কাশ্ফের পরিচয়
অদৃশ্য
জগতের কোন কথা প্রকাশিত হওয়াকে কাশ্ফ বলা হয়। এ কাশ্ফ কখনও সঠিক হয় আবার
কখনও মিথ্যা হয়, তাই এটি শারী‘আতের কোন দলীল তো নয়ই উপরন্তু একে শারী‘আতের
কষ্টিপাথরে যাচাই করা যরূরী। এমনিভাবে কাশ্ফ কোন ইচ্ছাধীন কোন কিছু নয় যে,
তা অর্জন করা শারী‘আতের কাম্য হবে অথবা সওয়াবের কাজ হবে। অনুরূপ
কাশ্ফ
হওয়ার জন্য বুযুর্গ হওয়াও শর্ত নয়। কাশ্ফ তো ইবনুস সায়্যাদের মত
দাজ্জালেরওহত (মিথ্যা নবুয়াতের দাবীদার গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীরও হত) সুতরাং
কাশ্ফ আল্লাহ্ওয়ালা হওয়ার দলীল হতে পারে না।
(মাওকিফুল ইসলাম মিনাল ইলহাম ওয়াল কাশফি
ওয়াররূইয়া ১১-১১৪, রূহুলমাআনি ১৬/১৭-১৯, শরীয়াত ও তরীকত কা তালাযুম
১৯১-১৯২, শরীয়ত ও তরীকত ৪১৬-৪১৮, আত কাশশুফ আন মুহিম্মাতিত তাসাওউফ
৩৭৫-৪১৯- গৃহীত প্রচলিত জাল হাদীস ৫৯)
এ সম্পর্কে মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রহ.) তার
মাকতুবাতে বলেন : অনুরূফ কাশ্ফ ও ইলহামকে কিতাব ও সুন্নাহর মানদন্ডের
যাচাইয়ের পূর্ব পর্যন্ত অর্ধ যব তুল্য হওয়াও পছন্দ করি না। (ইরশাদাতে
মুজাদ্দিদে আলফেসানী ১২৪, মাকতুব ২০৭। গৃহীত প্রাগুক্ত পৃঃ ৬০)
সূফীকুল শিরোমনি শায়খ সারী সাকতী (রহ.) [মৃত ২৫৩ হিঃ] বলেন :
من ادعى باطن علم ينقصه طاهر حكم فهو غالط
যে ব্যক্তি এমন বাতেনি ‘ইল্মের অর্থাৎ
(কাশ্ফ ইলহাম) দাবী করে থাকে, যাহিরী শারী‘আত প্রত্যাখ্যান করে, সে ব্যক্তি
ভ্রান্তির শিকার। (রুহুলমানি ১৬/১৯)
এই হল শারী‘আতে স্বপ্ন কাশ্ফ ও ইলহামের
অবস্থান। যদি এটি ভালভাবে বোধগম্য হয়ে থাকে, তাহলে কোন দ্বীনী ব্যাপারে
বিশেষত হাদীসের সহীহ যঈফ নির্ণয়ের মত মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কেউ এগুলো
প্রমাণ হিসাবে পেশ করার কথা কল্পনাই করতে পারবে না। তাছাড়া এ ব্যাপারে সকল
ইমামগণ ঐক্যমত যে, হাদীস জানার জন্য হাদীস গ্রন্থের শরণাপন্ন হওয়া জরুরী
এবং হাদীস যাচাইয়ের জন্য হাদীস বিশেষজ্ঞদের কাছে যাওয়া অপরিহার্য। এ
সম্পর্কে কাশ্ফওয়ালা বুযুর্গের কাশ্ফভিত্তিক রায় ধর্তব্য নয়। এ কথা
সুস্পষ্ট যে, হাদীসের সহীহ যঈফ তথা মান নির্ণয়ের ভিত্তি যদি স্বপ্ন, কাশ্ফ
বা ইলহাম হত, তাহলে উসূলে হাদীস সংক্রান্ত ‘ইল্মের কোন প্রয়োজন ছিল না।
প্রয়োজন ছিল না রিজালশাস্ত্রের জ্ঞানের এবং জাল, দুর্বল ও মাতরূক রিওয়ায়াত
সম্পর্কিত শাস্ত্রসমূহের। স্বর্ণযুগ থেকে এ পর্যন্ত উক্ত বিষয়গুলোর উপর শত
শত নয় হাজারো গ্রন্থ রচিত হয়েছে। যা মুসলিমদের নিকট উৎস হিসাবে সমাদৃত। যদি
এর ভিত্তি কাশ্ফ বা ইলহাম হত, তাহলে হাদীস যাচাই বাছাই ও শুদ্ধতা নির্ণয়ের
কাজ মুজতাহিদ্বীন ও মুহাদ্দিসীনের পরিবর্তে সূফীদের হাতে ন্যস্ত হত এবং এ
ব্যাপারে একেজনের একেক রায় থাকত। প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্বপ্ন, কাশ্ফ বা
ইলহামের ভিত্তিতে ফায়সালা করত। বলাবাহুল্য যদি ব্যাপারটি এমনই হত তাহলে এর
চেয়ে বলগাহীনতা আর কিছুই হত না! কিংবা দ্বীনের উৎসসমূহ নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা
করার ক্ষেত্রে এর চেয়ে নিকৃষ্ট পদ্ধতি আর কিছুই হত না।
সূফী মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ (রহ.) ‘ফাতহুল আলিয়্যিল মালিক’-এ তার শায়খ আবূ ইয়াহ্ইয়া (রহ.) থেকে বর্ণনা করেন :
من المعلوم لكل
احد ان الاحاديث لا تثبت الا بالاسانيد لا ينحو الكشف وانوار القلب ولو لا
ية والكرامات لا دخل لها هنا انما المرجع للحفاظ العارفين بهذا الشان
‘‘এ কথা সর্বজনবিদিত যে, হাদীস সনদের
মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়, বাতিনী নূর ইত্যাদির মাধ্যমে নয়। এক্ষেত্রে বুযুর্গী
বা কারামতের সামান্যতম দখল নেই। বরং এ শাস্ত্রে পারদর্শী বিশেষজ্ঞগণ এর
একমাত্র উৎস।’’ (ফাতহুল আলিয়্যিল মালিক ১/৪৫, আলমামনু ফী মারেফাতিল হাদীসিল
মাওযু ২১৬ টীকা দ্রঃ গৃহীত প্রাগুক্ত ৬৬ পৃঃ)
কাশ্ফের মাধ্যমে হাদীস যাচাই প্রসঙ্গে
প্রখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ রুহুলমানি এর প্রণেতা আল্লামা আলুসী (রহ.) একটি
হাদীসের মান যাচাই সম্পর্কে বলেন :
قال : ابن تيمية : إنه
ليس من كلام النبى صلى الله عليه وسلم ولا يعرف له سند صحيح ولا ضعيف وكذا
قال الزركشى والحافظ ابن حجر وغيرهما ومن يرويه من الصوفية معترف بعدم
ثبوته نقلا لكن يقول : إنه ثابت كشفأ....... والتصحيح الكشفى شنشة لهم
অর্থাৎ ‘‘ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রহ.) বলেছেন
যে, এটি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হাদীস নয়। সহীহ কিংবা যঈফ কোন প্রকার সূত্রই
এর নেই। আল্লামা যারকাশী, হাফিয ইবনু হাজার (রহ.) এবং অন্যরাও অনুরূপ মত
ব্যক্ত করেছেন। আর সূফীদের যারা এটি বর্ণনা করে থাকেন তারা এ কথা স্বীকার
করেন যে, এটি সনদের মাধ্যমে প্রমাণিত নয়, তবে কাশ্ফের মাধ্যমে প্রাপ্ত
বাণী। আর তাসহীহে কাশ্ফী তথা কাশ্ফের মাধ্যমে হাদীসের মান যাচাই প্রক্রিয়া
সূফীদের চিরাচরিত খাসলত।’’ (তাফসীরে রুহুল মাআনি ২৭/২১-২২। গৃহীত প্রচলিত
জাল হাদীস ৮১-৮২)
সম্মানিত মুসলিম ভ্রাতৃমন্ডলী হাদীস
বর্ণনায় সূফীদের সম্পর্কে নিশ্চয়ই কিছুটা অবগত হয়েছেন। শায়খ সাহেবের বর্ণনা
কতটুকু সত্য আপনারা ভেবে দেখুন এবং তাবলীগী জামা‘আতের বাণী মৌঃ ইলিয়াসও
সূফী ছিলেন। আর সূফীদের তত্ত্ব দিয়েই তাবলীগী নিসাবটি ভরপুর, এবার বুঝুন
নিসাব গ্রন্থের মান শারী‘আতে কোন পর্যায়ের। আরো শুনুন শাইখ তার ফাজায়েলে
দরূদে লিখেছেন :
‘‘আমার একজন বিশ্বস্ত বন্ধু আমার নিকট
লাখনোর একজন বিখ্যাত কাতেবের ঘটনা বর্ণনা করেন যে, তার অভ্যাস ছিল প্রতি
দিন সকাল বেলায় লেখা আরম্ভ করিবার শুরুতেই একটি সাদা খাঁতায় একবার দরূদ
শরীফ লিখিয়া রাখিত তারপর লেখার কাজ শুরু করিত। উক্ত লোকটি যখন মৃত্যু
শয্যায় শায়িত তখন আল্লাহর ভয়ে কম্পিত হয়ে বলতে থাকে হায়! সেখানে আমার কি
উপায় হবে। ইত্যবসরে একজন মাজযুব সেখানে উপস্থিত হয়ে বলতে লাগল বাবা তুমি
কেন ঘাবড়াইতেছ? তোমার সেই সাদা খাঁতাটা যেখানে দরূদ শরীফ লেখা হইত উহা সেই
দরবারে পেশ করা হইয়েছে।’’ (তাবলীগী নিসাব, ফাজায়েলে দরূদ শরীফ ৯১ পৃঃ)
ভেবে দেখুন ঐ মাজযুব (পাগল) কি তাহলে
‘ইল্মে গায়িব কে চোষণ করে নিয়েছিল? সে কেমন করে বলল ঘাবড়ানোর প্রয়োজন নেই।
তোমার দরূদ রসূল (সাঃ) কবূল করেছেন। এখন আর কম্পিত হওয়ার প্রয়োজিন নাই।
আরো শুনুন : ‘‘ইব্রাহীম খা’ওয়াস (রহ.)
বলেনঃ একবার আমি জঙ্গল অতিক্রম করছিলাম। আমার বহু কষ্ট করা লাগল এবং মুসিবত
এর কারণে আমি দুর্ঘটনার সম্মুখীন হলাম। যাকে আমি বরদাশত করলাম এবং
প্রফুল্লচিত্তে তার পরে সবর করলাম। আমি যখন মাক্কায় প্রবেশ করলাম। তখন আমার
এই কীর্তির (কারনামর) পরে এক ধরনের (উয্ব) অহঙ্কার পয়দা হল। তওয়াফের
মধ্যেই পিছন থেকে একবুড়ি আওয়াজ দিল। হে ইব্রাহীম! ঐ জঙ্গলে এই বান্দিও
তোমার সাথে ছিল। কিন্তু আমি তোমার সঙ্গে এজন্য কোন কথা বলিনি যে, আল্লাহ
জাল্লাহ সানুহু থেকে তোমার ধ্যান অন্য দিকে চলে যাবে। এই ওয়াসওয়াসা যা
তোমার এই সময় এসেছে তা স্বীয় অন্তর হতে বের করে দাও। ([রওজ] ফাজায়েলে
হাজ্জ, মূল উর্দু ২৫৫ পৃঃ, গৃহীত তাবলীগী নিসাব আওর শির্ক)
উপরোল্লিখিত ঘটনা কি এ শিক্ষা দেয় না? যে
অলি আল্লাহ যদিও (নজরের) দৃষ্টি থেকে আড়ালে থাকেন, কিন্তু সাথে সাথে থাকেন।
অথচ কুরআন মাজীদে এভাবে আছে :
{وَاللهُ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ}
‘‘অন্তরে যা আছে আল্লাহ সে সম্পর্কে বিশেষভাবে অবহিত।’’ (সূরা আল-‘ইমরান ১৫৪)
মহান আল্লাহ আরো বলেন :
{وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْأِنْسَانَ وَنَعْلَمُ مَا تُوَسْوِسُ بِهِ نَفْسُهُ وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ}
‘‘আমিই মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং তার
প্রবৃত্তি তাকে যে কুমন্ত্রণা দেয় তা আমি জানি। আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমনী
অপেক্ষাও নিকটতর।’’ (সূরা আল-কাফ ১৬)
অন্তরের ভেদ জানা বা খবর রাখা এটা আল্লাহর গুণ। বান্দা কেমন করে তার এই গুণাবলীতে শরীক হতে পারে? অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন :
{وَمِنْ أَهْلِ الْمَدِينَةِ مَرَدُوا عَلَى النِّفَاقِ لاَ تَعْلَمُهُمْ نَحْنُ نَعْلَمُهُمْ}
‘‘এবং মাদ্বীনাবাসীদের মধ্যেও কেউ কেউ তারা কপটতায় সিদ্ধ। (হে নাবী) তুমি তাদেরকে জানো না, আমি তাদেরকে জানি।’’ (সূরা আত-তাওবাহ ১০১)
চিন্তা করে দেখুন যে, আল্লাহর রসূল (সাঃ)
মুনাফিকদের হাল সম্পর্কে জ্ঞাত নন। সহীহুল বুখারীতে আছে মুনাফিকরা তাঁকে
অর্থাৎ রসূল (সাঃ)-কে ধোকা দিয়েছে।
বিরে মাউনার স্থানে সত্তরজন ক্বারী
সহাবীকে মুনাফিকরা নির্মমভাবে শহীদ করেছিল। যদি নাবী (সাঃ) অন্তরের
অবস্থা জানতেন, তাহলে কেন তিনি (সাঃ) তাদের ধোকায় নিপতিত হলেন?
আগে শুনুন : ‘‘শাইখ
বানান বলেন : আমি মিশর থেকে হাজ্জে যাচ্ছিলাম। আমার পাথেয় অর্থাৎ পথ খরচ
আমার সঙ্গে ছিল। রাস্তায় একটি মহিলার সঙ্গে আমার সাক্ষাত, সে বলল বানান
তুমি দেখি (হাম্মাল) মজদুর (শ্রমিক) মনে হচ্ছে। পথের সামগ্রী বহন করে নিয়ে
চলেছ। তোমার কি এই সন্দেহ লাগে যে, সে (আল্লাহ) তোমাকে রিয্ক দিবেন না। আমি
তার কথা শুনে স্বীয় পাথেয় ফেলে দিলাম। তিনদিন পর্যন্ত আমি খাবার পেলাম না।
রাস্তার মধ্যে চলতে চলতে আমি একটি পাঁয়জোর অর্থাৎ নুপুর পরিত্যক্ত অবস্থায়
পেলাম। আমি এই মনে করে উঠিয়ে নিলাম যে, এর মালিক পাইলে আমি তাকে দিয়ে দিব।
হতে পরে সে এর বিনিময় আমাকে হয়তো কিছু দিয়ে দিবে। অতঃপর ঐ মহিলাটি পুনরায়
সামনে আসল এবং বলতে লাগল তুমি তো দোকানদার মনে হচ্ছে। যে নুপুরের বিনিময়
কিছু দিয়ে দেয়। এরপরে ঐ মহিলা আমার দিকে কিছু দিরহাম ছুড়ে মারল। বলল এগুলো
খরচ করতে থাকো। আমি ওগুলো খরচ করতে থাকি এবং ফিরার পথে মিশর পর্যন্ত তা
আমার কাজে আসে’’। (ফাজায়েলে হাজ্জ, মূল উর্দু ২৫৭ পৃঃ, গৃহীত প্রাগুক্ত)
এ ঘটনা প্রথম ঘটনার সমপর্যায়ের যে, এক
মহিলার আন্তরিক খেয়াল সম্পর্কে ভৎর্সনা করল এবং সে মহিলা বানান সাহেবের
সঙ্গেই ছিল কিন্তু বানান সাহেব তাকে তখন দেখত, যখন সে জাহির হত। উপরন্তু এ
ঘটনা শিক্ষা দেয় পাথেয় সাথে না রাখা উচিৎ। অথচ এ বিষয়টি কুরআন মাজীদের
সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে। মহান আল্লাহ বলেন, তোমরা পাথেয়ের ব্যবস্থা কর :
{وَتَزَوَّدُواْ}
‘‘পাথেয় সঙ্গে রাখিও।’’ (সূরা বাক্বারাহ ১৯৭)
পাঠকের খিদমতে এ দশটি ঘটনা তাবলীগী নিসাব
থেকে নকল করলাম। তাবলীগী নিসাবে এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা বর্ণিত আছে। আফসোস
তাবলীগকারীগণ এ ধরনের ঘটনাগুলো যদি তাবলীগী নিসাব থেকে বাদ দিতেন এবং উক্ত
স্থানে কুরআন ও সহীহ হাদীসের মাধ্যমে বিশুদ্ধ ঘটনাগুলো তুলে ধরতেন, তাহলে
তাদের এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে অসংখ্য, অগণিত মানুষ শির্ক, বিদ‘আত ও কুফরের
পথ থেকে মুক্তি পেতেন। আমরা আশাবাদী উলামায়ে হাক্ব এদিকে মনোযোগ দিবেন।
No comments:
Post a Comment