোকের সমাগম ছিল। সকলেই
বিদ্যুতের মত হাত মোবারকের চমক দেখিতে পায়। তাঁহাদের মধ্যে মাহবূবে ছোবহানী
হজরত আবদুল কাদের জীলানী (রঃ)ও ছিলেন।’’ (ফাজায়েলে হজ্ব- ১৫৮ পৃঃ)
عن ابى هريرة رضى الله قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من صلى على عند قبرى سمعته ومن صلى على نائيا ابلغته
‘‘হুজুরে আকরাম (ছঃ) এরশাদ করেন যে
ব্যক্তি আমার কবরের নিকট দাঁড়াইয়া আমার উপর দরূদ পাঠ করে আমি তাহা শুনিয়া
থাকি আর যে ব্যক্তি দূর হইতে আমার উপর দরূদ পড়িয়া থাকে তাহা আমার নিকট
পৌঁছান হয়।’’ (ফাজায়েলে দরূদ শরীফ-২৫ পৃঃ)
ইবনে জাওযী লিখেছেন, এই হাদীস সহীহ নয়, এর
রাবী মুহাম্মাদ বিন মুরান সিদ্দী সম্বন্ধে ইবনে নুমাইর বলেছন যে, সে
মিথ্যাবাদী এবং নাসাঈ বলেছেন যে, সে পরিত্যাক্ত।(কিতাবুল মাওযুয়াত; ১ম
খন্ড, ৩০৩ পৃষ্ঠা, গৃহীত মওযু যঈফ হাদীসের প্রচলন ১৭ পৃঃ)
অনুরূপ আরো একটি হাদীস ফাজায়েলে হজ্বে শাইখ আবূ হুরাইরা সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
قال رسول الله صلى
الله عليه وسلم من صلى على عند قبرى سمعته ومن صلى على نائبا كفى امكرد
نياه واخرته وكنت له شهيدا وشفيعا يوم القيامة
হুজুর (ছঃ) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আমার
কবরের পাশে দাঁড়াইয়া আমার উপর দরূদ পড়ে, আমি স্বয়ং তাহা শ্রবণ করিয়া থাকি।
আর যে দূর হইতে আমার উপর দরূদ পড়ে, আল্লাহ পাক তাহার দুনিয়া আখেরাতের
যাবতীয় প্রয়োজন মিটাইয়া দেন এবং কেয়ামতের দিন আমি তাহার জন্য সাক্ষী দিব,
তাহার জন্য সুপারিশ করিব (ফাজায়েলে হজ্ব-১২১ পৃঃ)
আল্লামা আলবানী বলেন, হাদীসটি এভাবে জাল।
হাদীসটি সাম‘উন ‘আল-আমালী’ গ্রন্থে (২/১৯৩/২) খতীব বাগদাদী তার
‘‘আত-তারীখ’’ গ্রন্থে (৩/২৯১-২৯২)এর ইবনু আসাকির (১৬/৭০/২) মুহাম্মাদ ইবনু
মারওয়ান সূত্রে আ‘মাশ হতে এবং তিনি আবূ সালেহ হতে বর্ণনা করেছেন। আলবানী
বলেন : মুহাম্মাদ ইবনু তাইমিয়া ‘‘মাজমুয়ায়ে ফাতাওয়া’’ গ্রন্থে বলেছেন
(২৭/২৪১) এ হাদীসটি বানোয়াট, এটি মারওয়ান আ‘মাশ হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি
সকলের ঐক্যমতে মিথ্যুক বলেন মোট কথা যে, অংশটুকুতে বলা হয়েছে যে, সালাম
দিলে তার নিকট পৌঁছে দেয়া হয়, এ অংশটুকু সহীহ, বাকী অংশটুকু সহীহ নয়; বরং
সেগুলো বানোয়াট।
(দেখুন মূল সিলসিলা যঈফা ১ম খন্ড, ২০৩ পৃঃ যঈফ জাল হাদীস সিরিজ ১ম খন্ড, ২২৬ পৃষ্ঠা)
সম্মানিত পাঠক! আমাদের ভাবতে অবাক লাগে
যে, শাইখুল হাদীসের মত এত বড় একজন পন্ডিত ব্যক্তি কি করে রসূল (সাঃ)-এর
নামে জাল হাদীস বর্ণনা করেছেন, অথচ হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন
করা ফরয। আমরা মনে করি যে, নিম্নোক্ত কারণসমূহের ভিত্তিতে হাদীস বর্ণনা
ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা ফরয :
ক) যে কোন বর্ণনার ক্ষেত্রে শারী‘আতের
বিধান হল, বর্ণনার পূর্বে যাচাই করে দেখা, তা বর্ণনা যোগ্য কিনা; হাদীসের
ব্যাপারেটি তো সঙ্গত কারণেই আরো গুরুত্বপূর্ণ।
খ) বর্ণনার ক্ষেত্রে অসর্কতা মিথ্যারোপের
শামিল, যা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের নিকট নিন্দনীয়। আর হাদীসের ব্যাপারে
মিথ্যারোপ করা তো আরো ভয়ঙ্কর, যা বলার অপেক্ষাই রাখে না।
গ) হাদীসের সম্পর্ক দ্বীনের সাথে; বরং এটি
অন্যতম দলীল এবং দ্বীনি বিধানবলীর ভিত্তি। সুতরাং হাদীসের ব্যাপার
অসর্তকতা দ্বীন নিয়ে খেল- তামাশা করার নামান্তর। যার অশুভ পরিণতি কারো
অজানা নয়।
ঘ) হাদীসের সম্পর্ক সরাসরি রসূল (সাঃ)-এর
সাথে তাঁর মর্যাদা সৃষ্টি জীবের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর একথা স্বতঃসিদ্ধ যে, যে
ব্যক্তি যত বড় হন, তাঁর ব্যাপারে মিথ্যারোপ এবং তাঁর বাণী বর্ণনার
ক্ষেত্রে অসতর্কতা ততবড় অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। একথাই হাদীসে এরশাদ হচ্ছে :
ان كذبا على ليس ككذب على احدكم
‘আমার ব্যাপারে মিথ্যারোপ তোমাদের কারো ব্যাপারে মিথ্যারোপের মত নয়’’ (বরং তার ভয়াবহতা সাধারণ মিথ্যারোপ থেকে অনেক বেশী) ।
ঙ) রসূল (সাঃ) যেহেতু দ্বীনি ব্যাপারে
ওয়াহী ছাড়া কোন কথা বলতেন না, তাই কোন কথা হাদীসে নাববী হওয়ার অর্থ এই
দাঁড়ায় যে, এটি তার প্রতি আল্লাহ তা‘আলার ওয়াহী ও পয়গাম। সুতরাং যদি কোন
কথা রসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেন নি; তথাপি তার বরাত দেয়া হয়, তাহলে তার
মাঝে খারাবী ও ক্ষতি শুধু এতটুকুই নয় যে, এটি রসূলের উপর মিথ্যারোপ করা
হচ্ছে; বরং পরোক্ষভাবে আল্লাহ তা‘আলার উপরও মিথ্যারোপ করা হচ্ছে। আর
আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করা কত জঘন্য অপরাধ তা অজানা নয়। এরশাদ হচ্ছে :
{وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَر‘ى عَلى‘ اللهِ كَذِباً أُولَئِكَ يُعْرَضُونَ عَلى‘ رَبِّهِمْ وَيَقُولُ الْأَشْهَادُ هَؤُلاءِ الَّذِينَ كَذَبُوا عَلى‘ رَبِّهِمْ أَلا لَعْنَةُ اللهِ عَلَى الظَّالِمِينَ}
‘‘আর ঐ ব্যক্তিদের চেয়ে বড় যালিম কে যারা
আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে। তাদেরকে তাদের পালনকর্তার সম্মুখীন করা হবে,
আর সাক্ষীগণ বলতে থাকবে, এরাই ঐ লোক যারা আপন পালনকর্তার প্রতি মিথ্যারোপ
করেছিল। সাবধান! যালিমদের উপর আল্লাহর অভিশাপ রয়েছে।’’ (সূরা হুদ- ১৮)
তাবলীগী ভাইয়েরা হয়তো বলতে পারেন যে,
বাজারে বিভিন্ন দ্বীনি গ্রন্থের মধ্যে অগণিত ভুল-ভ্রান্তি থাকা সত্ত্বেও
কেন আমি এই নিসাবের পিছনে লেগেছি, যে কিতাবখানা সারাবিশ্বে কুরআনের মত পড়া
হয় প্রত্যেক মাসজিদে প্রতিদিন। এর দ্বারা কোটি কোটি লোক উপকৃত হচ্ছে। তাদের
নিকট আমার বক্তব্য হল, উপরে উল্লিখিত কারণ আমাকে এই কাজে উদ্বুদ্ধ
করেছে। আমি নিজে যেহেতু তাবলীগী জামা‘আতের সাথে করাচি পাকিস্তান এবং নিজাম
উদ্দিন থেকে জড়িত ছিলাম, কতলোক এপথে এসেছে আমার দাওয়াতে তাদের ভুল
ভাঙ্গানোর জন্য আমার এ লেখা কাফফারা স্বরূপ। আল্লাহ তা‘আলার কাছে প্রার্থনা
আল্লাহ পাক যেন আমার এবং আমার মুসলিম ভাইদের ভুল সংশোধন করে সঠিক পথে চলার
তৌফিক দান করেন। (আমিন)
উল্লেখ্য যে, আম্বিয়াগণ (‘আ.) চিরদিনের
জন্য দুনিয়ায় আসতেন না। তাদেরও মৃত্যু হয়েছে। (শুধু ঈসা (‘আ.) ব্যতীত)
দেখুন : বাকারাহ ১৩৩, আল-ইমরান-১৪৪, আম্বিয়া- ৮-৩৪, শুয়ারা- ৮১, আন‘আম-
১৬২, ইউনূস- ৪৬, রা’দ- ৪০, মারইয়াম- ১৫-৩৩, সাবা- ১৪, যুমার- ৩০, মু’মিন-
৩৪-৭৭। মৃত্যুর পরে শাস্তি ও শান্তি (দরূদ পৌঁছান) সত্য, কিন্তু এগুলোর স্থান হলো, বারযাখ দুনিয়ার কবরে নয়।
দেখুন : আল-ইমরান- ১২৯, আন‘আম- ৯৩, আনফাল- ৫০-৫২, তাওবাহ- ১০১, ইউনূস- ৯২,
নাহাল- ২৮-২৯, ৩২, মু’মিনুন- ৯৯-১০০, ইয়াসিন- ২৬-২৭, মু’মিন- ৪৫-৪৬,
মুহাম্মাদ- ২৭, ওয়াকিয়া- ৮৩-৯৫, তাহরীম- ১০, আফস- ২১।
No comments:
Post a Comment