Monday, November 27, 2017

হাদীস বর্ণনায় শাইখুল হাদীসের খিয়ানাত

হাদীস বর্ণনায় শাইখুল হাদীসের খিয়ানাত


পাঠক! একটু লক্ষ্য করলে আপনারাও বুঝতে সক্ষম হবেন, যিনি হাদীস বর্ণনা করতে আমাদের জন্য সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, তিনি হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে কিভাবে খিয়ানাত করেছেন। তাবলীগী জামা‘আতের মধ্যে এ কথা প্রসিদ্ধ যে, ফাযায়েলের ক্ষেত্রে যঈফ হাদীস চলে। এটা আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। কারণ আমি নিজে তাবলীগী জামা‘আতের সঙ্গে বহু বৎসর কাজ করে পাকিস্তানের রায়বন্ড মারকায থেকে তিন চিল্লা ও সালের
জামা‘আতের সহিত সময় দিয়েছি, বাংলাদেশেও এসেও বহু দিন তাবলীগ জামা‘আতে থেকে আমার অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা হয়েছে তারা শুধু যঈফ হাদীসই বর্ণনা করে না; বরং অনেক ক্ষেত্রে তাদের জাহিল মুবাল্লিগগণ মুরুববীর কথাও হাদীস বলে চালিয়ে দেয়। আর কেনই বা দিবে না তাদের নিসাবের লেখক শাইখুল হাদীস সাহেবতো মওযু বা জাল হাদীসও গোপন করে হাদীস নামে চালিয়ে দিয়েছেন। তার স্বহস্তে লিখিত তাবলীগী নিসাবে তার অনেক প্রমাণ আমাদের নিকট আছে। নিম্নে তার কিঞ্চিৎ বর্ণনা আমরা পাঠকের সামনে তুলে ধরব- ইনশা আল্লাহ। তবে তার পূর্বে ফাযায়েলের ক্ষেত্রে যঈফ হাদীস কতটুকু গ্রহণযোগ্য তা পাঠকদের জেনে রাখা দরকার বলে মনে করছি। পাঠক! পৃথিবী শ্রেষ্ঠ প্রথম সারির নির্ভরযোগ্য হাদীস বিশারদগণ বলেন যে, ফাযীলাতের জন্য হোক আর অন্য কোন বিষয় হোক কোন অবস্থাতেই যঈফ হাদীস ‘আমালযোগ্য নয়। কারণ ফাযীলাতের দোহাই দিয়ে যঈফ হাদীস ‘আমাল করতে গেলে মুসলিম সমাজে ফিতনা-ফাসাদের সৃষ্টি হবে। তাতে উপকারের চেয়ে অপকারের সম্ভাবনা অনেক বেশি। যঈফ হাদীস ‘আমাল করা যাবে না, এ বিষয়ে যে সব হাদীসবিদ, মুহাদ্দিসগণ মতামত পেশ করেছেন তারা হলেন, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম ইয়াহ্ইয়া ইবনু মুঈন, ইমাম ইবনু আরাবী, ইমাম ইবনু হাজম, ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ ও আল্লামা জালালউদ্দিন কাসেমী প্রমুখ হাদীসবিদ ইমামগণ। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় পর্যায়ের একদল ফিকহ্বিদ যারা ফাযীলাতের ক্ষেত্রে যঈফ ‘আমালের অনুমতি দিলেও তারা যঈফ হাদীস ‘আমালের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত শর্তারোপ করেছেন। যেমন- (১) যে সব যঈফ হাদীসের উপর ‘আমাল করা হবে, তা যেন কোন মতেই আক্বীদা বা হুকুম সংক্রান্ত না হয়। যদি তা হয় তাহলে কোন ক্রমে যঈফ হাদীস ‘আমাল করা যাবে না। (২) যদি কেউ নিতান্ত বাধ্য হয়ে যঈফ হাদীস ‘আমাল করতে চায়, তাহলে তাকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে, ঐ ‘আমালটা যেন কোন মতেই দেশ ও সমাজের প্রচলিত সহীহ হাদীসের ‘আমালের বিরোধী না হয়। যদি হয় তাহলে ‘আমাল করা যাবে না। (৩) উক্ত যঈফ হাদীসের সনদ বা সূত্র যেন অত্যন্ত দুর্বল না হয়। (৪) পরিশেষে যঈফ হাদীস ‘আমালকারীকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে, হাদীসটি যঈফ বা সন্দেহযুক্ত। আর অন্যের নিকট বলার সময় তা যঈফ হিসাবেই উল্লেখ করতে হবে। (ইমাম মহিউদ্দিন নাববীর সহীহ মুসলিমে শরাহ তাওজীহুন নজর কাওয়াছিদুত তাহাদীস)
এ প্রসঙ্গে সত্য সন্ধানীদের নিকট আমার প্রশ্ন হলো, বর্তমান তাবলীগী নিসাব প্রচারক মুবাল্লিগ ও মুরুববীগণ যারা ফাযীলাতের দোহাই দিয়ে হরহামেশা, যঈফ হাদীস বর্ণনা করেন, কিংবা যঈফ হাদীসের ‘আমাল ছাড়তে রাযি থাকেন না। তারা কি আদৌ ফিকহ্বিদদের উক্ত চারটি শর্তের তোয়াক্কা করেন? ঐ সমস্ত মুরুববীদেরকে লক্ষ্য করে ইমাম মুসলিম বলেনঃ যঈফ হাদীস বর্ণনা করার সময় যঈফ জানা সত্ত্বেও যারা মানুষের সামনে হাদীসের ত্রুটি তুলে ধরে না, তারা গুনাহ্গার হবে। আর সাধারণ মুসলিমদের নিকট প্রতারক বলে গণ্য হবে। (অথচ শাইখুল হাদীস যঈফ তো দূরের কথা মওযু বানোয়াট হাদীস জেনেশুনে লিখে তরজমা করেননি) কারণ যারা যঈফ হাদীস শুনবে এবং সেগুলোর উপর ‘আমাল করবে অথচ ঐসব হাদীস অধিকাংশ ভিত্তিহীন মিথ্যা বানোয়াট। ইমাম মুসলিম আরো বলেন যে, পৃথিবীতে নির্ভরযোগ্য ও আস্থাশীল বর্ণনাকারীদের বর্ণিত অসংখ্য নির্ভুল সহীহ হাদীসের বিরাট ভান্ডার আমাদের সামনে বিদ্যমান থাকতে কোন ক্রমেই যঈফ হাদীস গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে না। এ সম্পর্কে ইমাম মুসলিম বলেন, আমি মনে করি, যে সব লোক যঈফ হাদীস অখ্যাত সনদে বর্ণনা করেন বা তার উপর গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, তাদের উদ্দেশ্য হল নিজেকে অপরের নিকট অধিক হাদীস বয়ানকারী হিসাবে জাহির করানো বা মানুষের বাহবা কুঁড়ানো। ‘ইল্মে হাদীসের ক্ষেত্রে যারা এ নীতিতে পা বাড়ায় হাদীস শাস্ত্রে তাদের কোন স্থান নেই। বস্তুত এমন ব্যক্তি আলিম ও বক্তা (শাইখুল হাদীস) হিসাবে আখ্যায়িত না হয়ে বরং জাহিল মূর্খ হিসাবে আখ্যায়িত হবার যোগ্য। (সহীহ মুসলিম, মুকাদ্দামা- ১ম খন্ড, ৫০ পৃঃ, ই.ফা.বাং)
এখানে কোন কোন পাঠক হয়তো বলতে চাইবেন যে, যঈফ হাদীস যদি ‘আমালযোগ্যই না হবে তাহলে হাদীসের কিতাবে যঈফ হাদীস লিখা হল কেন? এরূপ প্রশ্নের জওয়াব ইমাম আবূ ঈসা তিরমিযী (রহ.) অত্যন্ত জোরালো ভাষায় দিয়েছেন। তিনি বলেন, মুহাদ্দিসগণ অনেক সময় যঈফ রাবীদের বর্ণিত দুর্বল হাদীসকে সনাক্ত করার জন্য কিতাবে লিপিবদ্ধ করেন। ইমাম ইয়াহ্ইয়া ইবনু মুঈন বলেন, আমি যঈফ ও জাল হাদীস এজন্য লিপিবদ্ধ করি যাতে ভবিষ্যতে এগুলোকে কেউ পরিবর্তন করে সহীহ হাদীস বানাতে না পারে। (শরহু ইলালিত তিরমিযী ৮৪ পৃঃ, জামে তিরমিযী মুখবন্ধ ১ম খন্ড ৬০ পৃঃ, অনুবাদ- আবদুন নূর সালাফী)
সম্মানিত পাঠক! উল্লেখিত দলীল মওজুদ থাকার পরও যে সব মুরুববী ও মুবাল্লিগ বলে থাকেন যে, হাদীস আবার যঈফ হয় নাকি? হাদীসতো হাদীসই তা আবার যঈফ হয় কি করে? আমি বলব, সত্যই বলেছেন হাদীস যঈফ হয় না বটে কিন্তু বর্ণনাকারী যঈফ বা দুর্বল হয় যার কারণে হাদীসটি যঈফ বলা হয় অন্যথা নাবী (সাঃ)’র কোন কথা দুর্বল নয়। এটা আমাদের ঈমান। কেননা আল্লাহ বলেন-
{وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى، إِنْ هُوَ إِلاَّ وَحْيٌ يُوحَى}
‘‘(রসূল) তাঁর ইচ্ছামত কিছুই বলেন না; কেবলমাত্র অতটুকু বলেন, যা তার নিকটে ওয়াহী হিসাবে প্রেরণ করা হয়।’’ (সূরা আন-নাজম ৩-৪)
পরিশেষে বলতে চাই, সহীহ হাদীসের ভান্ডার আপনাদের সামনে কি এতই সীমিত যে, ‘আমালের জন্য আপনারা সহীহ হাদীস খুঁজে পান না? পৃথিবীতে এমন কোন ‘আমালকারী আছেন কি যিনি আক্বীদা ‘আমালে ও আখলাকে পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীস সব নিঃশেষ করে ফেলেছেন? ফলে বাধ্য হয়ে তাবলীগী নিসাব নাম পরিবর্তন করে আরবদের ভয়ে নামকরণ করা হয়েছে ফাযায়েলে আমল। যার মধ্যে যঈফ হাদীসে ভরপুর। বিশ্বাস না হলে খবর নিয়ে দেখুন পৃথিবীর প্রায় অনেকগুলো ভাষায় ফাযায়েলে ‘আমালের অনুবাদ হয়েছে কিন্তু আরবীতে হয়নি, কারণ যঈফ হাদীস আরবরা প্রত্যাখ্যান করে। তাইতো আরবদের জন্য তারা তাবলীগী নিসাব ধার্য করেছেন ইমাম নাববীর ‘রিয়াদুস সালিহীন’। পাঠক মহোদয়, এবার লক্ষ্য করুন, তাবলীগী নিসাবের যঈফ জাল বর্ণনা এবং খিয়ানাত। হানাফী মাযহাবের দেওবন্দি সূফীদের স্বনামধন্য শাইখুল হাদীস মুহাম্মাদ যাকারিয়া (১৮৯৮-১৯৮২ খৃঃ) তার স্বীয় গ্রন্থ ফাজায়েলে আমলের ফাজায়েলে জিকিরে গুনাহ বিধ্বংসকারী কোন দু‘আ কুরআন ও সহীহ হাদীসে না পেয়ে অবশেষে মনের বাসনা পূর্ণ করার মানসে জাল হাদীসের আশ্রয় নিয়েছেন। নিম্নে হাদীসটির অনুবাদ উল্লেখ করা হল :
‘‘হজরত আবু বকর ছিদ্দীক (রাঃ) বিষন্ন অবস্থায় একদিন হুজুরে পাক (ছঃ)-এর খেদমতে হাজির হইলেন। হুজুর (ছঃ) বলিলেন, আপনি বিষন্ন কেন? তিনি আরজ করিলেন, গতরাত্রে আমার চাচাত ভাই ইন্তেকাল করেন। হুজুর (ছঃ) বলেন, তাহাকে কি আপনি কালেমার তালক্বীন করিয়াছিলেন? আরজ করিলেন হ্যাঁ করিয়াছিলাম। হুজুর (ছঃ) বলেন, সে কি কালেমা পড়িয়াছিল? হজরত ছিদ্দীকে আকবর বলেন, পড়িয়াছিল। হুজুর (ছঃ) এরশাদ করেন, জান্নাত তাহার জন্য ওয়াজেব হইয়া গিয়াছে। হজরত আবু বকর ছিদ্দীক (রাঃ) বলেন, হুজুর! জীবিতাবস্থায় এই কালেমা পড়িলে কি লাভ হইবে? হুজুর (ছঃ) দুইবার বলেন, ইহা গোনাহকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করিয়া দেয়।’’ (তাবলীগী নিসাব, ফাজায়েলে জিকির- ৩৭৭ পৃঃ, হাঃ ৩২)
গ্রন্থকার উক্ত হাদীস সম্পর্কে মূল কিতাবে আরবীতে যে মন্তব্য পেশ করেছেন, তা নিম্নরূপ- হামাদান ইতিহাসে দায়লানী এ হাদীসটিকে বর্ণনা করেছেন। রাফিয়ী ইবনু নাজ্জার এমনি মুনতাখাবে এমনিভাবে কানজুল উম্মালে বর্ণনা করেছেন। এমনিভাবে জালালুদ্দ্বীন সুয়ূতী জাইলুল লাআয়ীতে রিওয়ায়াত করেছেন এবং হাদীসের সনদ সম্পর্কে আলোকপাত করে বলেছেন, হাদীসটির সমস্ত সনদই সম্পূর্ণ অন্ধকারাচ্ছন্ন। হাদীসটির সমস্ত রাবীগণই মিথ্যাবাদী। অথচ শায়খ সাহেব বলেন, হাদীসটির ভাবার্থ রিওয়ায়াত মারফু হিসাবে বর্ণিত। তবে সমস্ত মুহাদ্দিসগণ হাদীসটিকে মওযু বা জাল বলেছেন, যেমন জাইলুল লাআয়ীতে জাল হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। গ্রন্থকার নিজের তথ্যের ভিত্তিতে হাদীসটিকে জাল প্রমাণ করেছেন।
তারপর হাদীসের মূল বক্তব্যের প্রতি লক্ষ্য করলেও বুঝা যায় যে, বর্ণনাটি গ্রহণযোগ্য নয়, নাবী (সাঃ) কখনও এমন কথা বলতেন না, যার দরুন লোকেরা অন্যায়ের প্রতি উৎসাহিত হতে পারে। এ বর্ণনার শেষ কথার দ্বারা পাপীরা আরো পাপ করার উৎসাহ পাবে। কারণ এ পাপ যতই হোক কালিমা পাঠ করলেই তো সব গুনাহই ধ্বংস হয়ে যাবে, সমস্যার তো কিছু নেই। শেষ জীবনে বেশি বেশি পরিমাণে কালিমা পড়ে গুনাহ মাফের ব্যবস্থা করা যাবে। সত্যি যদি এমন, হয় তাহলে সমাজের অবস্থা কি হবে? এছাড়া যুক্তির দিক থেকে জনাবের বর্ণিত হাদীসের শেষ বাক্যটা শুধু নও-মুসলিমদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে। কারণ নাবী (সাঃ) বলেছেন, ইসলাম গ্রহণ ব্যক্তির পূর্ববর্তী সকল গুনাহ্কে ধ্বংস করে দেয়। ইসলাম গ্রহণের পূর্বেকার কোন গুনাহের জন্যই আল্লাহ তা‘আলা তাকে পাকড়াও করবেন না। যেমন হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ < থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা জিজ্ঞেস করলাম, যে আল্লাহর রাসূল আমরা জাহিলী যুগে যে সমস্ত (অন্যায়) কাজ করেছি সেজন্য কি পাকড়াও হবো? তিনি বলেন যে ব্যক্তি একনিষ্ঠভাবে ইসলাম গ্রহণ করার পর সৎকাজ করেছে তাকে জাহিলী যুগের কাজের জন্য পাকড়াও করা হবে না। কিন্তু যে ব্যক্তি (কপট মনে) ইসলাম গ্রহণ করার পর অসৎ কর্মে লিপ্ত হয়েছে তাকে আগের এবং পরের সব অন্যায় কাজের জন্য পাকড়াও করা হবে। (সহীহ মুসলিম প্রথম খন্ড, ২১০ পৃ: হা ; ২২৭)
খালিদ ইবনু ওয়ালিদ ইসলাম গ্রহণ করার পর বলেন, আমি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করার সময় বলেছিলাম, আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করে যত পাপ আমি অতীতে করেছি, তা ক্ষমার জন্য দু‘আ করুন। উত্তরে রসূল (সাঃ) বলেছিলেন, ইসলাম অতীতের সকল গুনাহের খাতা নিশ্চিহ্ন করে দেয়। কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর কোন মুসলিম শারী‘আতের হুকুম আহকামের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন পূর্বক পাপ ও অন্যায় কাজ অব্যাহত রেখে মাঝে মধ্যে শুধু ‘লা- ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ মন্ত্রের মত জপ করে সকল গুনাহ ধ্বংস করে তাওবাহ ব্যতীতই জান্নাতে চলে যাবে, তা কি করে সম্ভব? জান্নাত তো কারো মামা বাড়ীর বারান্দা নয় যে, তা ওয়ারিশী সূত্রে লাভ করা যাবে। গুনাহগার কোন মুসলিমের পাপরাশি ধ্বংসের জন্য তাওবার কোন বিকল্প নেই। কালিমার জপ নয় বরং তাওবাই পারে কোন মুসলিমের পাপরাশি ধ্বংস করে দিতে। মুসলিম ভ্রাতাগণ ভেবে দেখুন! উপরে বর্ণিত শায়খুল হাদীসের সতর্কবাণী এবং ইমাম মুসলিম সহ অন্যান্য মুহাদ্দিসীনে কেরামের বক্তব্য কি খোদ শাইখুল হাদীসের উপর বর্তায় না? আল্লাহ তা‘আলা সকল মুসলিম ভাইকে যেন জাল হাদীসের খপ্পর এবং তার পরিণতি থেকে হিফাযাত করেন।
অতঃপর শাইখুল হাদীস সাহেব লিখেছেন, হানাফী মাযহাবের অধিকাংশ মাসায়েল ‘আবদুল্লাহ বিন মাস‘ঊদ (রাযি.)-এর রিওয়ায়াত হতে সংগৃহীত। বিষয়টি বুঝতে হলে মাযহাব কি সে বিষয়টা জানা দরকার। এই বিষয়টা বিস্তারিত লিখতে গেলে বইয়ের কলেবর বৃদ্ধি পাবে। তাই পাঠকের নিকট এ বান্দার লেখা ‘মাযহাবের স্বরূপ’ বইটি পড়ার অনুরোধ রইল। তাছাড়া কিঞ্চিৎ হলেও এখানে মাযহাবের বিষয় ইঙ্গিত দেয়া হল। মাযহাব শব্দের অর্থ- বিশ্বাস, চলার পথ, মূলনীতি (মিসবাহুল লুগাত ২৬৮ পৃঃ, আল মুনজিদ আরবী, উর্দু- ৪১৮ পৃঃ) দ্বীন- আইন (লুগাতে কেশআরি ৪৪৮ পৃঃ) ধর্ম, বিশ্বাস অভিমত, দল (ফিরুযুল লুগাত ১০৬৮ পৃঃ) এক নজরে মাযহাবের শব্দগত অর্থ হল :
(১) মানুষের অভিমত, (২) বিশ্বাস, (৩) চলার পথ, (৪) মূলনীতি, (৫) আইন-কানুন, (৬) দল ও (৭) ধর্ম।
হাদীসসেও মাযহাব শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। হাদীসে মাযহাব শব্দটা পায়খানার অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। (আবূ দাউদ ১ম খন্ড, হাঃ ১; তিরমিযী ১ম খন্ড, হাঃ ২১, ই.ফা.বাং)
মুসলিম যিনি তার মাযহাব ইসলাম, তার মাযহাবী বিশ্বাস ইসলাম, তার মাযহাবের মূলনীতি ইসলাম, তার আইন-কানুন মাযহাব- ইসলাম, তার দল মুসলিমীন। আর এই মাযহাবে ইসলাম ১০০% পরিপূর্ণ। উল্লিখিত বক্তব্যের পক্ষে দলীল দেখুন- আলু ইমরান ১৯, ৮৩, ৮৫; মায়িদাহ ৩, আ’রাফ ৩, আশ্ শূরা ১৩ এবং সূরা হাজ্জ শেষ আয়াত।
যারা মাযহাব অর্থ অভিমত ও দল গ্রহণ করেছেন ওয়াহীর মানদন্ডে তা সঠিক নয়। কারণ যারা মাযহাব অর্থ অভিমত মেনে চলে, মুসলিমদের সঙ্গে তাদের ঈমানের পার্থক্য প্রচুর। তন্মধ্যে একটি হল তারা কুরআন ও হাদীসকে পরিপূর্ণ দ্বীন বলে বিশ্বাস করে না। অথচ মহান আল্লাহ বলেন :
{الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الأِ<سْلامَ دِيناً}
‘‘আজ আমি তোমাদের দ্বীন (জীবন বিধান) পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং আমার দ্বীনের অবদান সমাপ্ত করলাম।’  (সূরা মায়িদাহ ৩)
যারা সত্যিকার মুসলিম তারা বিশ্বাস করেন দ্বীন পরিপূর্ণ ও সমাপ্ত। আর কথিত মাযহাবীগণ বিশ্বাস করে, অনেক সমস্যার সমাধান কুরআনে নেই, সহীহ হাদীসে নেই। তার সমাধান হল মাযহাব, অর্থাৎ ইমামগণের অভিমত। প্রকৃত মুসলিমগণ বিশ্বাস করেন যে, দ্বীনের ব্যাপারে সব কথাই কুরআন ও সহীহ হাদীসে আছে। দ্বীনের ক্ষেত্রে কুরআন হাদীসে কিছুই বাদ যায়নি। মহান আল্লাহ বলেন :
{وَلاَ يَأْتُونَكَ بِمَثَلٍ إِلاَّ جِئْنَاكَ بِالْحَقِّ وَأَحْسَنَ تَفْسِيراً}
‘‘তারা তোমার নিকট এমন কোন সমস্যা উপস্থিত করে না, যার সঠিক সমাধান ও সুন্দর ব্যাখ্যা আমি তোমাকে দান করি নি।’’ (সূরা আল-ফুরক্বান ৩৩)
এ আয়াতে স্পষ্ট হল দ্বীনের ব্যাপারে যাবতীয় বিষয় আল্লাহ রসূলের নিকট কুরআন অথবা হাদীস আকারে অবতীর্ণ করেছেন। যারা মাযহাবী তাদের বিশ্বাস সূরা মায়িদার ৩ নং আয়াত ও সূরা ফুরক্বানের ৩৩ নং আয়াতে আল্লাহ যা বলেছেন তা সত্য নয়। কারণ বহু সমস্যার সমাধান কুরআনে নেই, হাদীসেও নেই। তার সমাধান দিয়েছে কথিত মাযহাব। আর বিশ্ব মুসলিম এ কথায় বিশ্বাস করেন আল্লাহ যা বলেছেন, তা সত্য। দ্বীনের সব কিছুর সমাধান কুরআন ও সুন্নাহতে বর্তমান। মাযহাব কোন সমাধান নয়, বরং মাযহাব কেবলমাত্র মতবিরোধ, সংঘাত ও সংঘর্ষ সৃষ্টি করে, জন্ম দেয় পারস্পারিক হিংসা-হানাহানির।
পাঠক এবার লক্ষ্য করুন, শায়খ সাহেব- ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাযি.)-এর কথা লিখেছেন, তার দোহাই দিয়েই সলাতের এক বড় সুন্নাত রফ‘উল ইয়াদাঈন যা সমস্ত হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে এবং রসূল (সাঃ) আজীবন সলাতে রফ‘উল ইয়াদাঈন বা হাত উত্তোলন করেছেন। নিম্নের হাদীস তার জ্বলন্ত প্রমাণ :
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا قَامَ فِي الصَّلاَةِ رَفَعَ يَدَيْهِ حَتَّى يَكُونَا حَذْوَ مَنْكِبَيْهِ وَكَانَ يَفْعَلُ ذلِكَ حِينَ يُكَبِّرُ لِلرُّكُوعِ وَيَفْعَلُ ذلِكَ إِذَا رَفَعَ رَأْسَهُ مِنْ الرُّكُوعِ رواية أيضا وإذا قام من الركعتين رفع يديه  (رواه البخاري)
‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাযি.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূল (সাঃ)-কে দেখেছি তিনি যখন সলাতের জন্য দাঁড়াতেন তখন উভয় হাত কাঁধ বরাবর উঠাতেন এবং যখন রুকূর জন্য তাকবীর বলতেন তখনও এরূপ করতেন এবং যখন রুকূ হতে মাথা উঠাতেন তখনও এরূপ করতেন। ইমাম বুখারী এটা বর্ণনা করেছেন। তাঁর অপর বর্ণনায় এটাও আছে যে, যখন তিনি (রসূল (সাঃ) দ্বিতীয় রাক‘আত হতে তৃতীয় রাক‘আতের জন্য দাঁড়াতেন তখনও দুই হাত (কাঁধ বরাবর) উঠাতেন। দেখুনঃ বুখারী ১ম খন্ড ১০২ পৃঃ; মুসলিম ১০৬ পৃঃ; আবূ দাউদ ১ম খন্ড, ১০৪-১০৫ পৃঃ; তিরমিযী ১ম খন্ড, ৫৯ পৃঃ; নাসাঈ ১৪১, ১৫৮, ১৬২ পৃঃ; ইবনু খুযাইমাহ ৯৫-৯৬ পৃঃ; মিশকাত ৩৭৫ পৃঃ; ইবনু মাজাহ ১৬৩ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ১ম খন্ড, ১৩৭, ১৩৮, ১৫০ পৃঃ; হিদায়া দিয়ারাহ ১১৩, ১১৫ পৃঃ; কিমিয়ায়ে সাআদাত ১ম খন্ড, ১৯০ পৃঃ; বঙ্গানুবাদ বুখারী- আধুনিক প্রকাশনী ১ম খন্ড, হাঃ ৬৯২, ৬৯৩, ৬৯৫; আজীজুল হক- বুখারী, ১ম খন্ড, হাঃ ৪৩২, ৪৩৪; বুখারী- ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক অনূদিত, ১ম খন্ড, হাঃ ৬৯৭, ৭০১ অনুচ্ছেদ সহ; বুখারী- তাওহীদ পাবলিকেশন্স, ১ম খন্ড, ৩৩৮ পৃঃ; মুসলিম- ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২য় খন্ড, হাঃ ৭৪৫-৭৫০। আবূ দাউদ- ই.ফা.বাং ১ম খন্ড, হাঃ ৮৪২, ৮৪৪; তিরমিযী- ই.ফা.বাং ২য় খন্ড, হাঃ ২২৫, মিশকাত- নূর মুহাম্মাদ আজমী ও মাদ্রাসার পাঠ্য, ২য় খন্ড, হাঃ ৭৩৮, ৭৩৯,, ৭৪১, ৭৪৫; বুলূগুল মারাম ৮১ পৃঃ; ইসলামিয়াত বি.এ. হাদীস পর্ব ১২৬-১২৯ পৃঃ।
অথচ যারা আমাদের দেশে অথবা বিদেশে তাবলীগ করেন, ঐ সমস্ত মুবাল্লিগগণ বয়ানের মধ্যে বলে থাকেন, তাদের কথিত ৬ নম্বরের ২ নম্বরে আল্লাহর রসূল যেভাবে সহাবাগণকে সলাত শিক্ষা দিয়েছেন আমাদের সলাতও অনুরূপ হতে হবে। কিন্তু তারা মাযহাবের দোহাই দিয়ে উল্লিখিত সহীহ হাদীস বর্জন করে থাকেন। তারা ইসলামের তাবলীগ করে না; বরং সারা বিশ্বে ভুয়া মাযহাব প্রচার করতে চায়। অথচ মহান আল্লাহ তার মাসূম নাবীকে শুধুমাত্র ওয়াহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত দ্বীন ইসলামের তাবলীগ করার নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন :
{يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ اللهَ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ}
 ‘‘হে রসূল! আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে, তা পৌঁছে দিন (অর্থাৎ শুধু তারই তাবলীগ করুন) আপনি যদি এরূপ না করেন, তবে আপনি তাঁর রিসালাত পৌঁছালেন না। আল্লাহ আপনাকে মানুষের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ অস্বীকারকারী সম্প্রদায়কে সঠিক পথ দেখান না।’’ (সূরা মায়িদাহ ৬৭; এছাড়া দেখুন- সূরা কাসাস ৮৭, আহযাব ৪৫, ইউসুফ ১০৮)
আলোচ্য আয়াতগুলির দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, শুধুমাত্র ওয়াহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত দ্বীন ইসলামের তাবলীগ করার জন্য আল্লাহ তাঁর রসূল (সাঃ)-কে নির্দেশ করেছেন। সাথে সাথে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন যে, আপনি আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ ওয়াহীর বিধি-বিধান না পৌঁছালে তাঁর পক্ষ থেকে অর্পিত দায়িত্ব পালন করলেন না।
পাঠক! এখন একটু ভাবুন, প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত মাযহাবের দোহাই এবং ইবনু মাস‘ঊদের দোহাই দিয়ে সলাতে বুকে হাত বাঁধে না এবং রাফউল ইয়াদাঈন করে না। অথচ রাফউল ইয়াদাঈন সম্পর্কে সহাবী ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদের হাদীস উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয় রফউল ইয়াদাঈন করা যাবে না। কিন্তু মুহাদ্দিসীনে কিরামের নিকট এ কথাটি প্রসিদ্ধ যে, তাঁর শেষ বয়সে বার্ধক্যজনিত কারণে স্মৃতিভ্রম ঘটে, ফলে হতে পারে এ হাদীসটিও সে সবের অন্তর্ভুক্ত। কারণ তিনি কয়েকটি বিষযে সকল সহাবাগণের বিপরীতে কথা বলেছেন। যেমন- (১) মুআযাবিবায়াতাইন- সূরা নাস ও ফালাক্ব সূরাদ্বয়কে কুরআনের অংশ মনে করতেন না। (২) তাত্বীক- রুকূতে তাত্বীক বা দু’হাতকে জোড় করে হাঁটু দ্বারা চেপে রাখতে বলতেন।  (৩) দু’জন সলাতে দাঁড়ালে কিভাবে দাঁড়াবে। (৪) আরাফার ময়দানে কিভাবে তিনি (সাঃ) দু’ওয়াক্তের সলাত একসাথে আদায় করেছেন। (৫) হাত বিছিয়ে সাজদাহ করা। (৬) وما خلق الذكر ولانثى কিভাবে পড়েছেন। (৭) রাফউল ইয়াদাঈন একবার করেছেন। [নাসবুর রাইয়াহ ইমাম যাইলায়ী ৩৯৭-৪০১ পৃঃ, ফিকহুস সুন্নাহ ১/১৩৪; গৃহীতঃ বুখারী- তাওহীদ পাবলিকেশন্স, ৩৪১ পৃঃ]

No comments:

Post a Comment

সাম্প্রতিক পোষ্ট

"যারা facebook চালায় তারা কখনই ভাল মুসলিম হতে পারে না" "FB তো ইহুদীর আবিষ্কার"?

"যারা facebook চালায় তারা কখনই ভাল মুসলিম হতে পারে না" "FB তো ইহুদীর আবিষ্কার" . "আপনি এত ইসলাম মানেন তাহলে f...

জনপ্রিয় পোষ্ট সমুহ