প্রচলিত তাবলীগের তা‘লীম ‘ওয়াহীর’র নয় থানবী’র আর- তরীকা নাবী (সাঃ)’র নয় জামা‘আতের প্রতিষ্ঠাতার
‘‘একবার
তিনি বলেন- হজরত থানবী (রহ.) বহুত বড় কাজ করিয়া গিয়াছেন, আমার অন্তর চায়
তালীম হইবে তাঁহার আর তাবলীগের তরীকা হইবে আমার। এইভাবে তাঁহার তা’লীম যেন
সাধারণ্যে ছড়াইয়া পড়ে। (মালফুজাত-ইলিয়াস, মালফুজাত নং ৫৬ পৃঃ ৩৩, তাবলীগী
কুতুবখানা, চকবাজার, ঢাকা।)
উল্লিখিত বাণী দ্বারা প্রমাণিত হয় যে,
তাবলীগ জামা‘আতের প্রতিষ্ঠাতার মনের বাসনা ছিল যে, তা’লীম হবে থানবীর
অর্থাৎ থানবীর তা’লীমের তাবলীগ এবং
তাবলীগের তরীকা হবে প্রতিষ্ঠাতার নিজের।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তার এ বাসনা পূরণ হয় নি। কারণ তা’লীম চালু
হয়েছে শাইখুল হাদীসের রচনার, যা বাধ্যতামূলক, আর থানবীর রচনাবলী থেকে গেছে
ঐচ্ছিক বা ইচ্ছাধীন (Optional)। কারণ তার মধ্যে মাসায়েল বেশি ফাযায়েল কম আর
তাবলীগ জামা‘আতের প্রতিষ্ঠাতার নির্দেশ ছিল তাবলীগের ক্ষেত্রে মাসায়েলের
পরিবর্তে ফাযায়েলের গুরুত্ব বেশি দেয়ার জন্য। সেজন্য সম্ভবতঃ শাইখুল
হাদীসের ফাযায়েলের গ্রন্থগুলো প্রাধান্য পেয়েছে। আর তারীকা বা পদ্ধতিতো
প্রতিষ্ঠাতার চালু আছে। যাই হোক, এটা আমাদের উদ্দেশ্য নয়, আমরা দেখব
জামা‘আত জনকের উল্লিখিত বাসনা কুরআন-সুন্নাহর আলোকে কতটুকু যুক্তিযুক্ত।
সম্মাণিত মুসলিম ভাই ও ভগ্নিরা! লক্ষ্য
করুন, আল্লাহ তাঁর রসূলকেও তাবলীগ করার জন্য প্রেরণ করেছিলেন, তিনি কিসের
তা’লীম প্রচার করেছিলেন- তা আমরা এখন একটু যাচাই করে দেখব।
মহান আল্লাহ তাঁর রসূল (সাঃ)-কে লক্ষ্য করে বলেন :
{وَأَنْزَلَ اللهُ عَلَيْكَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَعَلَّمَكَ مَا لَمْ تَكُنْ تَعْلَمُ}
‘‘আর আল্লাহ তা‘আলা আপনার উপর কিতাব এবং হিকমাত নাযিল করেছেন এবং আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন যা আপনি জানতেন না।’’ (সূরা আন-নিসা ১১৩)
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :
{هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الأُ(রাঃ)مِّيِّينَ رَسُولاً مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلالٍ مُبِينٍ}
‘‘তিনি নিরক্ষরদের মাঝে তাদের মধ্য হতে
রসূল প্রেরণ করেছেন, তিনি তাদের নিকট আল্লাহ আয়াত তিলাওয়াত করে, তাদেরকে
পরিশদ্ধ করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেন যদিও তারা ইতিপূর্বে
স্পষ্ট গোমরাহীর মধ্যে ছিল।’’ (সূরা আল-জুমু‘আহ ২)
এছাড়া একই বিষয়ে দেখুন- সূরা আল-বাক্বারাহ ১২৯, সূরা আল-আহযাব ৩৪।
উপরিউক্ত আয়াতগুলোতে কিতাব বলে কুরআন,
হিকমাত বলে সুন্নাত বুঝানো হয়েছে। এটা স্পষ্ট যে, এসব আয়াতে সুন্নাতকে
কুরআন হতে আলাদা জিনিস বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআন এবং সুন্নাত দু’টি
আলাদা জিনিস। এ পার্থক্য বর্ণনা করে স্বয়ং রসূল (সাঃ) হতে হাদীস উল্লেখ
রয়েছে। মুয়াত্তা মালিকে বর্ণিত রসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন,
تركت فيكم أمرين لن تضلوا ماتمسكتم بهما كتاب الله وسنة رسوله
‘‘তোমাদের মাঝে এমন দু’টি জিনিস ছেড়ে
গেলাম, যা তোমরা অাঁকড়ে ধরলে কক্ষনো পথভ্রষ্ট হবে না, তা হচ্ছে আল্লাহর
কিতাব এবং তাঁর নাবীর সুন্নাত। (মুয়াত্তা মালিক, মিশকাত হাঃ ১৮৬ সদন হাসান)
উল্লিখিত আয়াতে হিকমাহ অর্থ হাদীস যে সম্পর্কে মুফাসসিরগণ একমত যেমন মুফতী মুহাম্মাদ শা’ফী হানাফী (রহ.) বলেন :
{يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ}
এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলার নিয়ামাত বর্ণনা
প্রসঙ্গে রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর তিনটি গুণ উল্লেখ করা হয়েছে। ১. কুরআনের আয়াত
তিলাওয়াত, ২. উম্মাতকে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ সকল প্রকার অপবিত্রতা থেকে
পবিত্র করা, ৩. কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয়া।
উল্লিখিত তিনটি বিষয়ই উম্মাতের জন্যে যেমন
আল্লাহর নিয়ামাত। তেমনি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে প্রেরণ করার উদ্দেশ্যও এর
অন্তর্ভুক্ত।.......তৃতীয় উদ্দেশ্য {وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ} ‘কিতাব’
বলে কুরআন এবং হিকমাত’ বলে রসূলুল্লাহ (সাঃ) থেকে বর্ণিত উক্তিগত ও কর্মগত
শিক্ষাসমূহ বুঝানো হয়েছে। তাই অনেক তাফসীরকারক এখানে হিকমাতের তাফসীর
করেছেন ‘সুন্নাহ’। (তাফসীরে মা‘আরেফুল কুরআন- ১৩৬৯ পৃষ্ঠা)
পাঠক মহোদয়! এ আলোচনা দ্বারা আমরা বুঝতে
পারলাম আল্লাহ তাঁর নাবীকে দু’টি বিষয়ের তা’লীম করার নির্দেশ দিয়েছেন। একটি
আল্লাহর কিতাব আল-কুরআন ও অপরটি রসূলের সুন্নাত বা হাদীস। আর উভয়টি
‘ওয়াহী’ একটি হল ওয়াহী মাতলু অর্থাৎ যা তিলাওয়াত করা হয়; অপরটি গাইরি মাতলু
অর্থাৎ যা তিলাওয়াত করা হয় না। কিন্তু উভয়টি ‘ওয়াহী’। তাহলে বুঝা গেল
আল্লাহ তাঁর নাবীকে ‘ওয়াহী’র (তাবলীগ) তা’লীম করার জন্য নির্দেশ করেছেন। আর
এই ‘ওয়াহী’ কুরআন ও সহীহ হাদীস, তাই দা‘ওয়াত ও তাবলীগের কাজ পরিচালনা করতে
হবে পবিত্র কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ অনুযায়ী। মহান আল্লাহ বলেন :
{إِنْ أَتَّبِعُ إِلاَّ مَا يُوحَى إِلَيَّ إِنِّي أَخَافُ إِنْ عَصَيْتُ رَبِّي عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ}
‘‘আমি (মুহাম্মাদ (সাঃ) আমার উপর যা
‘ওয়াহী’ অবতীর্ণ হয়, তারই অনুসরণ করি। যদি আমি আমার প্রতিপালকের নাফরমানী
করি, তাহলে ক্বিয়ামাতের কঠিন শাস্তির ভয় কির।’’ (সূরা ইউনুস- ১৫)
আলোচ্য আয়াতদৃষ্টে প্রমাণিত হয় যে, রসূল
(সাঃ) ‘ওয়াহী’র তা’লীম করার মাধ্যমে তাবলীগী কাজ আঞ্জাম দিতেন এবং আল্লাহর
শাস্তির ভয় করতেন। আল্লাহ বলেন :
{مَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى * إِنْ هُوَ إِلاَّ وَحْيٌ يُوحَى}
‘‘তিনি (মুহাম্মাদ (সাঃ) নিজের পক্ষ থেকে মনগড়া কিছুই বলে না, যা ওয়াহী অবতীর্ণ হয়, তাই বলেন। (সূরা আন-নাজম ৩-৪)
সুপিয় পাঠক! লক্ষ্য করুন, রসূল (সাঃ) তো
ওয়াহী ছাড়া অন্য কিছুর তা’লীম করেন নি এবং এ ব্যাপারে ‘ওয়াহী’ বহির্ভূত
হওয়ার জন্য আল্লাহর শাস্তির ভয় করতেন। তাহলে এখন লক্ষ্য করুন, তাবলীগ
প্রতিষ্ঠাতা তার মনের যে বাসনা চরিতার্থ করতে চেয়েছেন যে, তা’লীম হবে
‘থানবীর’। পাঠক হয়তো ভাবতে পারেন, তিনি যেহেতু বড় আলিম ছিলেন এবং তার লেখা
গ্রন্থগুলো ‘ওয়াহী’ ভিত্তিক হবে, তাই তিনি এ কথা বলেছেন। আমরা বলতে চাই,
থানবীর তা’লীমও সকল পর্যায় ‘ওয়াহী’ ভিত্তিক নয়, যেমন তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ
যার সাথে ভারত বর্ষে প্রায় সকল মুসলিম পরিচিত গ্রন্থটির নাম ‘বেহেশতী
জেওর’। তার তো ভূমিকাতেই আমরা শিরকী আক্বীদা দেখতে পাই। পাঠকের অবগতির জন্য
সামান্য কিছু তুলে ধরা হল :
No comments:
Post a Comment