Monday, November 27, 2017

এমনভাবে জিকির কর যেন লোকে পাগল বলে

এমনভাবে জিকির কর যেন লোকে পাগল বলে


عن أبى سعيدن الخدرى أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال اكثروا ذكر الله حتى يقولوا مجنون رواه احمد

‘‘হুজুর পাক (ছঃ) এরশাদ করেন। এত বেশী পরিমাণ আল্লাহর জিকির করিতে থাক যেন লোকে তোমাকে পাগল বলিতে থাকে। (আহমাদ) অন্য হাদীছে বর্ণিত আছে, এত বেশী জিকির করিতে থাক যেন মোনাফেকগণ তোমাকে রিয়াকার বলিয়া আখ্যা দেয়।’’
ফায়েদাঃ এই হাদিছ দ্বারা বুঝা গেল যে, মোনাফেক এবং
বেওকুফ লোক যদি জিকিরকারীকে রিয়াকার এবং পাগল বলে তবুও জিকির হইতে বিরত থাকিবে না বরং এত বেশী এবং গুরুত্ব সহকারে জিকির করিতে থাকিবে যেন বাস্তবিকই লোকে পাগল বলিয়া ছাড়ে। এবং পাগল তখনই বলা হয় যখন খুব বেশী এবং জোরে জোরে জিকির করা হয়, আস্তে আস্তে জিকির করিলে কেহ পাগল বলে না।’’ (ফাজায়েলে জিকির- ২৯৭ পৃঃ)
সম্মানিত মুসলিম ভ্রাতাগণ! জনাব শায়খ উপরোল্লিখিত হাদীস দু’টির কোন সনদ বর্ণনা করেননি আমাদের তাহক্বীক্ব মতে হাদীস দু'টোই যঈফ (যা আমরা রিজাল এর মানদন্ডে যাচাইকৃত বিষয়টি আপনাদের সামনে তুলে ধরব।) আর উক্ত যঈফ হাদীস দ্বারা শাইখ জলি যিক্রও প্রমাণ করতে চেয়েছেন। যা সম্পূর্ণ কুরআন ও হাদীস পরিপন্থী। আমার ধারণা শাইখ যেহেতু চিশতীয়া খান্দানের লোক আর চিশতীয়া তরীকার যিকর হলো জোরে জোরে তাই তিনি সেটা প্রমাণ করার জন্য কুরআন ও সহীহ হাদীসে দলীল না পেয়ে উল্লিখিত যঈফ হাদীসের আশ্রয় নিয়েছেন। এ পর্যায়ে আমরা প্রথমে হাদীস দু’টির মান পাঠকের সামনে তুলে ধরব এবং জলি যিকরের ব্যাপারে কুরআন হাদীসের দলীল তুলে ধরব। এবার লক্ষ্য করুন, হাদীস দু’টির অবস্থা। শাইখ লিখিত প্রথম হাদীসটি দুর্বল।
এটি হাকিম (১/৪৯৯), ইমাম আহমাদ (৩/৬৮), আবদুল্লাহ ইবনু হুমায়দ ‘আল-মুনতাখাব মিনাল মুসনাদ’ (১/১০২) গ্রন্থে, আস-সালাবী ‘আত-তাফসীর’ (৩/১১৭-১১৮) গ্রন্থে, অনুরূপ আল-ওয়াহেদী ‘আল-ওয়াসীত’ (৩/২৩০/২) গ্রন্থে এবং ইবনু আসাকির (৬/২৯/২) দাররাজ আবুস সামহে সূত্রে আবুল হায়সাম হতে তিনি আবূ সাঈদ খুদরী হতে মারফূ‘ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। অতঃপর হাকিম বলেছেন, সনদটি সহীহ। যাহাবী তার সমালোচনা করেছেন নাকি তাকে সমর্থন করেছেন, তা আমার নিকট স্পষ্ট হয় নি। তবে তিনি দুর্বল বলেছেন এরূপই তার কথায় মিলছে দু’টি কারণে :
১। এ দাররাজের এ হাদীসটি ছাড়া অন্য হাদীসগুলোর ক্ষেত্রে যখন হাকিম সহীহ বলেছেন, তখন তিনি দাররাজকে উল্লেখ করে তার (হাকিমের) সমালোচনা করে বলেছেন যে, তার বহু মুনকার হাদীস রয়েছে।
২। তার সম্পর্কে তিনি ‘আল-মীযান’ গ্রন্থে বলেছেন, ইমাম আহমাদ বলেছেন, তার হাদীসগুলো মুনকার এবং দুর্বল। ইয়াহইয়া বলেন, তার ব্যাপারে কোন সমস্যা নেই। তার থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি নির্ভরযোগ্য।
নাসাঈ বলেন, তিনি মুনকারুল হাদীস। আবূ হাতিম বলেন, তিনি দুর্বল। ইবনু আদী তার কতিপয় হাদীস উল্লেখ করে বলেছেন, তার অধিকাংশ হাদীস অনুসরণযোগ্য নয়। ইমাম যাহাবী তার কতিপয় মুনকার হাদসি উল্লেখ করেছেন। এটি সেগুলোর একটি। এ থেকে স্পষ্ট হচ্ছে যে, হাফিয কর্তৃক হাদীসটিকে হাসান বলা সঠিক হয় নি। যেমনটি তার থেকে মানাবী নকল করেছেন।  (দেখুন যঈফ ও জাল হাদীস, সিরিজ- ২য় খন্ড, ৭৭ পৃষ্ঠা)
শাইয় বর্ণিত দ্বিতীয় হাদীসটির অবস্থাও ঐ একই কথা আল্লামা আলবানীর তাহক্বীক্ব আমরা আপনাদের সম্মুখে তুলে ধরছি। হাদীটি পেশ করা হল :

أكثروا ذكر الله حتى يقول المنافقون انكم مراءون

‘তোমরা আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ কর, যাতে করে মুনাফিকরা বলে যে, তোমরা দেখানোর জন্য তা করছ।’
হাদীসটি দুর্বল। এটিকে ইবনুল মুবারাক ‘আয-যুহুদ’ (১/২০৪/১০২২) গ্রন্থে এবং ‘অবদুল্লাহ ইবনু আহমাদ ‘যাওয়ায়েদুয যুহুদ’ (১০৮ পৃঃ) গ্রন্থে সাঈদ ইবনু যায়দ সূত্রে ‘আমর ইবনু মালিক হতে তিনি আযুব জাওযা হতে মারফূ‘ হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
এ সনদটি দুর্বল। মুরসাল এবং সাঈদ ইবনু যায়দ দুর্বর হওয়ার কারণ। আবুয জাওযা সূত্রে ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে মারফূ‘ মুত্তাসিল হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু তার সনদটি খুবই দুর্বল।
سلسله الاحاديث الضعيفة و الموضوعة(বাংলা যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ ২য় খন্ড, ৭৬ পৃঃ)
এই ছিল শায়খের লিখিত হাদীসের অবস্থা। এবার লক্ষ্য করুন শায়খ উল্লিখিত হাদীসের ফায়দায় যা লিখিছেন।
‘‘এবং পাগল তখনই বলা হয় যখন খুব বেশি এবং জোরে জোরে যিকর করা হয়, আস্তে আস্তে যিকর করলে কেউ পাগল বলে না’’ এর দ্বারা তিনি যিকর জলির প্রতি উৎসাহিত করেছেন। এখন আমরা লক্ষ্য করব এ বিষয়ে কুরআন হাদীসের সমাধান কি? যিকর সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন :

{وَاذْكُرُوهُ كَمَا هَدَاكُمْ}

‘‘তোমরা আল্লাহর যিকর ঐ নিয়মে কর যেভাবে তিনি তোমাদের পথ  দেখিয়েছেন।’’ (সূরা বাকারাহ ১৯৮)
সূরা আহযাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা বলেন :

{لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللهَ وَالْيَوْمَ الآخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيراً}

‘‘তোমরাদের জন্য আল্লাহর রসূলকে উত্তম আদর্শ নির্ধারণ করা হয়েছে, ঐ সমস্ত লোকের জন্য যারা আল্লাহ ও পরকালের আশা রাকে এবং অধিক মাত্রায় আল্লাহর যিকর করতে চায়।  (আহযাব ২১)
সুতরাং আল্লাহ যিকর যা বান্দাগণকে তিনি তাঁর রসূল (সাঃ)’র মাধ্যমে বাতলে দিয়েছেন তার মধ্যে আছে হিদায়াত, নূর এবং পরকালে পরিত্রাণের উপায়। মহান আল্লাহ বলেন :

{وَاذْكُرْ رَبَّكَ فِي نَفْسِكَ تَضَرُّعاً وَخِيفَةً وَدُونَ الْجَهْرِ مِنَ الْقَوْلِ بِالْغُدُوِّ وَالآصَالِ وَلا تَكُنْ مِنَ الْغَافِلِينَ}

‘‘তোমার প্রতিপালককে মনে মনে সবিনয় ও সশঙ্কচিত্তে অনুচ্চস্বরে প্রত্যুষে ও সন্ধ্যায় স্মরণ করবে এবং তুমি উদাসীন হবে না। (সূরা আ‘রাফ ২০৫)
এছাড়া দেখুন এই সূরার ৫৫-৫৬ নং আয়াতে বিনীতভাবে ও গোপনে যিকর করার নির্দেশ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ আরো বলেন, তোমরা আল্লাহর যিকর স্মরণ কর আমি তোমাদেরকে স্মরণ করবো। অতএব আল্লাহ যিকর অপেক্ষা বান্দার জন্য উত্তম কাজ আর কিছুই নেই। এটাই বান্দার জন্য সবচেয়ে বড় নিয়ামাত। মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন :

{وَلَذِكْرُ اللهِ أَكْبَرُ}

‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহর যিকরই সবচেয়ে বড় মূল্যবান।
 কেননা এ যিকরের বদৌলতে বান্দা তার মালিক তার জীবনের সবকিছু আরাধ্য সেই মহান সত্তার সঙ্গ লাভ করে। বান্দা ঐ যিকরের কারণে তার মহান প্রতিপালক, সর্ব কাজের ব্যবস্থাপকের নিকট স্মরণীয় হয়। নেমে আসে তার জীবনের উপর অপূর্ব তৃপ্তি। মানুষ চায় তার জীবনে শান্তি ও মনের তৃপ্তি এবং এমন এক সঙ্গ ও সাহর্চয যার কারণে সে হয়ে যায় সবচেয়ে মানসিক অভাবমুক্ত। মিটে যার যাবতীয় চাওয়া পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। দূর হয় নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্ব। কিন্তু এটা একমাত্র ঐ তরীকার অনুসরণে হয় যে তরীকা তার প্রভু তাকে শিক্ষা দিয়েছেন। আর ঐ তরীকাই হলো মুহাম্মাদ (সাঃ)’র তরীকা। সুতরাং যারা যিকর ও ওযিফা ‘আমালে মুহাম্মাদী তরীকার অনুসরণ না করে বিভিন্ন (অর্থাৎ চিশতিয়া, সাবেরীয়া, ক্বাদেরিয়া, নকশা বন্দীয়া, মুজাদ্দেদীয় ইত্যাদির) তরীকা মতে যিকর করে এবং ঐ নিয়মের তালকীন দেয়, তারা বিদ‘আত নীতির অনুসারী। যারা মুহাম্মাদী তরীকার ওযীফা’ ও জিকর করতে আগ্রহী তাদেরকে এ বান্দার লেখা মুসলিমের দু‘আ বইটি সংগ্রহ রাখতে বলছি। দ্বীন ইসলাম তথা উম্মাতে মুসলিমার মধ্যে সর্বপ্রথম ফিতনা আত্মপ্রকাশ পায় ঐ (জোরে জোরে) হালকায়ে যিকরওয়ালাদেরই নব আবিষ্কারের মাধ্যমে। কুফার মাসজিদে কিছু মানুষ জমায়েত হয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণে অর্থাৎ একশত বার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, একশত বার ‘সুবহানাল্লাহ’ একশত বার ‘আল্লাহু আকবার’ সকলে মিলে একই আওয়াজে পড়তে থাকে এবং তা একটা নেকীর কাজ মনে করে একই সাথে সূল মিলিয়ে ঐ যিকর করতে থাকলে সহাবী ইবনু মাস‘উদ (রাঃ) (মৃত্যু ৩২ হিজরী) তাদেরকে মাসজিদ থেকে বিদ‘আতী বলে বের করে দেন এবং বলেন : এরূপ নিয়মে যিকর করার নিয়ম আল্লাহর রসূল (সাঃ) ও সহাবাগণের নয়। সুতরাং তোমরা বিদ‘আতী, তোমরা বিদ‘আতী, তোমরা রসূল (সাঃ)’র তরীকার পরিপন্থী নিয়মের আবিষ্কারক বিদ‘আতী দল। ইবনু মাস‘উদ (রাঃ) তাদের বলতেন, তোমরা কি মুহাম্মাদ (সাঃ)’র সহাবাগণ অপেক্ষা অধিক দ্বীনদার? না, না তোমরা বিদ‘আতী, তোমরা বিদ‘আতী। তারা বলতে লাগল, ‘আমরা’ তো ভাল মনে করে নেকীর আশায় তা করছি। ইবনু মাস‘উদ (রাঃ) বললেন : ‘‘অনেক মানুষ ভাল মনে করে অনেক কাজ-কর্ম করবে, কিন্তু সেগুলো ভাল নয়, কিংবা নেকীর কাজও নয়। তোমরা এতে এমন এক নিয়ম আবিষ্কার করছ যা ইতোপূর্বে ছিল না। সুতরাং তোমরা বিদ‘আতেরই এক পথ খুলেছ।
এ হাদীস রিওয়ায়াত করেছেন স্পেনে বিখ্যাত মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবনুল ওয়াবাহ (মৃত্যু ২৭৬ হিঃ)। এ সম্পর্কে তার অতি মূল্যবান গ্রন্থ ‘আলবিদ ‘আওয়ান নাহিয়ি আনহু’ যা মিশরে ছাপিয়েছে ঐ অর্থের হাদীস সুনান দারিমীতেও বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া দেখুন আল্লামা হারূন ইবনু বাহাউদ্দিন আল হানাফী ‘নাযরাতুল হাক’ হক নীতির ঠেলিস্কোপ নামক কিতাবের ইবনু আবী শায়বার বরাতে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া ইবনুল মুবারা’র কিতাবুর রিকাক; ১৭৩ পৃষ্ঠা, বাংলায় দেখুন- ‘ফিরকাবন্দীর মূল্য উৎস, ৩৩ পৃৎ ইসলাম ও তাসাওউফ, ২৭-২৮ পৃঃ, সত্যের পথে প্রতিবন্ধকতা, ২৩-২৪।
উল্লেখ্য যে, যদিও তাবলীগী ভাইয়েরা এভাবে হালকায়ে যিকর আমভাবে করে না তথাপিও বাংলাদেশের এক বিশেষ পীর যিনি চিশতিয়া, সাবেরিয়া তরীকার সাথে সম্পর্ক রাখেন তাকে শায়খের বর্ণিত উল্লিখিত যঈফ হাদীস দ্বারা এবং তার লিখিত ফায়দা দ্বারা বার বার দলীল দিতে দেখা গেছে এবং তারা এ ধরনের যিকরে অভ্যস্ত। আল্লাহ আমাদের হক বুঝবার তাওফীক দান করুন। সর্বশেষ বলতে চাই, উল্লেখিত যঈফ হাদীসখানা কুরআন মাজীদেরও খিলাফ। কারণ যিকর হল ‘ইবাদাত আর ইবাদাতের ক্ষেত্রে পাগলামীর কোন গুনজায়েশ নেই। কেননা পাগল জ্ঞানহীনের ‘ইবাদাত সঠিক হয় না এবং তা কবূল করাও হবে না।
মহান আল্লাহ বলেন :

{حَتّٰى تَعْلَمُوا مَا تَقُولُونَ}

‘‘যতক্ষণ না তোমরা বুঝতে পারবে যে, তোমরা কি বলছ?’’ (আন নিসা ৪৩)
 (ড. আল্লামা ইউসুফ আল-কারযাভী- ইসলামের ‘ইবাদাতের পরিধি, ৩৮-৩৯ পৃঃ)

No comments:

Post a Comment

সাম্প্রতিক পোষ্ট

"যারা facebook চালায় তারা কখনই ভাল মুসলিম হতে পারে না" "FB তো ইহুদীর আবিষ্কার"?

"যারা facebook চালায় তারা কখনই ভাল মুসলিম হতে পারে না" "FB তো ইহুদীর আবিষ্কার" . "আপনি এত ইসলাম মানেন তাহলে f...

জনপ্রিয় পোষ্ট সমুহ