সূফীদের বাড়াবাড়ীর উদাহরন
ক) মৃতকে জীবিত করাঃ
সুফীরা বিশ্বাস করে তাদের অলীরা মৃতকে জীবিত করতে সক্ষম।
চরমোনাই পীরের লেখা ভেদে মারেফত বা ইয়াদে খোদা বইয়ের ১৫ পৃষ্ঠায় মৃতকে জীবিত করার যে গল্পটা আছে তা নিম্নরুপঃ
শামসুদ্দ্বীন তাব্রীজী নামের এক লোক ছিলেন। লোকেরা তাকে পীর সাহেব কেবলা বলত। এবার আসি মূল গল্পে।
একদা হযরত পীর সাহেব কিবলা রোম শহরের দিকে
রওয়ানা হইলেন। পথিমধ্যে ঝুপড়ির ভেতর এক অন্ধ বৃদ্ধকে লাশ সামনে নিয়া
কাদঁতে দেখিলেন। হুজুর বৃদ্ধকে প্রশ্ন করিলে বৃদ্ধ উত্তর করিলেন, ‘‘হুজুর
এই পৃথিবীতে আমার খোঁজ-খবর করিবার আর কেউ নাই, একটি পুত্র ছিল সে
আমার
যথেষ্ট খেদমত করিত, তাহার ইন্তেকালের পর সে একটি নাতি রাখিয়া যায়। সেই ১২
বছরের নাতি একটা গাভী পালিয়া আমাকে দুগ্ধ খাওয়াইত এবং আমার খেদমত করিত, তার
লাশ আমার সম্মুখে দেখিতেছেন। এখন উপায় না দেখিয়া কাঁদিতেছি’’। হুজুর
বলিলেন এ ঘটনা কি সত্য? বৃদ্ধ উত্তর করিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই। তখন হুজুর
বলিলেনঃ "হে ছেলে আমার হুকুমে দাঁড়াও"। ছেলেটি উঠে দাঁড়াল এবং দাদুকে
জড়াইয়া ধরিল, বৃদ্ধ তাকে জিজ্ঞেস করিল ‘‘তুমি কিরুপে জিন্দা হইলে’’। ছেলে
জবাব দিল, ‘‘আল্লাহর অলি আমাকে জিন্দা করেছেন’’। (নাউজুবিল্লাহ) তারপর ঐ
অঞ্চলের বাদশাহ হুজুরের এই খবর পেয়ে উনাকে তলব করিলেন। উনাকে পরে জিজ্ঞেস
করিলেন "আপনি কি বলিয়া ছেলেটিকে জিন্দা করিয়াছেন"। হুজুর বলিলেন আমি বলেছি
‘‘হে ছেলে আমার আদেশে জিন্দা হইয়া যাও’’। অতঃপর বাদশাহ বলিলেন, ‘‘যদি আপনি
বলিতেন আল্লাহর আদেশে’’। হুজুর বলিলেন "মাবুদ! মাবুদের কাছে আবার কি
জিজ্ঞেস করিব। তাহার আন্দাজ নাই (নাউ-যুবিল্লাহ)। এই বৃদ্ধের একটি মাত্র
পুত্র ছিল তাহাও নিয়াছে, বাকী ছিল এই নাতিটি যে গাভী পালন করিয়া কোনরুপ
জিন্দেগী গোজরান করিত, তাহাকেও নিয়া গেল। তাই আমি আল্লাহ পাকের দরবার থেকে
জোরপূর্বক রুহ নিয়া আসিয়াছি’’। (নাউ-যুবিল্লাহ)।
এরপর বাদশাহ বলিলেন আপনি শরীয়াত মানেন
কিনা? হুজুর বলিলেন ‘‘নিশ্চয়ই! শরীয়াত না মানিলে রাসূল (সাঃ) এর শাফায়াত
পাইব না’’। বাদশাহ বলিলেন, ‘‘আপনি শির্ক করিয়াছেন, সেই অপরাধে আপনার শরীরের
সমস্ত চামড়া তুলে নেয়া হবে’’। এই কথা শুনিয়া আল্লাহর কুতুব নিজের হাতের
অঙ্গুলি দ্বারা নিজের পায়ের তলা থেকে আরম্ভ করে পুরো শরীরের চামড়া ছাড়িয়ে
নিলেন, তা বাদশাহর কাছে ফেলিয়া জঙ্গলে চলিয়া গেলেন। পরদিন ভোরবেলা যখন
সূর্য উঠিল তার চর্মহীন গায়ে তাপ লাগিল তাই তিনি সূর্যকে লক্ষ্য করিয়া
বলিলেন ‘‘হে সূর্য, আমি শরীয়াত মানিয়াছি, আমাকে কষ্ট দিওনা’’। তখন ওই দেশের
জন্য সূর্য অন্ধকার হইয়া গেল। দেশের মধ্যে শোরগোল পড়িয়া গেল। এই অবস্থা
দেখিয়া বাদশাহ হুজুরকে খুঁজিতে লাগিলেন। জঙ্গলে গিয়া হুজুরের কাছে বলিলেনঃ
শরীয়াত জারি করিতে গিয়া আমরা কি অন্যায় করিলাম, যাহার জন্য আমাদের উপর এমন
মুসিবত আনিয়া দিলেন। তখন হুজুর সূর্য কে লক্ষ্য করিয়া বলিলেনঃ আমি তোমাকে
বলিয়াছি আমাকে কষ্ট দিওনা, কিন্তু দেশবাসীকে কষ্ট দাও কেন? সূর্যকে বশ করা
কি কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব? ইহা বলা মাত্র সূর্য আলোকিত হইয়া গেল। আল্লাহ্
পাক তাহার ওলীর শরীর ভাল করিয়া দিলেন।
প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! চরমোনাই পীর কর্তৃক
বর্ণিত উপরোক্ত বানোয়াট কাহিনীতে গভীরভাবে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে এতে
একাধিক শির্ক বিদ্যমান। যেমনঃ
১) কুরআন বলছে, জীবিতকে মৃত্যু দেয়া এবং
মৃতকে জীবিত করা একমাত্র আল্লাহর কাজ। কোন নবী বা অলী মৃতকে জীবিত করার
ক্ষমতা রাখে না। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
قُلْ
مَنْ يَرْزُقُكُمْ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أَمْ مَنْ يَمْلِكُ
السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَمَنْ يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ
وَيُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنَ الْحَيِّ وَمَنْ يُدَبِّرُ الْأَمْرَ
فَسَيَقُولُونَ اللَّهُ فَقُلْ أَفَلَا تَتَّقُونَ
‘‘হে নবী! আপনি জিজ্ঞেস করুন, তোমাদেরকে
আসমান থেকে ও যমীন থেকে কে রুযী দান করেন? কিংবা কে তোমাদের কান ও চোখের
মালিক? তাছাড়া কে জীবিতকে মৃতের ভেতর থেকে বের করেন এবং কেইবা মৃতকে
জীবিতের মধ্য থেকে বের করেন? কে করেন কর্ম সম্পাদনের ব্যবস্থাপনা? তখন তারা
বলে উঠবে, আল্লাহ! তখন তুমি বলো, তারপরেও ভয় করছ না?’’ (সূরা ইউনুসঃ ৩১)
এই আয়াত থেকে বুঝা যায় মক্কার মুশরিকরাও এ
কথা বিশ্বাস করত না যে, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কেউ মৃতকে জীবিত বা জীবিতকে
মৃত্যু দান করার ক্ষমতা রাখেন না। অথচ চরমোনাইয়ের পীর ও মুরীদগণ তা
বিশ্বাস করে থাকেন। আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেনঃ
وَاللَّهُ يُحْيِي وَيُمِيتُ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ
‘‘অথচ আল্লাহ্ই জীবন দান করেন এবং মৃত্যু
দেন। তোমাদের সমস্ত কাজই, তোমরা যা কিছুই কর না কেন, আল্লাহ্ সবকিছুই
দেখেন।’’ (সূরা আল-ইমরানঃ ১৫৬) আল্লাহ তাআলা আরও বলেনঃ
كَذَلِكَ يُحْيِي اللَّهُ الْمَوْتَى وَيُرِيكُمْ آَيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ
‘‘এভাবে আল্লাহ্ মৃতকে জীবিত করেন এবং
তোমাদেরকে তার নিদর্শনসমূহ প্রদর্শন করেন, যাতে তোমরা চিন্তা কর। (সূরা
বাকারাঃ ৭৩) আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেনঃ
أَمِ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ فَاللَّهُ هُوَ الْوَلِيُّ وَهُوَ يُحْيِي الْمَوْتَى وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
তারা কি আল্লাহ্ ব্যতীত অপরকে অলী
(অভিভাবক ও বন্ধু) স্থির করেছে? উপরন্তু আল্লাহ্ই তো একমাত্র অলী (অভিভাবক ও
বন্ধু) । তিনি মৃতদেরকে জীবিত করেন। তিনি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাবান। (সূরা
শূরাঃ ৯) এমনি আরও অনেক আয়াত রয়েছে, যা থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ ছাড়া
অন্য কেউ মৃতকে জীবিত করতে পারে না। এটি একমাত্র আল্লাহর বৈশিষ্ট। এমন কি
আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অসংখ্য মুজেযা থাকা সত্ত্বেও
মৃতকে জীবিত করার মুজেযা তাঁকে দেয়া হয় নি। এটি ছিল একমাত্র ঈসা (আঃ)এর
মুজেযা।
এ ব্যাপারে তাদের দাপট দেখে মনে হয়
তাদের কল্পিত অলীরা মৃতকে জীবিত করার ক্ষেত্রে ঈসা (আঃ)এর চেয়েও বেশী
ক্ষমতা সম্পন্ন। কারণ ঈসা (আঃ) মৃতকে জীবিত করতেন قُمْ بِإِذْنِ اللَّهِ অর্থাৎ তুমি আল্লাহর আদেশে জীবিত হও। যেমন আল্লাহ তাআলা ঈসা (আঃ)কে লক্ষ্য করে বলেনঃ
وَإِذْ تُخْرِجُ الْمَوتَى بِإِذْنِي
‘‘এবং যখন তুমি আমার আদেশে মৃতদেরকে বের করে দাড় করিয়ে দিতে’’। (সূরা মায়িদাঃ ১১০)
আর চরমোনাই পীর ও মুরীদদের বিশ্বাস হচ্ছে, তাদের অলীগণ قُمْ بِإِذْني অর্থাৎ আমার আদেশে উঠে দাঁড়াও এ কথা বলে মৃতকে জীবিত করে থাকেন।
সুতরাং কেউ যদি বিশ্বাস করে যে, কোন পীর বা অলী মৃতকে জীবিত করতে পারে, তাহলে সে মুশরিক হিসেবে গণ্য হবে।
২) চন্দ্র-সূর্য, নদ-নদী, দিবা-রাত্রি ইত্যাদি আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারও হুকুমে চলে না। আল্লাহ তআলা বলেনঃ
اللَّهُ
الَّذِي رَفَعَ السَّمَاوَاتِ بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا ثُمَّ اسْتَوَى
عَلَى الْعَرْشِ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ كُلٌّ يَجْرِي لِأَجَلٍ
مُسَمًّى يُدَبِّرُ الْأَمْرَ يُفَصِّلُ الْآَيَاتِ لَعَلَّكُمْ بِلِقَاءِ
رَبِّكُمْ تُوقِنُونَ وَهُوَ الَّذِي مَدَّ الْأَرْضَ وَجَعَلَ فِيهَا
رَوَاسِيَ وَأَنْهَارًا وَمِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ جَعَلَ فِيهَا
زَوْجَيْنِ اثْنَيْنِ يُغْشِي اللَّيْلَ النَّهَارَ إِنَّ فِي ذَلِكَ
لَآَيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ
‘‘আল্লাহ্, যিনি উর্ধ্বদেশে স্থাপন করেছেন
আকাশমন্ডলীকে স্তম্ভ ব্যতীত। তোমরা সেগুলো দেখ। অতঃপর তিনি আরশের ওপর
অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এবং সূর্য ও চন্দ্রকে কর্মে নিয়োজিত করেছেন। প্রত্যেকে
নির্দিষ্ট সময় মোতাবেক আবর্তন করে। তিনি সকল বিষয় পরিচালনা করেন, নিদর্শন
সমূহ প্রকাশ করেন, যাতে তোমরা স্বীয় পালনকর্তার সাথে সাক্ষাত সমৃদ্ধে
নিশ্চিত বিশ্বাসী হও। তিনিই ভূমন্ডলকে বিস্তৃত করেছেন এবং তাতে পাহাড়-পর্বত
ও নদ-নদী স্থাপন করেছেন এবং প্রত্যেক ফলের মধ্যে দুই প্রকার (জোড়ায় জোড়ায়)
সৃষ্টি করেছেন। তিনি দিনকে রাত্রি দ্বারা আবৃত করেন। এতে তাদের জন্যে
নিদর্শন রয়েছে, যারা চিন্তা করে।’’ (সূরা রাদঃ ২-৩) আল্লাহ তাআলা আরও বলেনঃ
وَلَئِنْ
سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ
وَالْقَمَرَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ فَأَنَّى يُؤْفَكُونَ
‘‘যদি আপনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, কে
নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছে, চন্দ্র ও সূর্যকে কর্মে নিয়োজিত করেছে?
তবে তারা অবশ্যই বলবে ‘আল্লাহ্’। তাহলে তারা কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে? (সূরা
আনকাবুতঃ ৬১) আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেনঃ
أَلَمْ
تَرَ أَنَّ اللَّهَ يُولِجُ اللَّيْلَ فِي النَّهَارِ وَيُولِجُ
النَّهَارَ فِي اللَّيْلِ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ كُلٌّ يَجْرِي
إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى وَأَنَّ اللَّهَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ
‘‘তুমি কি দেখ না যে, আল্লাহ্ রাত্রিকে
দিবসে প্রবিষ্ট করেন এবং দিবসকে রাত্রিতে প্রবিষ্ট করেন? তিনি চন্দ্র ও
সূর্যকে কাজে নিয়োজিত করেছেন। প্রত্যেকেই নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত পরিভ্রমণ
করে। তুমি কি আরও দেখ না যে, তোমরা যা কর, আল্লাহ্ তার খবর রাখেন? (সূরা
লুকমানঃ ২৯)
খ) সুফীদের অলীগণ মানুষকে পশু বানিয়ে ফেলতে পারেনঃ
এখানে সুফীদের একটি বানোয়াট কারামতের ঘটনা
উল্লেখ করা বিশেষ প্রয়োজন মনে করছি। এটি এমন একটি ঘটনা, যা বর্ণনা করেছেন
আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শাইখ। আসুন ঘটনাটি শুনি।
শাইখ তার আলোচনায় বলেনঃ পূর্বকালে এমন
একজন সৎ আলেম ছিলেন, যিনি মানুষকে সৎ কাজের আদেশ দিতেন এবং অসৎ কাজের নিষেধ
করতেন। এমনকি তিনি হাঁটে-বাজারে গিয়েও দাওয়াতী কাজ অব্যাহত রাখতেন। একবার
তিনি বাজারে গিয়ে দেখলেন একজন আতর ব্যবসায়ী মাদক দ্রব্য তথা নেশা জাতীয়
বস্ত্ত বিক্রয় করছে। এ দৃশ্য দেখে স্বীয় অভ্যাস মোতাবেক তিনি জোরালো
প্রতিবাদ করলেন। তিনি অনবরত প্রতিবাদ চালিয়ে যেতে থাকলেন। এতে আতর ব্যবসায়ী
অসন্তুষ্ট হলো। প্রতিবাদের এক পর্যায়ে উক্ত আলেম লোকটি পশুর ন্যায়
জ্ঞানশুণ্য হয়ে গেলো। তাঁর অনুসারী ও ছাত্রগণ তাঁকে বাড়িতে নিয়ে গেলো। তারা
তাদের উস্তাদের বিষয়টি নিয়ে হতাশ হয়ে গেলেন এবং চিকিৎসার ব্যাপারে ব্যস্ত
হয়ে গেলেন। চিকিৎসা সম্পর্কে তারা লোকদেরকে জিজ্ঞেস করা শুরু করলেন। লোকেরা
এমন একজন চিকিৎসকের কথা বললো, যাকে যুল জানাহাইন তথা দুই ডানা ওয়ালা বলে
ডাকা হত। অর্থাৎ তাদের বিশ্বাস ছিল যুল জানাহাইন দুই প্রকার ইলমের অধিকারী।
একটি হচ্ছে শরীয়তের ইলম তথা যাহেরী ইলম আর অপরটি হচ্ছে হাকীকত-মারেফত তথা
বাতেনী ইলম।
যাই হোক তাকে সেই যুল জানাহাইনের কাছে
নিয়ে যাওয়া হলো। ছাত্ররা যুল জানাহাইনের কাছে তাদের উস্তাদের ঘটনা বর্ণনা
করার পর সে বললঃ আতর ব্যবসায়ীর (বিক্রয়কারীর) কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি
করার কারণেই তোমাদের উস্তাদের এই অবস্থা হয়েছে। তোমরা কি জান না যে, উক্ত
মদ ব্যবসায়ী মানুষের মাঝে বিরাট একজন অলী হিসাবে পরিচিত? এরপর যুল জানাহাইন
ছাত্রদেরকে বললঃ তোমরা তাকে ঐ আতর ব্যবসায়ীর (নেশা জাতীয় দ্রব্য
বিক্রয়কারীর) কাছে নিয়ে যাও এবং তার কাছে ক্ষমা চাও। এতে তোমাদের উস্তাদ
জ্ঞান ফিরে পাবে। তারা তাই করলো। তারা তাঁকে উক্ত আতর বিক্রেতা এবং কল্পিত
অলীর কাছে নিয়ে গেলেন এবং তাদের উস্তাদকে ক্ষমা করে দেয়ার আবেদন করলেন। এতে
আতর ব্যবসায়ী অলী আলেমের উপর সন্তুষ্ট হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরই ঘুমন্ত মানুষ
জাগ্রত হওয়ার ন্যায় উস্তাদ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পেলেন এবং তিনি সম্পূর্ণ
সুস্থ হয়ে গেলেন।
এবার শরীয়তের এই আলেম তাঁর মুসীবতে পড়ার
কারণ বুঝতে পারলেন এবং ইলমে মারেফতের গুরুত্বও বুঝতে সক্ষম হলেন। সুতরাং
তিনি ঐ আতর ব্যবসায়ী (হাশীশ, মদ, হেরোইন ইত্যাদি) বিক্রয়কারীর কাছে ক্ষমা
চাইলেন।
প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! এই ঘটনার বর্ণনাকারী
হচ্ছেন মিশরের স্বনাম ধন্য ইসলামী বিদ্যাপীঠ আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের
একজন শাইখ। তিনিও এই ধরণের কল্পিত কাহিনীতে বিশ্বাস করেন এবং মানুষের কাছে
তা বর্ণনা করেন। আমাদের দেশের দিকেও যদি আমরা একটু দৃষ্টি দেই তাহলে দেখতে
পাব আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও উঁচু মানের মাদরাসাগুলোর প্রফেসর,
মুহাদ্দিছ, মুফাসসির, শিক্ষক, আদালতের বিচারপতি, আইনজীবিসহ সকল পেশার
শিক্ষিত লোকেরা পেশাগত দায়িত্ব পালনে খুবই যত্মশীল। তারা যখন ছাত্রদেরকে
ক্লাশে পাঠ দান করতে যান তখন তারা প্রতিটি বিষয় পড়াতে গিয়ে ছাত্রদের জন্য
উপযুক্ত রেফারেন্স সরবরাহ করতে সচেষ্ট থাকেন এবং সঠিক ও নির্ভুল তথ্যটিই
প্রদান করতে গিয়ে বিষয়বস্ত্তর চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন। কোর্টের বিচারপতি ও
আইনজীবিগণ আসামীকে অভিযুক্ত করার জন্য একাধিক সাক্ষী ও দলীল প্রমাণ খুঁজতে
থাকেন।
কিন্তু যখন তারা কোন পীরের হাতে মুরীদ হতে
যান তখন তারা পীরের এমন সব কারামত ও কাহিনীর কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে যান এবং
চোখ বন্ধ করে তা বিশ্বাস করেন, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। তারা একবারের জন্যও
যাচাই-বাছাই করে দেখেন না যে, ইসলামী শরীয়তের সাথে এ বিষয়গুলো সাংঘর্ষিক কি
না?
আযহারের শাইখ যে কিচ্ছাটি শুনালেন তাতে
দেখা যাচ্ছে শরীয়তের সুস্পষ্ট আদেশ লংঘনকারীও আল্লাহর অলী হতে পারে,
শরীয়তের কোন বিধান না মানলেও প্রকৃত পক্ষে তারা আল্লাহর অলী। কেননা তারা তো
কারামত দেখাতে পারে। তারা মানুষকে পাগল করে দিতে পারে, মৃতকে জীবিত করতে
পারে, বৃষ্টি বর্ষণ করতে পারে এবং নদ-নদীও তাদের আদেশে চলে।
আমরা বলছিঃ এগুলো কারামত নয়। এগুলো হচ্ছে
শয়তানীয়াত বা শয়তানের খেলা-তামাশা মাত্র। এরা আল্লাহর অলী নয়; শয়তানের অলী।
এই সমস্ত শয়তানীয়াতে যারা বিশ্বাস করে তাদের জীবদ্দশায় যদি মিথ্যুক ও কানা
দাজ্জাল আসে তবে তারা সেই দাজ্জালের কথাও বিশ্বাস করবে। কিয়ামতের আগে
দাজ্জাল এসেও অনেক বড় বড় কাজ করে দেখাবে। সে আকাশকে বৃষ্টি বর্ষণের আদেশ
দিলে আকাশ বৃষ্টি বর্ষণ করবে, ঐ জমিনকে ফসল উৎপন্ন করতে বললে জমিন তা পালন
করবে এবং সে মৃত মানুষকেও জীবিত করে দেখাবে। এগুলো দেখিয়ে সে রুবুবীয়তের
দাবীও করবে। সুফীবাদের মাশায়েখরা এভাবে মানুষের জন্য মিথ্যা ও বানোয়াট
কারামত বর্ণনা করার মাধ্যমে মুসলিমদের জন্য দাজ্জালের প্রতি বিশ্বাস করার
পথই যে সহজ করে দিচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
আর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামআতের লোকেরা
অলীদের কারামতে বিশ্বাসী। স্বাভাবিক ও প্রচলিত রীতির বাইরে যা প্রকাশিত হয়
তাই কারামত। তার মাঝে এবং শয়তানীয়াতের মধ্যে পার্থক্য করার মূলনীতি হচ্ছে,
আমরা দেখবো যে কার থেকে তা বের হয়েছে? তিনি যদি কুরআন ও সুনাহ-এর অনুসারী
মুমিন ব্যক্তি হয়ে থাকেন এবং হারাম ও গর্হিত কাজ থেকে দূরে থাকেন তাহলে
আমরা তাঁর কারামতে বিশ্বাস করি। এ ধরণের অনেক কারামত সাহাবী ও সালাফদের
থেকে বর্ণিত হয়েছে। এগুলো আমরা কখন-ই অস্বীকার করি না।
পক্ষান্তরে যারা মদ্যপায়ী, হারাম কাজে সদা
মশগুল এবং শরীয়তের উপর আমল করে না, তাদের থেকে চিরাচরিত নিয়মের বাইরে কিছু
বের হলে আমরা সেগুলোকে দাজ্জাল ও শয়তানের কাজ বলেই মনে করি। এগুলো ইসলামের
পক্ষে নয়; বরং বিপক্ষে এবং ইসলামের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এখানে আরেকটি কথা
বিশেষভাবে স্মরণ রাখা দরকার যে, যে সমস্ত সিফাত (গুণাগুণ ও কর্ম) শুধু
আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট তা কখনও অলীদের কারামত হতে পারে না। সুতরাং যে
সমস্ত পীর শরীয়তের পুরোপুরি অনুসরণ করে বলে দাবী করে এবং তাদের মধ্যে
ইসলামী আমল ও আদব-আখলাক দেখা যায় তারাও যদি এমন কিছু দাবী করে, যা আল্লাহর
গুণাগুণ ও সিফাতের সাথে খাস তাও ভন্ডামী।
আমাদের দেশের দেওয়ানবাগী, ছারছিনা,
চরমোনাই, ফুরফুরা শরীফ, তাবলীগ জামাআত এবং অন্যান্য তরীকার পীরদের মাঝে
ইসলামী লেবাস পরিলক্ষিত হলেও তাদের বই-পুস্তক ও ভাষণ-বক্তৃতায় এমন অনেক
কারামতের বর্ণনা পাওয়া যায়, যা আল্লাহর সিফাতের অন্তর্ভূক্ত। সুতরাং এগুলোও
কারামত নয়; বরং শয়তানীয়াত। এ সব থেকে মুসলিমদের সাবধান ও সতর্ক থাকা
জরুরী। সঠিক ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনই সকল প্রকার গোমরাহী থেকে বাঁচার
একমাত্র উপায়।
No comments:
Post a Comment