ইসালে সাওয়াব
‘‘আলী
বিন মুছা হাদ্দাদ (রহঃ) বলেন, আমি ইমাম আহমদ বিন হাম্বলের সাথে কোন এক
জানাজায় শরীক ছিলাম। মোহাম্মদ বিন কোদামা জওহারীও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। সেই
লাশ দাফন হওয়ার পর এক অন্ধ ব্যক্তি কবরের পার্শ্বে বসিয়া কোরআন পড়িতে
লাগিল। ইমাম সাহেব বলেন এইরূপ তেলাওয়াত করা বেদআত। ফিরিয়া আসিয়া মোহাম্মদ
বিন কোদামা ইমাম আহমদকে জিজ্ঞাসা করেন যে,
মোবাশ্বের বিন ইছমাঈল আপনার মতে
কেমন লোক? ইমাম সাহেব বলেন তিনি খুব বিশ্বস্ত লোক। এবনে কোদামা জিজ্ঞাসা
করেন আপনি কি তাঁহার নিকট হইতে হাদীছ শিখিয়াছেন? তিনি বলেন হ্যাঁ শিখিয়াছি।
তারপর মোহাম্মাদ বিন কোদামা বলেন, মোবাশ্বের আমাকে বলিয়াছেন আবদুর রহমান
বিন আলা বিন জাল্লাজ স্বীয় পিতা হইতে বর্ণনা করেন যে, তাঁহার পিতার
এন্তেকালের সময় তিনি তাঁহার কবরের পার্শ্বে ছূরায়ে বাকারার প্রথমাংশ
তেলাওয়াত করিবার অছিয়ত করিয়া গিয়েছেন। সাথে সাথে তিনি ইহাও বলেন যে, আমি
হজরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) কে এইরূপ অছিয়ত করিতে শুনিয়াছি। ইমাম সাহেব
এই ঘটনা শুনিয়া এবনে কোদামাকে বলেন যাও তুমি অন্ধকে কোরআন তেলাওয়াত করিতে
বল।’’ (ফাজায়েলে ছাদাকাত-১ম খন্ড, ১০৮-১০৯ পৃঃ)
সম্মানিত পাঠক ভাই ও বোনেরা! এ জাতীয় আরো
ঘটনা শাইখ সাহেব তার তাবলীগী নিসাবের ফাজায়েলে ছাদাসাতে উল্লেক করেছেন। যার
দ্বারা তিনি প্রমাণ করতে চয়েছেন যে, মুর্দার নিকট অথবা কবরের পার্শ্বে বসে
ইসালে সাওয়াবের জন্য কুরআন তিলাওয়াত করা বৈধ। এখন আমরা কুরআন ও সহীহ
হাদীসের ফায়সালা তুলে ধরছি এবং সিদ্ধান্ত পাঠকবর্গই নিবেন। মহান আল্লাহ
বলেন :
كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الأَلْبَابِ
‘‘এ বারাকাতময় কিতাব আমি তোমার উপর নাযিল
করেছি, তারা এগুলো নিয়ে গবেষণা করে এবং যারা জ্ঞানের অধিকারী তারা যেন এ
নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে।’’ (সূরা সোয়াদ-২৯)
সাহাবাগণ (রাযি.) কুরআনে বর্ণিত আল্লাহ
তা‘আলার হুকুম ও নিষেধের উপর ‘আমাল করতেন। ফলে তাঁরা দুনিয়া ও আখিরাতের
মধ্যে সৌভাগ্যলাশী হয়েছিলেন। যখন থেকে মুসলিমরা এ কুরআনের শিক্ষাকে ছেড়ে
দেয়া শুরু করল, মৃতদের কবরের উপর দুঃখের দিনে তা পড়তে শুরু করল, তখন থেকেই
তাদেরকে অপমান ও লাঞ্ছনা স্পর্শ করল এবং তাদের মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি হতে
শুরু হল। তাদরে জন্য সত্যই আল্লাহ তা‘আলার নিম্নোক্ত কথা প্রযোজ্য :
{وَقَالَ الرَّسُولُ يَا رَبِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوا هَذَا الْقُرْآنَ مَهْجُوراً}
‘‘রসূল বলেন, হে আমার প্রতিপালক! নিশ্চয়ই আমার জাতি এ কুরআনকে পরিত্যাগ করেছেন। (সূরা ফুরকান- ৩০)
নিশ্চয়ই আল্লাহ একে অবতীর্ণ করেছেন
জীবিতদের জন্য, যাতে তারা তাদের জীবদ্দশায় ‘আমাল করতে পারে। তা মৃতদের জন্য
নয়। কারণ তাদের ‘আমাল বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে তারা আর তা পড়তেও পারে না, ‘আমাল
করতেও পারে না এবং কুরআন পড়ার কোন সওয়াবও তাদের কাছে পৌঁছে না, একমাত্র
তাদের সন্তাদের পড়া ব্যতীত। কারণ সে তারই ঔরসজাত। নাবী বলেন :
إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ اِنْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُه إِلاَّ مِنْ ثَلاَثَةٍ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يَنْتَفَعُ بِه أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُوْلَه
অর্থ : যখন কোন মানুষ মারা যায়, তখন তার
‘আমালনামা বন্ধ হয়ে যায় তিনটা ক্ষেত্র ব্যতীত- ১) সাদাকায়ে জারিয়া, ২)
‘ইলম, যার দ্বারা অন্যের উপকার হয়, ৩) নেক সন্তান যে তার জন্য দু‘আ করে।
(মুসলিম)
মহান আল্লাহ বলেন :
{وَأَنْ لَيْسَ لِلإِنْسَانِ إِلاَّ مَا سَعَى}
‘‘মানুষ যা করে শুধামাত্র তারই প্রতিফল ভোগ করবে।’’ (সূরা নজম- ৩৯)
উল্লিখিত আয়াতের তাফসীরে ইবনে কাসীর বলেন :
{وَلاَ تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى وَإِن تَدْعُ مُثْقَلَةٌ إِلَى حِمْلِهَا لاَ يُحْمَلْ مِنْهُ شَيْءٌ وَلَوْ كَانَ ذَا قُرْبَى}
‘‘যদি কোন বোঝা বহনকারী তার বোঝ বহন করতে
আহবান করে তাবে তার উপর হতে কিছুই বহন করা হবে না, যদিও সে তার নিকট আত্মীয়
হয়। (ফাতির : ১৮)
যেমন তার উপর অন্যের বোঝা চাপানো হবে না
এবং অন্যের দুষ্কার্যের কারণে তাকে পাকড়াও করা হবে না। অনুরূপভাবে অন্যের
পূণ্যও তার কোন উপকারে আসবে না।
ইমাম শাফিয়ী (রহ.) এবং তাঁর অনুসারীগণ এই
আয়াত দ্বারা দলীল গ্রহণ করেছেন যে, কুরআন পাঠের সওয়াব মৃত ব্যক্তির কাছে
পৌঁছালে তার তার কাছে পৌঁচে না। কেননা না এটা তার ‘আমাল এবং না তার
উপার্জিত জিনিস। এই কারণেই রসূল (সাঃ) না এর বৈধতা বর্ণনা করেছেন, না এ
কাজে স্বীয় উম্মাতকে উৎসাহিত করেছেন। কোন সুস্পষ্ট ঘোষণা দ্বারাও নয় এবং
কোন ইঙ্গিত দ্বারাও নয়। অনুরূপভাবে সাহাবায়ে কিরাম (রাযি.)-এর মধ্য হতে কোন
একজন হতেও এটা প্রমাণিত নয় যে, তাঁরা কুরআন পড়ে তার সওয়াবের হাদিয়া মৃতের
জন্য পাঠিয়েছেন। এটা যদি পূণ্যের কাজ হত এবং শারী‘আত সম্মত ‘আমাল হত, তবে
সওয়াবের কাজে আমাদের চেয়ে বহুগুণে অগ্রগামী সাহাবয়ে কিরাম (রাঃ) এ কাজ
অবশ্যই করতেন। সাথে সাথে এটাও স্মরণ রাখার বিষয় যে, পূণ্যের কাজ কুরআন ও
সহীহ হাদীস দ্বারাই সাব্যস্ত হয়ে থাকে। কোন প্রকারের মত ও কিয়াসের স্থান
সেখানে নেই। হ্যাঁ, তবে দু‘আ ও দান-খয়রাতের সওয়াব মৃত ব্যক্তির কাছ পৌঁছে
থাকে। এ ব্যাপারে ইজমা রয়েছে এবং শারী‘আত প্রবর্তকের শব্দ দ্বারা প্রমাণিত।
তাছাড়া উল্লিখিত মুত্তাফাকুন ‘আলইহির যে হাদীসটি আমরা উল্লেখ করেছি, যা
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত; সেখানে মৃত্যুর পরে শুধু তিনটি ‘আমাল গৃহীত
হয়। এর ভাবার্থ এই যে, প্রকৃতপক্ষে এই তিনটি জিনিসও স্বয়ং মৃত ব্যক্তিরই
চেষ্টা ও ‘আমাল। অর্থাৎ অন্য কারো ‘আমালের প্রতিদান তাকে দেয়া হয় না। যেমন
হাদীসে এসেছে যে, মানুষের উত্তম খাদ্য তাই যা সে স্বহস্তে উপার্জন করেছে।
আর মানুষের সন্তানও তারই উপার্জিত। সুতরাং প্রমাণিত হল যে, সন্তান, তার
পিতা-মাতার মৃত্যুর পর তাদের জন্য দু‘আ করে, সেও প্রকৃতপক্ষে তারাই ‘আমাল।
অনুরূপভাবে সাদাকায়ে জারিয়াহ প্রভৃতিও তারই ‘আমালের ফল এবং তারই ওয়াকফকৃত
জিনিস। কুরআনে কারীমে ঘোষিত হয়েছে :
{إِنَّا نَحْنُ نُحْيِ الْمَوْتَى وَنَكْتُبُ مَا قَدَّمُوا وَآثَارَهُمْ وَكُلَّ شَيْءٍ أَحْصَيْنَاهُ فِي إِمَامٍ مُبِينٍ}
‘‘আমিই মৃতকে করি জীবিত এবং লিখে রাখি যা তারা অগ্রে প্রেরণ করে ও যা তারা পশ্চাতে রেখে যায়।’’ (ইয়াসীন : ১২)
এর দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, তার পিছনে
ছেড়ে আসা সৎকর্মগুলোর সওয়াব তার নিকট পৌঁছতে থাকে। এখন থাকল ঐ ‘ইলম যা সে
লোকদের মধ্যে ছড়িয়ে রেখেছে এবং তার ইন্তিকালের পরেও জনগণ তার উপর ‘আমাল
করতে থাকে। এটাও প্রকৃতপক্ষে তারই চেষ্টা ও ‘আমাল যা তার পরে জারি রয়েছে।
‘‘যে ব্যক্তি হিদায়াতের দিকে আহবান করে এবং যত লোক তার আহবানে সাড়াদিয়ে
হিদায়াতের অনুসারী হয়, তাদের সবারই কাজের প্রতিদান তাকে প্রদান করা হয়। আর
তাদের পুণ্যের কিছুই কম করা হয় না।’’ (তাফসীর ইবনে কাসীর, সপ্তদশ খন্ড,
১৬৯-১৭০)
তাছাড়া বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, কেউ মারা
গেলে, সেখানে কুরআন খতম ও অন্যান্য খতম পড়ার জন্য একদল ভাড়াটে ধর্ম
ব্যবসায়ী পাওয়া যায়, যারা পারিশ্রমিকের বিনিময় এগুলো করে থাকে। তাদের
সম্পর্কে হানাফী ফিকাহ গ্রন্থে অনেক কঠোর বাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। যেমন
মারেফুল কুরআনে মুফতী শফী হানাফী বলেন : ‘‘ইসালে সওয়াব উপলক্ষে
খতমে-কুরআনের বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা সর্বসম্মতভাবে না যায়েয। আল্লাম
শামী ‘‘দুররে মুখতারের শারাহ’’ এবং ‘‘শিফাউল-আলীল’’ গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে
এবং অকাট্য দলীলসহ একথা প্রমাণ করেছেন, কুরআন শিক্ষাদান বা অনুরূপ
অন্যান্য কাজের বিনিময় পারিশ্রমিক গ্রহণের যে অনুমতি পরবর্তী কালের ফকীহগণ
দিয়েছেন, তার কারণ এমন এক ধর্মীয় প্রয়োজন যে, তাতে বিচ্যুতি দেখা দিলে গোটা
শারী‘আতের বিধান ব্যবস্থার মূলে আঘাত আসবে। সুতরাং এ সব বিশেষ প্রয়োজনের
ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ রাখা একান্ত আবশ্যক। এজন পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মৃতদের
ইসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে কুরআন খতম করানো বা অন্য কোন দু‘আ-কালাম ও অযিফা
পড়ানো হারাম। কারণ, এর উপর কোন ধর্মীয় মৌলিক প্রয়োজন নির্ভরশীল নয়। এখন
যেহেতু পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কুরআন পড়া হারাম, সুতরাং যে পড়বে এবং পড়াবে,
তারা উভয়ই গুনাগার হবে। বস্ত্তত: যে পড়েছে সেই যখন কোন সওয়াব পাচ্ছে না,
তখন মৃত আত্মার প্রতি সে কি পৌঁছাবে? কবরের পাশে কুরআন পড়ানো বা
পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কুরআন খতম করানোর রীতি সাহাবী, তাবেয়ীন এবং প্রমথ
যুগের উম্মাতগণের দ্বারা কোথাও বর্ণিত বা প্রমাণিত নেই। সুতরাং এগুলো
নিঃসন্ধেহে বিদ‘আ। (তাফসীরে মারিফুল কুরআন ৩৫ পৃষ্ঠা)
No comments:
Post a Comment